আল হাসানাইন (আ.)

সূরা বাকারাহ;(৬৮তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৭৩-২৭৭

সূরা বাকারাহ'র ২৭৩ ও ২৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (২৭৩) لَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَناُونَ

"দান ও সদকা এমন অভাবগ্রস্তদের প্রাপ্য,যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে জীবিকার সন্ধানে ঘোরা ফেরা করতে পারে না,তারা কিছু চায় না বলে অবিবেচক ব্যক্তিরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। কিন্তু তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে ব্যাকুলভাবে কিছু চায় না। তোমরা যা কিছু দান কর,আল্লাহ তা জানেন।" (২:২৭৩)

"যারা দিনে ও রাতে,গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজের সম্পদ থেকে দান করে,আল্লাহর কাছে তাদের পুরষ্কার রয়েছে,সুতরাং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দানের জন্য দুঃখিত হবে না।" (২:৭৪)

এই দুই আয়াতের ব্যাখ্যা হলো,ইসলাম মুসলিম সমাজে ন্যায় ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব পরামর্শ দেয়,সেসবের মধ্যে অন্যতম হলো,দান-খয়রাত করা। অর্থাৎ ইসলাম ধনী ও সম্পদশালীদেরকে তাদের সম্পদের কিছু অংশ দরিদ্র ও বঞ্চিতদের দান করতে বলে। এই আয়াতে দান করার একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে,যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও হিজরতের কারণে সম্পদ হারিয়েছে এবং আয়-উপার্জনের কোন ক্ষমতাও যাদের নেই তাদেরকে যেন দান করা হয়। সংযমী হওয়ার কারণে এই শ্রেণীর মানুষ অন্যদের কাছে কিছু চায় না এবং নিজেদের অভাবের কথাও তুলে ধরে না। তাই সাধারণ মানুষ তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। কিন্তু মুমিনদেরকে এই সম্মানিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং এইসব দ্বীনি ভাইয়েরা যেন কষ্ট না পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে দেখা গেছে ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবী (সাঃ)-র অনেক সহযোগী তাঁর সাথে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। মদীনায় তাদের ঘরবাড়ী,অর্থ-সম্পদ কিছুই ছিল না। কারণ,মক্কার মুশরিকরা তাদের সমস্ত ধন-সম্পদ দখল করে নিয়েছিল। মদীনার মানুষ তাদের অনেককে নিজেদের ঘরে স্থান দেয় ও তাদের ব্যয়ভার বহন করতে থাকে। তবে মুহাজিরদের অধিকাংশই মসজিদে নববীর ‘সুফফাহ' নামক স্থানে আশ্রয় নেয়। এই দুই আয়াতে তাদের আভাব মোচনের জন্য মুমিনদেরকে আহবান জানানো হয়েছে ।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : ধনীদের সম্পদের মধ্যে আল্লাহ দরিদ্রদের অধিকার রেখেছেন।

দ্বিতীয়ত : মুসলিম সমাজে দরিদ্ররা তাদের অভাবের কথা বলার আগেই যেন তাদের অভাব মেটানো হয়। এতে করে মুমিনের সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। মুসলিম সমাজে মুমিনের সম্মান ক্ষুন্ন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।

তৃতীয়ত: যারা আল্লাহর রাস্তায় দান খয়রাত করে,আল্লাহ তাদেরকে ভবিষ্যতে দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখবেন এবং তাদের কোনো ভয় নেই। কারণ,আল্লাহর ওপর ভরসা করার কারণে তারা নিজেদের দানের জন্য কখনও অনুতপ্ত বা দুঃখিত হবে না।

 

এরপর ২৭৫ ও ২৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (২৭৫) يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ

"যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির মত দণ্ডায়মান হবে যাকে শয়তান স্পর্শদ্বারা পাগল করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থা এজন্য যে,তারা বলে,বেচা-কেনা তো সুদের মত! অথচ আল্লাহ বেচা-কেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ বা হারাম করেছেন। অতএব,যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ আসার পর সে সুদ গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে অতীতে তার সুদ নেয়ার বিষয়টি আল্লাহ বিবেচনা করবেন। কিন্তু যারা পুনরায় সুদ নিতে আরম্ভ করবে,তারাই নরকের অধিবাসী,সেখানে তারা স্থায়ী হবে । (২:২৭৫)

"আল্লাহ সুদের আয়কে ধ্বংস করেন এবং দানকে বাড়িয়ে দেন ,আল্লাহ অবিশ্বাসী বা অকৃতজ্ঞ পাপীদের ভালবাসেন না।" (২:২৭৬)

আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন,মহান আল্লাহ সুরা বাকারার পর পর ১৪টি আয়াতে মুমিনদেরকে দান খয়রাতে উৎসাহিত করেছেন এবং এর ব্যক্তিগত ও সামাজিক সুফলেরও বর্ণনা দিয়েছেন। একদিকে দানশীলতার চেতনা শক্তিশালি করা ও দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ কমানো এবং অন্যদিকে শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস করাসহ ইসলামী সমাজে ভ্রাতৃত্বের চেতনা জোরদার করা এসব আয়াতের মূল লক্ষ্য। আর এসব আয়াতের পর পবিত্র কোরআনে সুদ সমস্যার উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,সুদ সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করা ছাড়াও ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্যকেও নষ্ট করে। সুদের কারণে একদিকে ধনীদের বিরুদ্ধে গরীবদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়তে বাড়তে তা বিস্ফোরণের পর্যায়ে উপনীত হয় এবং অন্যদিকে তা সুদখোরের মধ্যে এমন উন্মত্ততা সৃষ্টি করে যে,সে অর্থ ও স্বর্ণ ছাড়া আর কিছুই চেনেনা। এ ধরনের ব্যক্তি টাকার জন্য মানবিকতা পর্যন্ত বিসর্জন দেয়। সুদখোর সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন ভূমিকা রাখে না। চিন্তা ও শ্রম না খাটিয়েই সে অভাবগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ দাবী করে। এরফলে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয় এবং ধনীরা আরো ধনী হয়। আর সমাজের বঞ্চিত শ্রেণীর ওপর এটা সবচেয়ে বড় ধরনের জুলুম। আর এ জন্যেই সমস্ত ঐশী গ্রন্থে সুদকে হারাম করা হয়েছে এবং সুদখোরদের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। দৃশ্যত : সুদের মাধ্যমে অর্থের বৃদ্ধি,ও দান সদকার মাধ্যমে সম্পদ হ্রাস পেলেও সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি ও বরকত আল্লাহর ইচ্ছাধীন। সুদের মাধ্যমে যে অর্থ অর্জিত হয় তা ব্যক্তির জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে না। সুদের আয়ে বঞ্চিতদের ঘৃণা থাকে বলে সুদখোর জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা পায় না এবং অনেক সময় তার আসল সম্পদও হাতছাড়া হয়ে যায়। অথচ দানশীল ব্যক্তি দানের জন্য সমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করায় নিরাপত্তা ও প্রশান্তি লাভ করে এবং তার উন্নতি ও কল্যাণের পথ প্রশস্ত হয়।

এই দুই আয়াতে যা শিক্ষণীয় তার সার-সংক্ষেপ হলো-

প্রথমত : সুদ গ্রহণ ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং এরফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়। সুদখোর ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা অর্জন করে এবং সুদ গ্রহণের কারণে সমাজে ন্যায়ের পরিবর্তে জুলুম ও নিপীড়নের বিস্তার ঘটে ।

দ্বিতীয়ত: ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম। তাই এ ধর্মে অর্থনৈতিক কর্মসূচিও রয়েছে। ইসলাম মানুষের ওপর নিস্প্রাণ ইবাদত চাপিয়ে দেয় না এবং পার্থিব বিষয়ে মানুষকে দিক-নির্দেশনা বিহীন ছেড়ে দেয়নি।

তৃতীয়ত : সুদ-গ্রহণ এক ধরনের অকৃতজ্ঞতার প্রকাশ। আল্লাহ আমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা আল্লাহর দেয়া আমানত মাত্র। এ সম্পদ থেকে বঞ্চিতদের দান না করা হলো,আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এ অকৃতজ্ঞতা সম্পদের ধ্বংস ডেকে আনে।

 

এরপর ২৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

 

"যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে ও যাকাত দেয়,তারা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবে। ভবিষ্যতের জন্য তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং ( অতীতের জন্যেও) তারা দুঃখিত বা অনুতপ্ত হবে না।" (২:২৭৭)

এই আয়াতে প্রকৃত মুমিনের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে,প্রকৃত মুমিন বা বিশ্বাসী শুধু নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে না,তারা যাকাত দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির সাথেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃত মুমিন বা বিশ্বাসীরা ধর্মকে প্রাণহীন শুষ্ক দায়িত্বের মধ্যে সীমিত করে না। তারা অন্যদের কল্যাণের জন্যেও সচেষ্ট থাকে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)