আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আলে ইমরান;(২৩তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১২১-১২৫

সূরা আলে ইমরানের ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ غَدَوْتَ مِنْ أَهْلِكَ تُبَوِّئُ الْمُؤْمِنِينَ مَقَاعِدَ لِلْقِتَالِ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ((১২১

"হে নবী! স্মরণ করুন সে সময়ের কথা,যখন মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে ভোরবেলা ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। আল্লাহ সব কিছু শোনেন এবং জানেন।" (৩:১২১)

এই আয়াত দিয়ে ঐতিহাসিক ওহুদ যুদ্ধের তিক্ততা সংক্রান্ত আয়াত শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরিতে মক্কার কাছে সংঘটিত বদর যুদ্ধে বহু মুশরিক নিহত ও বন্দী হয়েছিল। এই যুদ্ধের পরপরই কোরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বলেছিল,মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত শান্ত হব না। আবু সুফিয়ানের কথামত পরের বছরই মুশরিকরা পদাতিক ও অশ্বারোহী সেনার এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে রওনা হয়। শত্রুদের এই অভিযানের কথা শুনে রাসূলে খোদা তাঁর সাহাবীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং শত্রুদের মোকাবেলার ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ চান। বৃদ্ধ ও বয়স্করা শহরে থেকে নিজ নিজ ঘরকে দূর্গ বানিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু উদ্যমী যুবকরা মদীনার বাইরে গিয়ে সাহসিকতার সাথে শত্রুদের মোকাবেলা করতে রাসূলের অনুমতি চাইলেন। মহানবী (সঃ) যুবকদের আবেদনের ব্যাপারে সবার মতামত চাইলে অধিকাংশ সাহাবীই যুবকদের পক্ষে মত দিলেন। রাসূল (সঃ) নিজেও মদীনা শহরে থেকে যুদ্ধ করার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুবক সাহাবীদের পবিত্র আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও তাদের পক্ষে রায় দিলেন। এরপর মহানবী (সঃ) জুমার নামাজের খোতবায় জনগণের সামনে সব খুলে বলেন। নামাজ শেষে তিনি মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে মোট এক হাজার সাহাবী নিয়ে শত্রু মোকাবেলার জন্য ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত যুদ্ধের ময়দানের দিকে রওনা হলেন। যারা শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক ছিল,তাদের মধ্যে একদল মদীনায় ফিরে আসে। ফলে মুসলিম মুজাহিদদের সংখ্যা কমে গিয়ে ৭০০-তে দাঁড়াল।

অপরদিকে শত্রুরা মদীনার কাছে পৌঁছল এবং কাফের ও মুসলিম বাহিনী পরস্পরের মোকাবেলায় সারিবদ্ধ হল। কাফেররা বাঁশী ও ঢোল বাজিয়ে এবং মুসলমানরা 'আল্লাহু আকবর' বা 'আল্লাহ-ই শ্রেষ্ঠ'ধ্বনি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। মুসলমানদের ক্ষিপ্র ও প্রচণ্ড হামলায় কুরাইশরা ছিন্নভিন্ন হয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। একদল মুসলমান রাসূল (সঃ)'র পক্ষ থেকে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কাফেররা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছে ভেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ গিরি পথের প্রহরা ত্যাগ করে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়। শত্রুরা এই সুযোগে পেছন দিক থেকে প্রচণ্ড হামলা চালায়। ফলে অনেক মুসলমান শহীদ ও আহত হয় এবং অনেকে পালিয়ে যায়। রাসূল (সঃ) নিজে শহীদ হয়েছেন এমন গুজব মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে পলাতক মুসলমানদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এভাবে মুসলমানদের জয়,পরাজয়ে রূপান্তরিত হয় এবং নেতার নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি সম্পর্কে মুসলমানরা শিক্ষা লাভ করে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : শুধুমাত্র আল্লাহর বিধান প্রচার করাই রাসূলের দায়িত্ব ছিল না। আল্লাহর বিধানের বাস্তবায়ন এবং ধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও তাঁর দায়িত্ব ছিল। তাই,মুসলমানদেরকেও শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন করলেই চলবে না। ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজকে রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালানো সমস্ত মুসলমানেরই দায়িত্ব।

দ্বিতীয়ত : পরিবার পরিচালনা এবং সন্তান ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলেও ধর্ম রক্ষা করা পরিবার রক্ষার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

সূরা আলে ইমরানের ১২২ ও ১২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


إِذْ هَمَّتْ طَائِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلَا وَاللَّهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ (১২২) وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ  (১২৩)

"যখন তোমাদের দু'টি দল সাহস হারাবার উপক্রম হলো,অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন,আর আল্লাহর উপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত।"(৩:১২২)

"বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে,আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন। অতএব আল্লাহকে ভয় কর। হয়তো তোমরা কৃতজ্ঞ হবে।" (৩:১২৩)

আওস ও খাজরাজ গোত্রের মুসলমানরা নবীজীর সাথে মদীনা থেকে বের হবার পর শত্রুদের বিশাল বাহিনী দেখে ভয় পেয়েছিল। পরামর্শ সভায় রাসূল (সঃ) তাদের পরামর্শকে গ্রহণ করেননি,এই অজুহাতে তারা যুদ্ধ থেকে ফিরে যাবার চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে ও রাসূল (সঃ)'র কথা শুনে তারা ফিরে যাবার ইচ্ছে ত্যাগ করে এবং এভাবে শয়তানের ফাঁদ এড়াতে সক্ষম হয়। এই দুই আয়াতে এইসব মুসলমান ও অন্যান্য মুসলমানদের বলা হচ্ছে,তোমরা তো বদর যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য দেখেছ। তোমাদের জনবল ও অস্ত্র খুব কম থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ শক্তিশালী শত্রুর মোকাবেলায় তোমাদেরকেই জয়ী করেছেন। তাই এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসে কেন হতাশ হচ্ছো এবং নিজ ধর্ম রক্ষার জন্য কেন কঠোর ও দৃঢ়তর হচ্ছো না? শত্রুকে ভয় পেয়ো না বরং আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের ব্যাপারে ভয় রাখ। আল্লাহ ছাড়া আর কারো ওপর ভরসা করো না। আর এভাবেই তোমরা আল্লাহর দয়ার ব্যাপারে কৃতজ্ঞ হতে পারবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,


প্রথমত : মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সহায়হীন অবস্থায় ছেড়ে দেন না বরং তিনি মুমিনদেরকে নিজের ব্যবস্থায় শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেন।


দ্বিতীয়ত : যুদ্ধের ভয় মানুষকে হতাশ হতে ও পালাতে উৎসাহ যোগায়। এর ঔষধ হলো,আল্লাহর ওপর ঈমান রাখা ও তাঁরই দয়ার ওপর নির্ভর করা।


তৃতীয়ত : আল্লাহ শুধু আমাদের কাজ সম্পর্কেই জানেন তা নয়,আমাদের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যও তিনি জানেন। আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে যুদ্ধ থেকে ফিরে যাবার ব্যাপারে কোন কোন মুসলমানের মনের কথা রাসূল (সঃ) কে জানিয়ে দিলেন।


চতুর্থত : খোদায়ী সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় হলো খোদাভীরু ও সংযমী হওয়া। তা না হলে যুদ্ধে পরাজয় ও লাঞ্ছনা অনিবার্য।

 

সূরা আলে ইমরানের ১২৪ ও ১২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-


إِذْ تَقُولُ لِلْمُؤْمِنِينَ أَلَنْ يَكْفِيَكُمْ أَنْ يُمِدَّكُمْ رَبُّكُمْ بِثَلَاثَةِ آَلَافٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُنْزَلِينَ (১২৪) بَلَى إِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا وَيَأْتُوكُمْ مِنْ فَوْرِهِمْ هَذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُمْ بِخَمْسَةِ آَلَافٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُسَوِّمِينَ ( (১২৫

 

"হে নবী! স্মরণ করুন যখন আপনি বিশ্বাসীগণকে বলেছিলেন,এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে,তোমাদের প্রতিপালক তিন হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন?" (৩:১২৪)

"হ্যাঁ! নিশ্চয়ই,যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও সংযমী হও এবং যদি তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে,তবে তোমাদের প্রতিপালক পাঁচ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।" (৩:১২৫)


এই দুই আয়াতে খোদায়ী সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের মোকাবেলায় ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করার অঙ্গীকারের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে মানুষ জড় জগতের অধিবাসী বলেই অজড় অস্তিত্বের অধিকারী ফেরেশতাদের চিনতে পারে না। কিন্তু কোরআনের প্রতি বিশ্বাসের কারণে আমরা ফেরেশতাদের অস্তিত্ব বিশ্বাস করি। ওহুদ যুদ্ধে ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ মুসলমান মুজাহিদদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এরফলে মুসলমানদের বিপুল সংখ্যা শত্রুদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,


প্রথমত : মুমিনদেরকে অবশ্যই আল্লাহর ওপর নির্ভর করা উচিত। কারণ,ফেরেশতাসহ আল্লাহর সমস্ত বাহিনী মুমিনদের সহযোগী। ইসলামের শত্রুদেরও ইসলামের মোকাবেলার ব্যাপারে ভয় করা উচিত। কারণ,এর ফলে তারা তো মুসলমানদের নয়,বরং আল্লাহরই মোকাবেলা করছে।
দ্বিতীয়ত : খোদায়ী বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী মানুষের জীবন ফেরেশতাদের সাথে সম্পর্কিত।
তৃতীয়ত : মুজাহিদরা প্রতিরোধের ব্যাপারে সুদৃঢ় হলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য অদৃশ্য সাহায্য পৌঁছে।


চতুর্থত : যুদ্ধের ময়দানেও আল্লাহকে ভয় করা জরুরী। মুসলিম যোদ্ধাদেরকে সব সময়ই সংযমী ও খোদাভীরু হতে হবে।


পঞ্চম শিক্ষা : আল্লাহর ফেরেশতারা সৃষ্টি জগতের কর্মচারী । তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন দল বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব পালন করে। তাঁদের একদল মুসলিম মুজাহিদদের সাহায্য করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)