আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আলে ইমরান;(৯ম পর্ব )

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ৪৪-৪৭

সূরা আলে ইমরানের ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


ذَلِكَ مِنْ أَنْبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ (৪৪)
 


"হে নবী! মারিয়ামের জন্মের ঘটনা নিয়ে যা বলা হলো,তা অদৃশ্যের সংবাদ। ওহীর মাধ্যমে এই সংবাদ আপনাকে জানাচ্ছি। মারিয়ামের তত্ত্বাবধানের ভার কে নেবে সেটা নির্ধারণের জন্য ইহুদী আলেমরা যখন কলম ছুঁড়ে লটারী করছিল,আপনি তখন সেখানে ছিলেন না এবং এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তারা যখন বাদানুবাদ করছিল,তখনও আপনি সেখানে ছিলেন না।" (৩:৪৪)

মক্কার মুশরিকরা পবিত্র কোরআনকে আল্লাহর নবীর ওপর অবতীর্ণ গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করত না। তারা বলতো কোরআন কল্পকাহিনী ছাড়া কিছু নয়,মোহাম্মদ ইহুদী পণ্ডিতদের কাছে এগুলো শিখেছেন অথবা অতীতকালের বই পুস্তকে সেগুলো পড়েছেন। আল্লাহ এর উত্তরে বলছেন,পবিত্র কোরআনের অধিকাংশ কাহিনীই অদৃশ্যের সংবাদ এবং কেউই তা জানতো না। আর রাসুল (সা.) ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই এসব জেনেছেন। যেমন,মারিয়ামের মায়ের মানত করার ঘটনা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানতো না এবং মারিয়ামের দেখা শোনার ধরণ সম্পর্কেও তোমরা কেউ কিছু জানতে না। এগুলো সবই অদৃশ্যের খবর যা ওহীযোগে রাসূল (সা.)কে জানানো হয়েছে। মারিয়াম (সা.)'র তত্ত্বাবধান সম্পর্কে আমরা গত কয়েকটি পর্বে বলেছিলাম,মারিয়াম (সা.)'র মা আল্লাহর কাছে মানত করেছিলেন,যদি তাঁর কোন সন্তান হয়,তাহলে তিনি তাকে বায়তুল মোকাদ্দস মসজিদের খাদেম করবেন এবং মানত অনুযায়ী তিনি মারিয়ামকে মসজিদের তত্ত্বাবধায়কদের কাছে নিয়ে আসেন। তত্ত্বাবধায়করা তখন মারিয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন। কারণ,মারিয়ামের পিতা ও মাতা ছিলেন বনি ইসরাইলের অত্যন্ত সভ্রান্ত ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব এবং মারিয়ামের তত্ত্বাবধানকে তারা গর্বের বিষয় বলে মনে করছিল।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,

প্রথমত : কোরআন আল্লাহর বাণী । কোন বই থেকে এটি নকল করা হয়নি অথবা কারো স্মৃতিচারণ অবলম্বনে এটি লেখা হয়নি।

দ্বিতীয়ত : শুধু আধ্যাত্মিক ও পবিত্র দায়িত্বের ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায়। দুনিয়াবি পদ ও ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত নয়।

সূরা আলে ইমরানের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ (৪৫)

"যখন ফেরেশতারা বলল,হে মারিয়াম! আল্লাহ আপনাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি কথার মাধ্যমে সুসংবাদ দিচ্ছেন,তার নাম মারিয়ামের পুত্র ঈসা। ঈসা ইহকাল ও পরকালে সম্মানিত এবং তিনি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম।" (৩:৪৫)

মারিয়াম (সা.)'র কন্যা সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মায়ের মানত অনুযায়ী বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের সেবিকা হন। সেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদত ও সাধনায় অনেক বছর অতিবাহিত করেন। ফেরেশতারা মারিয়ামের জন্য বেহেশতী খাবার নিয়ে আসতো। তিনি এত যোগ্যতা অর্জন করেন যে,আল্লাহ তাকে মহাসম্মানিত এক পুত্র দান করেন। মানুষের কাছে সম্মানিত হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন আল্লাহর কাছে নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন। খ্রিস্টানদের ধারণা হলো ঈসা (আ.) নিজেই একজন খোদা এবং তিনি খোদার পুত্র। কিন্তু তিনি মারিয়াম (সা.)'র পুত্র। ঈসা (আ.) আল্লাহর এমন এক সৃষ্টি যিনি আল্লাহর অসীম ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ এজন্য তাঁকে আল্লাহর কথা বা নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন। সূরা কাহাফের ১০৯ নম্বর আয়াতেও আল্লাহ তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে তাঁর কথা বা বাণী বলে উল্লেখ করেছেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : ফেরেশতারা আল্লাহর নবী রাসুল ছাড়াও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সৎ বান্দাদের সঙ্গে কথা বলেন।

দ্বিতীয়ত : যদিও হযরত ঈসা (আ.) পিতা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছেন,তবুও তিনি আল্লাহর পুত্র নন। তিনি মারিয়ামের পুত্র। কারণ,ঈসা (আ.) ভ্রুণ অবস্থায় তাঁর মা মারিয়ামের গর্ভে ছিলেন।

সূরা আলে-ইমরানের ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন,

وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ (৪৬)

"মারিয়ামকে যে সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হলো,সে দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে এবং সে হবে পূণ্যবানদের একজন।" (৩:৪৬)

মারিয়াম (সা.) সন্তান লাভের সুসংবাদ শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারণ,স্বামী ছাড়া সন্তান লাভের কারণে মানুষ তাঁকে অপবিত্র বলে অপবাদ দিতে পারে । তাই ফেরেশতারা মারিয়ামকে বললেন,আল্লাহ আপনার সতীত্বের প্রমাণ হিসেবে নবজাতক শিশুর মুখে ভাষা দেবেন এবং নবজাতক শিশু ঈসা (আ.) আপনার বিরূদ্ধে যে কোন অপবাদ খণ্ডন করবে। নবজাতক শিশু ঈসা (আ.) বড়দের মত এখন যুক্তিপূর্ণ স্পষ্ট ও কার্যকরভাবে বক্তব্য রাখেন যে,সবাই অবাক হয়ে যায় এবং সবাই আল্লাহর এ মোজেজা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রত্যক্ষ করল।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হলো,

প্রথমত : আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপারে সন্দেহ করা উচিত নয়। যে আল্লাহ স্বামী ছাড়াই মারিয়ামকে সন্তান দিতে পারেন,সেই আল্লাহ নবজাতক শিশুর মুখেও ভাষা দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত : যদি মা পূণ্যবান এবং যোগ্যতাসম্পন্ন হয়,তাহলে তাঁর সন্তানেরও যোগ্যতার ভিত্তি বা পটভূমিও তৈরি হয়ে থাকে।

সূরা আলে ইমরানের ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَتْ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ قَالَ كَذَلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (৪৭)

"মারিয়াম বলেছিলেন,কিভাবে আমার পুত্র হবে? কোন পুরুষ তো আমাকে স্পর্শ করেনি। তখন আল্লাহ বললেন,এইভাবে আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন,যখন তিনি কোন কাজের সিদ্ধান্ত নেন,তখন তিনি বলেন ‘হও'আর তখনই তা হয়ে যায়।" (৩:৪৭)

স্বামী না থাকা সত্ত্বেও সন্তান লাভের সুসংবাদ পেয়ে মারিয়াম (সা.)'র মনে এ প্রশ্ন জাগে যে,স্বামী ছাড়া কীভাবে সন্তান লাভ সম্ভব হতে পারে? কারণ,বিশ্ব সৃষ্টি কার্যকারণের ওপর নির্ভরশীল এবং কোন কিছু সৃষ্টির জন্য এক ধরনের ওসিলা তথা উপাদান বা চালিকাশক্তির দরকার হয়। আল্লাহ তাঁর এই স্বাভাবিক জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছেন ফেরেশতাদের দিয়ে। ফেরেশতারা তাঁকে জানালো প্রকৃতি জগতও আল্লাহর সৃষ্টি এবং প্রকৃতিও আল্লাহর নির্দেশ মানতে বাধ্য। আল্লাহর কৌশলী শক্তি এমন যে যখন তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা করেন,তখন প্রকৃতির নিয়ম ও উপাদান ছাড়াই তা সৃষ্টি করেন। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহর সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মূলনীতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে,আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন,তা কোন সময় বা প্রাকৃতিক কোনো নিয়ম ছাড়াই হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঠিক এমন যেন,কেউ কোন কিছু তৈরির ইচ্ছা প্রকাশ করে শুধু বলল ‘হও' আর অমনি তা হয়ে যায়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,সৃষ্টির ক্ষেত্রে আল্লাহ কোন নিয়মের অধীন নন। তিনি প্রাকৃতিক উপায়ে এবং অপ্রাকৃতিকভাবেও যে কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)