আল হাসানাইন (আ.)

সূরা বাকারাহ;(৬৩তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৫৩-২৫৫

সূরা বাকারাহ'র ২৫৩তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آَمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ

"এই সকল নবী- আমি তাঁদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাঁদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাঁদের কাউকে পদ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। আমি মরিয়মপুত্র ঈসাকে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী দান করেছি এবং তাঁকে পবিত্র আত্মা বা জিবরাইলের মাধ্যমে শক্তিশালী করেছি। আল্লাহ চাইলে এইসব নবী আসার পর এবং মানুষের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনাদী আসার পরও তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করত না। কিন্তু আল্লাহ মানুষকে পথ নির্দেশনা বা হেদায়াত গ্রহণে বাধ্য করতে চাননি। মানুষ সত্য মেনে নেয়ার ব্যাপারে মত-বিরোধে লিপ্ত ছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ঈমান এনেছিল। আবার অনেকেই কাফের বা অবিশ্বাসী হয়েছিল। আল্লাহ যদি চাইতেন,তাহলে এই দুই দল পরষ্পরের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতো না। কিন্তু আল্লাহ যা চান,তাই করেন।" (২:২৫৩)

আগের আয়াতে বলা হয়েছিল আল্লাহ হযরত দাউদ (আঃ)-কে প্রজ্ঞা ও শাসন-ক্ষমতা দান করেছেন। এই আয়াতে নবীদের মধ্যে মর্যাদা ও অবস্থানের পার্থক্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,সমস্ত নবীরা একই মর্যাদার অধিকারী নন। তাঁদের কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। যেমন,হযরত মুসা (আঃ) কোন মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতেন এবং হযরত ঈসা (আঃ) সব সময় হযরত জিবরাইলের মাধ্যমে সাহায্য পেতেন। এরপর মানুষ সম্পর্কে আল্লাহর এক গুরুত্বপূর্ণ নীতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে- মানুষ তার নিজস্ব পথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বাধীন। তারা ইচ্ছে করলে ঈমান আনতে পারে আবার নাও আনতে পারে। তারা ইসলামের নবীর অনুসারী হতে পারে কিংবা অন্য কোন নবীর প্রতিও ঈমান আনতে পারে। নিঃসন্দেহে যদি আল্লাহ চাইতেন,তবে তিনি মানুষের মধ্যে মতবিরোধ ও বিবাদ দূর করতে পারতেন এবং সব মানুষকে জোর করে একই পথের অনুসারী করতেন। কিন্তু এটা আল্লাহর নিয়ম নয়। বরং আল্লাহর নিয়ম হলো,মানুষ স্বাধীনভাবেই কোন ধর্ম গ্রহণ করবে অথবা কোন ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : জোরপূর্বক ধর্মে দীক্ষিত করা মূল্যহীন। কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোন ধর্ম গ্রহণ করে,তবেই তার মূল্য থাকবে। তাই ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক এবং কোন ধর্ম গ্রহণ করা বা না করা মানুষের ইচ্ছা বা বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করে।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহ নবীদেরকে স্পষ্ট যুক্তি ও দলীল- প্রমাণ সহকারে পাঠিয়েছেন। মানুষ কখনো অহমিকা বা খেয়ালীপনার কারণে এবং কখনো অজ্ঞতার কারণে নবীদেরকে মেনে নেয় না।

এরপরের আয়াত অর্থাৎ ২৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ

 

"হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি,সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর,যেদিন ক্রয়-বিক্রয়,বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত সীমালংঘনকারী।" (২:২৫৪)

 

এই আয়াতে মুমিনদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে যে,দুনিয়ার জীবনকে যেন তারা সূবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এবং কিয়ামত বা বিচার দিবসের জন্য তারা যেন পাথেয় সংগ্রহ করে। তাই এ দুনিয়াতেই আল্লাহর সঙ্গে লেনদেন করতে হবে এবং এজন্যে নিজের সম্পদ থেকে অন্যদের দান-খয়রাত করতে হবে। বিচার দিবসে কেনা ও বেচার কোন ব্যবস্থা নেই এবং শাস্তি থেকে মুক্তি-পাওয়া বা সৌভাগ্য কেনার কোন সুযোগ নেই। বন্ধু এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মহৎ লোকদের ওপর ভরসা করা উচিত নয়। কারণ,বিচার দিবসে তারাও কোনই উপকার করতে পারবে না এবং তাদের সুপারিশ ও মধ্যস্থতাও কোন কাজে লাগবে না।

 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

আমাদের মধ্যে দানশীলতার মনোভাব সৃষ্টির জন্য আল্লাহ ৩টি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন।

প্রথমত : মানুষের যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহর দেয়া।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহ তার দেয়া সম্পদ থেকে কিছু অংশ দান করতে বলেছেন,সমস্ত সম্পদ দান করতে বলেননি।

তৃতীয়ত : বিচার দিবসে এই দান অন্য সব বন্ধুর চেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে দেখা দেবে।

 

২৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ

 

"আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য বা মাবুদ নাই। তিনি চিরঞ্জীব,অনাদি। তন্দ্রা বা নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না,আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর। এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে অনুরোধ করতে পারে? তাদের (মানুষের) সম্মুখে ও পেছনে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত আছেন। তা-ছাড়া তাঁর অনন্ত জ্ঞানের কোন বিষয়েই কেউ ধারণা করতে পারে না,অবশ্য আল্লাহ যতটা চান,ততটা জ্ঞান কাউকে দান করেন। তাঁর আসন আকাশ ও পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত। এসবের রক্ষণাবেক্ষনে তিনি ক্লান্ত হন না। তিনি মহান ও মহিয়ান।" (২:২৫৫)

 

এই আয়াতে কুরসী শব্দ থাকায় তা ‘আয়াতুল কুরসী' নামে বিখ্যাত। এতে এক আল্লাহর গুণাবলী ও সত্ত্বার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সমস্ত ঐশী ধর্মের মূল বাণী হলো,তৌহিদ বা একত্ববাদ। একত্ববাদ মানুষকে মূর্তি ও কল্পিত খোদার উপাসনা করা থেকে মুক্তি দেয়। তৌহিদ মানুষকে তাগুতি ও অত্যাচারী শাসকের যাঁতাকল থেকে মুক্ত করে তাদেরকে স্বাধীনতা ও সৌভাগ্যের পথ দেখায়। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' হলো,এমন এক পরিচিত বাক্য যা জন্মের সময় মুসলমান নবজাতকের কান ও অন্তরকে প্রশান্তি দেয় এবং প্রতিদিন আযানের মধুর ডাকের সাথে এই বাক্য তাঁর সত্ত্বায় মিশে যায়।‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র অর্থ হ'ল,আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য হওয়ার যোগ্য নয়। সমস্ত পূর্ণতা ও সৌন্দর্যের উৎস তিনি। আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে তাদের কেউই নিজ থেকে পূর্ণতার অধিকারী নয় বলে তারা উপাস্য হতে পারে না এবং তারা ভক্তি-শ্রদ্ধা পাবারও যোগ্য নয়। প্রকৃত জীবন হলো,সেই জীবন যার ধ্বংস নেই এবং ঐ জীবনের অধিকারী হলেন আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর সবই ধ্বংসশীল। একমাত্র আল্লাহই কারো ওপর নির্ভরশীল নয় এবং সব কিছুই আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ কখনোই দুর্বলতা,ক্লান্তি,ঘুম ও তন্দ্রার শিকার হন না। আল্লাহ যদি মুহূর্তের জন্যেও বিশ্ব জগতের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতেন তাহলে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। তিনিই সব কিছুর মালিক এবং সবই তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত বা মালিকানাধীন। ফলে আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো উপাসনা করব না। আর কেনই বা করবো?

অবশ্য মুশরিকরাও আল্লাহকে বিশ্বের স্রষ্টা বলে মনে করে,কিন্তু তারা এটাও মনে করে যে,বিভিন্ন মূর্তি তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে। এই আয়াতে বলা হয়েছে,কল্পিত ও মনগড়া আশ্রয় ত্যাগ কর। শুধুমাত্র ঐশী মহাপুরুষ নবী বা আল্লাহর আওলিয়ারা সুপারিশ করতে পারবেন এবং তারাও আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করতে পারবেন না। আয়াতের শেষাংশে কুরসী শব্দ প্রয়োগ করে আল্লাহর অসীম শক্তি ও জ্ঞানের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে,বলা হয়েছে আল্লাহ শুধু প্রাণযুক্ত সত্ত্বার মালিক নন,সমস্ত সৃষ্টি জগতের সব কিছুর ওপরই তাঁর কর্তৃত্ব রয়েছে এবং কোন কিছুই তাঁর কর্তৃত্ব ও ইচ্ছা থেকে স্বাধীন নয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

আমরা এমন সত্ত্বার কাছে মাথা নত করব যিনি জ্ঞান,ক্ষমতা,অনুগ্রহসহ সকল ক্ষেত্রে চরম পূর্ণতার অধিকারী এবং যিনি সব ধরনের দুর্বলতা ও দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)