আল হাসানাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান শাহাদাতের লক্ষ্য

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

১০ মুহররম পবিত্র আশুরা। নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাথিদের ৭২ জন সদস্যের মহান শাহাদাত দিবস। ৬১ হিজরির এই দিনে ইমাম হোসাইন (আ.) ৫৭ বছর বয়সে তাঁর নানাজান মহানবী (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত প্রকৃত ইসলামকে রক্ষা করতে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন।

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ও হযরত ফাতেমা (আ.)-এর পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.)-কে মহানবী (সা.) জান্নাতে যুবকদের সর্দার বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘হোসাইন হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও নাজাতের তরী।’ অন্যদিকে আমীর মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযিদ ছিল দুশ্চরিত্র ও স্বৈরাচারী স্বভাবের লোক। জনসাধারণ তার এই চরিত্রের কথা জানত। জনঅসন্তোষ এড়াবার লক্ষ্যে মুয়াবিয়া জনগণকে আশ্বাস দেন যে,তিনি তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করবেন না। এ মর্মে তিনি ইমাম হাসানের সাথে একটি চুক্তি করেন। কিন্তু মুয়াবিয়া তাঁর মৃত্যুর আগে এ চুক্তি ভঙ্গ করেন ও ইয়াযিদকে নিজের উত্তরাধীকার ঘোষণা করেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ইয়াযিদ ইসলামের সনাতন সংস্কৃতিকে বদলে দিয়ে বাদশাহী কায়দায় সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায়ই সে নিজেকে মুসলমানদের খলিফা ঘোষণা করে ও ঈমানদারদের বাইআত দাবি করে। ইয়াযিদ তার পথকে নিষ্টণ্টক করার জন্য লোভ ও হুমকি প্রদান করে একে একে মক্কা ও মদীনার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পদানত করে সর্বশেষে ইমাম হোসাইনের দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মতো একজন ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই ইয়াযিদের মতো একজন মানুষের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেননি। মহানবী (সা.)-এর সুযোগ্য উত্তরাধিকার হোসাইন তাঁর ইমামতের প্রজ্ঞায় সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট এক কালজয়ী পথ রচনা করেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে,ন্যায়ের প্রতিভূ ইমাম হোসাইন ও অন্যায়ের প্রতিভূ ইয়াযিদ,এ দু’য়ের কারও পথ ও কর্মকৌশলে লক্ষ্যহীন ও অপরিকল্পিত ছিল না। জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইনের প্রতিপক্ষ ইয়াযিদ শুধু শক্তিবলেই বলশালী ছিল না;বরং উত্তরাধীকার সূত্রে তার পক্ষে ছিল উমাইয়াদের কূটকৌশল,বুদ্ধিমত্তা ও সমগ্র অপকৌশলের এক সমন্বিত অস্ত্রমালা। তার সেসকল অস্ত্রের কোনটিই সে প্রয়োগ করতে বাদ রাখনি।

অপরপক্ষে ইমাম হোসাইন মুসলিম উম্মাহর হাদী হিসেবে তাঁর হেদায়েত প্রদানের কর্মসূচি ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ’ অব্যাহত রাখেন। ইয়াযিদ চক্র তাঁর নানা মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বীনের মাঝে যে বিকৃতি সাধনের চেষ্টা চালাচ্ছে তা জনসমক্ষে একে একে তুলে ধরতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় বিষয় হল ইমামের কর্মকৌশল। তিনি তাঁর কর্মসূচি জারি রাখতে ও শত্রুকে ফাঁদ পাতার সুযোগ না দিতে সবরকম চেষ্টা চালান। তাঁর লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিনি প্রতিশ্রুত শাহাদাতের পূর্বেই গোটা উম্মাহর সর্বাধিক সংখ্যক জনপদের মানুষকে ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়টি পরিষ্কার করে যাবেন। ইয়াযিদ মদীনার গভর্নর ওয়ালিদকে হুকুম দিল ইমামকে আটক করে দামেস্কে ইয়াযিদের দরবারে পাঠিয়ে দিতে; উদ্দেশ্য ইমামকে ইয়াযিদের কাছে বাইআত হতে বাধ্য করা। আর তার পরই গোটা উম্মাহর মাঝে প্রচার করা হবে যে,মহানবীর দৌহিত্র হোসাইনও ইয়াযিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

যথারীতি ওয়ালিদ যখন ইমাম হোসাইনকে তার দরবারে আহ্বান করল ইমাম তখন ৩০ জন সশস্ত্র যুবককে সাথে নিয়ে ওয়ালিদের দরবারে গিয়ে তাঁর ইয়াযিদের কাছে বাইআত না হওয়া সংক্রান্ত কথাগুলো বলে ওয়ালিদ কর্তৃক তাঁকে গ্রেপ্তারের কোন সুযোগ না দিয়ে মাসজিদে নববীতে ফিরে আসেন। অর্থাৎ তিনি স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার বরণ করে তাঁর কর্মসূচি বন্ধ করেননি। আবার একইভাবে সেই রাতে মদীনায় অবস্থান না করে ৬০ হিজরির ২৭ রজব মক্কার দিকে রওয়ানা করেন। আর ইমাম যে মক্কায় চলে যাবেন তাও আগাম ঘোষণা দেননি। মক্কায় তখন হজ্বের প্রস্তুতি চলছে। হজ্ব মানে মক্কায় তখন বিশ্ব মুসলিমের বিপুল সমাবেশ। মুসলিম উম্মাহর সকল জনপদ থেকে লোকেরা যখন মক্কায় আসল তখন এই বৃহত্তর পরিসরে ইমাম তাঁর কথাগুলো তুলে ধরলেন। পাপিষ্ঠ স্বৈরাচারী ইয়াযিদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড ও উম্মাহকে ধীরে ধীরে জাহেলী যুগে ফিরিয়ে নেয়ার আলামত তুলে ধরলেন। ইমাম বললেন,‘তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে,সত্যকে অনুসরণ করা হচ্ছে না। তোমরা কি দেখতে পাও না যে,চারদিক ফেতনা-ফ্যাসাদে ছেয়ে গেছে,অথচ কেউ এর প্রতিবাদ করছে না? হে লোকসকল! এই পরিস্থিতিতে আমি মৃত্যুবরণকে কল্যাণ ও মর্যাদাকর ছাড়া আর কিছুই মনে করি না।’ (তুহাফুল উকুল,২৪৫)

এর মাঝে ইমামের সতর্ক সাথিরা টের পেলেন যে,ইয়াযিদের গুপ্তচররা হাজীবেশে এহরামের কাপড়ের আড়ালে অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে ইমামকে গুপ্তহত্যা করতে। এবার ইমাম হাজীদের উদ্দেশে তাঁর কথাবার্তা সেরে হজ্বের একদিন আগে মক্কা ছেড়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ইমামের মক্কা ছেড়ে যাবার উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন আরো মুসলিম জনপদসমূহে তাঁর সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়া। তাছাড়া মক্কার হারাম শরিফ রক্তাক্ত হোক তিনি তা চাননি। মদীনা থেকে মক্কায়,মক্কা থেকে কুফায় বিভিন্ন মঞ্জিলে বিভিন্ন জনপদে তিনি বক্তব্য রাখেন। ইমাম হোসাইন বলেন,‘আমি কোনো ধন-সম্পদ বা ক্ষমতার লোভে কিংবা গোলযোগ সৃষ্টির জন্য কিয়াম করছি না,আমি শুধু আমার নানাজানের উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই। আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে চাই এবং আমার নানাজান যে পথে চলেছেন আমিও সে পথে চলতে চাই।’ (মাকতালু খারযামী : ১/১৮৮)

ইমাম আরো বলেন,‘ইয়াযিদের মত কোন ব্যক্তি যদি ইসলামের রক্ষক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের পরিসমাপ্তি।’

ইতঃপূর্বে কুফার হাজার হাজার লোক ইমামকে চিঠি দিয়েছিল,ইয়াযিদের অপশাসন ও তার গভর্নরের অত্যাচার থেকে উম্মাহকে মুক্তি দিতে ইমামের নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে,যদিও তাদের অধিকাংশই কথার ওপর অটল থাকতে পারেনি। তবে ইমাম হিসেবে নিপীড়িত জনগণের ডাকে সাড়া দেয়া ইমামের দায়িত্ব ছিল।

তখন কুফা ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর। কুফাতে আহলে বাইতের অনুসারীও ছিল প্রচুর। ইমাম হোসাইনের কুফার পথে গমনের সম্ভাবনা জেনে ইয়াযিদ তখন অত্যন্ত নির্দয় স্বভাবের ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে কুফার গভর্নর নিয়োগ করে। নিষ্ঠুর ওবায়দুল্লাহ কঠোর হস্তে কুফার বিদ্রোহ দমন করে। ইমাম আর কুফায় প্রবেশের সুযোগ পাননি। ইমাম হোসাইন ইতঃপূর্বে যে দু’জন দূত কুফায় প্রেরণ করেন সেই বিখ্যাত কায়েস ইবনে মুসাহ্হার ও মুসলিম বিন আকিল উভয়কেই নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহীর নেতৃত্বে অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে ইমাম হোসেইনের পথরোধ করা হয়। পরবর্তী ঘটনা সবারই জানা। পথিমধ্যে কারবালার বিজন মরুভূমিতে ইমামের কাফেলাকে অবরুদ্ধ করা হয়। শর্ত দেয়া হয় যে,হয় ইয়াযিদের হাতে বাইআত হতে হবে,না হয় যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করতে হবে।

ইয়াযিদ দরবারের এটিই লক্ষ্য ছিল যে,ইমাম হোসাইনকে জনমানবহীন মরুভূমিতে হত্যা করা যেন পরবর্তীকালে যে কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে দেয়া সম্ভব হয়,হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যায়। রাসুল (সা.)-এর নাতিকে হত্যা করার পরিকল্পনা তো যেনতেন পরিকল্পনা হওয়ার কথা নয়। পরবর্তীকালে আমরা ইয়াযিদের কণ্ঠে এরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। নির্দেশমাফিক ইমাম হোসাইনের শির মোবারক যখন ইয়াযিদের দরবারে নেয়া হয় সে তখন বলেছিল,ইবনে যিয়াদের ওপর আল্লাহর লানত,সে একাজ করেছে। আমি থাকলে এমনটি হতো না। অবশ্য হুসাইন ও বাড়াবাড়ি করেছিল (নাউযুবিল্লাহ) ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিহাস সাক্ষী যে,ইবনে যিয়াদকে ইয়াযিদ কোনো শাস্তিই দেয়নি। সাইয়্যেদ ইবনে তাউসসহ বড় বড় লেখকদের লেখা থেকে জানা যায় যে,এই ঘটনার পর ইবনে যিয়াদ ও ইয়াযিদের দরবারে যারা (রোমের খ্রিস্টান দূতসহ) এ অন্যায়ের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাদের সবাইকেই হত্যা করা হয়েছিল। সকল ইতিহাস লেখকের লেখা থেকে জানা যায় যে,কারবালায় ইমাম হোসাইনসহ ৭২ জনকে শহীদ করে তাঁদের শিরমোবারক দেহ থেকে বিছিন্ন করে বর্শার আগায় বিদ্ধ করে,নবীপরিবারের নারী-শিশুদের বন্দি করে দামেশকের পথে পথে অসম্মানজনভাবে ঘোরানো হয়। শহীদের লাশের ওপর ঘোড়া দাবরিয়ে পিষ্ট করা হয়।

এরপর মক্কা ও মদীনা আক্রমণ করে তিনদিন পর্যন্ত হত্যা,ধর্ষণ,লুটতরাজ চালানো হয়। এসব অত্যাচার কারবালার ঘটনার ব্যাপ্তিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বিবেকবান মানুষের জন্য ইয়াযিদী শাসনচরিত্র বুঝতে সহায়তা করে। এছাড়া ইমাম হোসাইন (আ.) যে নারী ও শিশুদেরকে তাঁর কাফেলাভুক্ত করেছিলেন তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশ্লেষকগণ বলেছেন যে,নবীপরিবারের বাকি সদস্যরা পরবর্তী জীবনভর কারবালার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আর এটিও স্পষ্ট হয় যে,যুদ্ধ করা ইমামের উদ্দেশ্য ছিল না,তাহলে তিনি নারী ও শিশুদের সাথে নিতেন না। তাছাড়া শত্রু শিবিরের সাধারণ সদস্যদের মাধ্যমেও কারবালার ময়দানের ঘটনা প্রবাহের বিরাট ইতিহাস বর্ণিত ও পরবর্তীকালে লিপিবদ্ধ হয়েছে। নবীপরিবারের সদস্যবৃন্দ ও শত্রু-শিবিরের প্রত্যশদর্শীদের বর্ণনায় ইতিহাস আমাদের কাছে পৌঁছেছে যা ইয়াযিদী শাসকের কাম্য ছিল না। ইমাম হোসাইনের কিয়াম,প্রচারণা,আন্দোলন,সর্তকবার্তা,সর্বোপরি শাহাদাত,নবীপরিবারের সদস্যদের বন্দিত্ববরণ,ইয়াতিম ও নিঃস্ব হওয়া এসব মজলুমিয়াত ইসলামকে বিকৃত করার ইয়ায়িদী প্রয়াসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।

প্রকৃত ইসলামকে রক্ষা করতে তাঁর শাহাদাতের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ইয়াযিদী রাজতান্ত্রিক ইসলাম যে প্রকৃত ইসলাম নয় বরং প্রকৃত ইসলামকে তার মূলে অর্থাৎ নবী,নবীপরিবার,নবীর সত্যনিষ্ঠ সাহাবী,পবিত্র কোরআনের মূল শিক্ষা ও দর্শনের কাছে খুঁজতে হবে সেই আকুতি ও আবেদন সৃষ্টি করেছে। ইমাম হোসাইন শাহাদাতের আগ মুহূর্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,‘হাল মিন্ নাছিরীন ইয়ানছুরুনী’ (কোন সাহায্যকারী কি আছ যে আমাকে সাহায্য করবে?)। এ আবেদন ইমামের জীবন রক্ষার জন্য নয়;বরং ইমামের দ্বীনকে রক্ষার আবেদন। অনাগত উম্মতের জন্য ইমাম যে আবেদন রেখে গেছেন তা ধাপে ধাপে সফল হচ্ছে। হোসাইনী পাঠ থেকে শিক্ষা নিতে মানুষ নতুন করে শপথ নিচ্ছে। মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাওহার যথার্থই বলেছেন, ইসলাম যিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কি বাদ’ (প্রতিটি কারবালার পরই ইসলাম পুনর্জীবন লাভ করে)।’

মদীনা থেকে মক্কা এবং মক্কা থেকে কুফা অভিমুখে যাত্রা,পথিমধ্যে ইমাম কাফেলাকে কারবালার দিকে অবরুদ্ধ করা ও শেষ পর্যন্ত ইয়াযিদের হাতে বাইআত না করার কারণ দর্শিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা এবং সপরিবারে শহীদ করা,এ ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা অবহিত হলাম। এখন মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত ইমাম হোসাইনের এই মিশনে তিনি যেসব বাণী দিয়েছেন যার সামান্য কিছু এই প্রবন্ধে পরিবেশিত হয়েছে তার মাঝেই খুঁজতে হবে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের লক্ষ্য।

এর পাশাপাশি আমরা বলতে চাই যে,ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা ছিল ইয়াযিদ ও তার দরবারের উমাইয়্যা কূটনীতিকদের পরিকল্পনার প্রথম অংশ। দ্বিতীয় অংশটি হলো এই মহাঘটনাকে ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন অপব্যাখ্যা সম্বলিত ধারণার ডালপালা বিস্তার করা। যেন এই নানামুখী ব্যাখ্যায় আসল বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে যেসব ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে তার কিছুটা তুলে ধরছি।

১. হোসাইনের নিহত ও পরাজিত হওয়া (নাউযুবিল্লাহ) তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল,এটি আল্লাহরই ইচ্ছা (!)। আর ইয়াযিদ বিজয়ী হবে সেটিও ছিল আল্লাহর ইচ্ছা। ইয়াযিদের দরবারে নবী-পরিবারকে বন্দি করা অবস্থায় হযরত যয়নাবের (সালামুল্লাহি আলাইহা) সাথে কথোপকথনের সময় ইয়াযিদ স্বয়ং এ কথা বলেছিল।

২. কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ইমাম হোসাইনকে হত্যা করেছে। ইয়াযিদের এরকম কোন পরিকল্পনা ছিল না। ইয়াযিদ তার দরবারে ইমাম হোসাইনের শির মোবারকের ওপর একটি লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে বলছিল,‘ইবনে যিয়াদের ওপর আল্লাহর লানত। সে হোসাইনকে হত্যা করেছে। অবশ্য হোসাইন বাড়াবাড়ি করেছিল।’ অথচ সকল ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেছেন যে,শুরু থেকেই ইমাম হোসাইনকে ইয়াযিদের বাইআতে বাধ্য করা,না হয় হত্যা করে মস্তক প্রেরণ করা সম্বলিত ইয়াযিদের ফরমান জারি করা ছিল। ঘটনা সংঘটনের পর সে ভিন্ন সুরে কথা বলে নিজের সংশ্লিষ্টতা না থাকার বাহানা করে। আর ইতিহাস সাক্ষী যে,সে এই হত্যাকাণ্ডের নায়কদের কোন শাস্তি দেয় নি;বরং পুরস্কৃত করেছিল।

৩. একদল এমনও ব্যাখ্যা দাঁড় করায় যে,ইমাম হোসাইন খুব শাহাদাতপিয়াসী ছিলেন। যেহেতু শহীদের মৃত্যু খুব মর্যাদাকর,তাই তিনি চাচ্ছিলেন যে,তাঁর মৃত্যু যেন শাহাদাতের মাধ্যমে হয়। নিছক এই কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এমনকি বলা হয় যে,ইমাম হোসাইন পথ ভুলে এক জায়গায় হাজির হন। পরে জানতে পারেন এ স্থানের নাম কারবালা। প্রশ্ন হলো,ইমাম হোসাইন কি লক্ষ্যহীনভাবে,পরিকল্পনাবিহীন,কোনো কৌশলগত কর্মসূচিবিহীন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন? মদীনা থেকে কারবালায় ইমাম হোসাইনের সুপরিকল্পিত সফর,কিয়াম ও বক্তব্য এবং সবশেষে ৭১ জন সঙ্গীর শাহাদাতের পর নিজের শহীদ হওয়া থেকে কি এই লক্ষ্যহীনতা বোঝা যায়? তিনি তো কাউকে ময়দানে না পাঠিয়ে শুধু নিজেকে সঁপে দিয়ে বলতে পারতেন,‘তোমরা তো আমার মস্তক চাচ্ছ,তাহলে আমাকে হত্যা করে তা ইয়াযিদের দরবারে পাঠিয়ে দাও!’ নিজেই বা যুদ্ধ করলেন কেন? ৭১ জন শহীদ হওয়ার প্রমাণ রাখলেন কেন? নারী-শিশুদের বন্দি হতে দিলেন কেন? তাদের তো যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য না দেখিয়ে আগাম মদীনায় পাঠিয়ে দিতে পারতেন।

৪. আরেকটি ব্যাখ্যা বহুল প্রচলিত। যে ব্যাখ্যায় এমনভাবে চিত্রিত করা হয় যে,ইমাম হোসাইন যেহেতু সে সময়ের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন,আমীর মুআবিয়ার সাথে ইতঃপূর্বে ইমাম হাসানের সম্পাদিত চুক্তিমাফিকও মুআবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম হোসাইনের খলিফা হওয়ার কথা ছিল,তাই ইমাম হোসাইন খিলাফত লাভের আকাঙ্ক্ষা করতেন। সেজন্যই তিনি কিয়াম করেছিলেন,বিদ্রোহ করেছিলেন। আর এ ব্যাখ্যায় এটিও বলা হয় যে,এটি ছিল ক্ষমতার লড়াই। তবে এটি ছিল ইমাম হোসাইনের রাজনৈতিক ভুল বা ইজতিহাদী ভুল। কারণ,ময়দান ইমামের জন্য অনুকূল ছিল না। কুফাবাসীরা যে ইমামকে আশ্বাস দিয়েছিল তা ছিল ধোঁকা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা বলে যে,কোনোভাবেই ইমাম হোসাইন ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হননি। এ ধরনের কোন আলামতই ইমামের তৎপরতা থেকে প্রকাশিত হয় নি। ইমাম মদীনা,মক্কা,কুফার পথে যেতে যেতে জনগণকে কেবলই প্রকৃত ইসলামের কাছে ফিরে আসার জন্য নসিহত করছিলেন। আর তাঁর এই সফরকালে তাঁর সঙ্গী ছিল নারী,শিশু ও ঘনিষ্ঠ কিছু লোকজন। ইমাম যদি ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আবির্ভূত হতেন তাহলে তিনি নারী-শিশুদের সাথে নিতেন না। তৎকালীন কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বসরা,কুফা ইত্যাদি শহরে তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করতেন। কিন্তু না। প্রকৃত ঘটনা হলো ইমাম যেখানেই যাচ্ছিলেন ইয়াযিদের লোকজন তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল ও ইয়াযিদের হাতে বাইআত হতে চাপ দিচ্ছিল। অবশেষে কারবালার ফোরাতকূলে পানি না দিয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় ইমাম পরিবারের বিরুদ্ধে ৩০ হাজার সুসজ্জিত সেনা পাঠিয়ে ইমাম হোসাইন (আ.) সহ ৭২ জনকে শহীদ করে।

৫. সুফিবাদী কিছু দল বলে থাকে যে,ইমাম হোসাইন তাঁর নানার উম্মতের গোনাহ মাফ বা পাপমোচনের জন্য শহীদ হয়েছেন। তারা একটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করে। হযরত ফাতেমা যখন বাবার উম্মতের গোনাহের কথা চিন্তা করে তাদের নাজাতের জন্য কান্নাকাটি করতেন তখন তাঁকে জানানো হলো,যদি আপনার কোনো সন্তানকে কোরবানি করতে রাজি থাকেন তাহলে উম্মত নাজাত পেতে পারে। হযরত ফাতেমা তা সানন্দে মেনে নেন। পরবর্তীকালে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের মাধ্যমে সেটাই ঘটেছিল। এ ব্যাখ্যা হলো খ্রিস্টবাদের ইসলামী সংস্করণ। খ্রিস্টানরা যেমন মনে করে যে,নবী ঈসা (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হয়ে উম্মতের পাপ নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন তাই ঈসাকে পূজা করলে,ভালোবাসলে উম্মত নাজাত পাবে,একইভাবে এরাও ইমাম হোসাইনের শাহাদাতকে কল্পনা করে,যা নিতান্তই ভ্রান্ত একটি ধারণা।

প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইন তাঁর নানা মহানবী (সা.)-এর দীনকে অবিকৃত রাখতে,উম্মতকে সংশোধন করার কর্মসূচি জারি রাখতে ও ইয়াযিদের পক্ষে বাইআত করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে অনিবার্য পরিণতিতে শাহাদাত বরণ করেন। (রেডিও তেহরান)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)