আল হাসানাইন (আ.)

মধ্যপন্থা অবলম্বন

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

যেহেতু সঠিক ইসলামী জীবনের ভিত্তি মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং ভারসাম্যের ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়েছে,এ জন্যই ইসলাম ধর্মের পবিত্র বিধি-বিধানে কোন অবস্থাতেই ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা বিস্মৃত হয়নি,এমনকি ব্যক্তিগত দৈনন্দিন ব্যয়ের ব্যাপারেও ইসলাম ধর্ম সবাইকে সতর্ক ও সাবধান করেছে :

و الذين إذا انفقوا لم يسرفوا و لم يقتروا و كان بين ذلك قواماً

“এবং তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না আবার কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।”

নিঃসন্দেহে অপব্যয় ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দিত এবং মানুষের একটি অতি বড় দোষ বলে গণ্য।

ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন,“পূর্ণতা কেবল তিনটি বিষয়ে রয়েছে,অতঃপর তৃতীয়টি জীবন যাপনের ক্ষেত্রে হিসাব-নিকাশ।”

ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন,

ما خير في رجل لا يقتصد في معيشة ما يصلح لا لدنياه ولا لآخرته

“যে ব্যক্তি জীবন যাপনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে না তার মধ্যে আসলেই কোন কল্যাণ নেই;কারণ এটি না তার পার্থিব জীবনের জন্য উপকারী আর না তার আখেরাতের জন্য উপকারী।”

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

و لا تبذر تبذيراً إنَّ المبذيرين كانوا إخوان الشياطين

“তোমরা অপব্যয় কর না,কারণ অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।”

দয়া-দাক্ষিণ্য করে খোটা দেয়া থেকে বিরত থাকা

নিঃসন্দেহে এত গুরুত্ব ও তাগিদ যা দান ও ব্যয় করার ব্যাপারে দেয়া হয়েছে আসলে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এজন্য দেয়া হয়েছে যে,অভাবগ্রস্ত ও দুঃস্থ লোকেরা যেন তাদের হৃদয়বিদারক অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে এবং তাদের আর্থিক প্রয়োজন ও চাহিদাসমূহ পূরণ হওয়ার মাধ্যমে তাদের মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা বিদূরিত হয়। আর দাতা ও ব্যয়কারী ব্যক্তিও যেন এ পবিত্র কাজের ফলস্বরূপ অধিকতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা অর্জন করে পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উপনীত হতে সক্ষম হয়।

কিন্তু দান ও উপকার করার পর যদি সেই দান ও উপকারের খোটা দেয়া হয় তাহলে তাতে যেমন একদিকে দান ও উপকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না;বরং ঐ সব ব্যক্তির আত্মার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে (উপকার করে খোটা দেয়ার কারণে যে সব ব্যক্তি উপকার পেয়েছে তাদেরকে তীব্র মানসিক আঘাতে জর্জরিত করে) ঠিক তেমনি অপরদিকে পরিষ্কার হয়ে যায়,এ কাজ (দান ও উপকার সাধন) আসলে মহান আল্লাহর জন্য করা হয় নি। অতএব,এমতাবস্থায় দাতা ও ব্যয়কারী কোন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হয় না।

পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াতে ব্যয় ও মহান আল্লাহর পথে দান করার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে এবং মানব জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এ বিষয়ের প্রতি যে,এ কাজ কেবল মহান আল্লাহর পথেই হওয়া উচিত এবং দান ও ব্যয় করে খোটা দেয়া অনুচিত।

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

الذين ينفقون أموالهم في سبيل اللهِ ثمّ لا يتبعون ما انفقوا منّاً و لا أذَىً لهم أجرهم عند ربّهم و لا خوف عليهم و لا هم يحزنون

“যারা তাদের নিজ অর্থ ও সম্পদ মহান আল্লাহর পথে ব্যয় করে অতঃপর তারা যা ব্যয় করেছে তা খোটা ও কষ্ট দেয়ার সাথে জড়িত করে না তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে তাদের পুরস্কার,তাদের কোন ভয় নেই এবং তাদের কোন দুঃখও নেই।”

এরপর পবিত্র কোরআনের দু’টি আয়াতে উপকার ও দান করে খোটা দেয়া পুণ্য ও দান-খয়রাতের সুফল নষ্ট হওয়ার কারণ বলে গণ্য করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ আমল এবং ঠিক এর উল্টো অবস্থার মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য নির্দেশ করে বলা হয়েছে :

يا أيّها الذين آمنوا لا تبطلوا صدقاتكم بالمن و الأذي كالذي ينفق ماله رياء الناس و لا يؤمن بالله و اليوم الآخر فمثله كمثل صفوانٍ عليه تراب فاصابه وابل فتركه صلداً لا يقدرون على شيء ممّا كسبوا و الله لا يهدي القوم الكافرين و مثل الذين ينفقون أموالهم إبتغاء مرضات الله و تثبيتاً من إنفسهم كمثل جنة بربوة أصابها وابل فاتت أكلها ضعفين فإنّ لم يصبها وابل فطلٌّ والله بما تعملون بصير

“হে ঈমানদারগণ,দান করে খোটা ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান ও সদকাসমূহ বরবাদ করে দিও না এ ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে (রিয়া বশত) ব্যয় করে এবং মহান আল্লাহ্ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব,এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হল,অনন্তর ঐ পাথরটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে দিল (যেন এর ওপর কোন মাটিই ছিল না)। তারা (রিয়াকারিগণ) যা কিছু অর্জন করে তার কোন ফল তারা পায় না। আর মহান আল্লাহ্ কাফের সম্প্রদায়কে পথ-প্রদর্শন করেন না। যারা মহান আল্লাহর পথে নিজ ধন-সম্পদ ব্যয় করে,মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং নিজেদের মনকে সুদৃঢ় করার জন্য-তাদের দৃষ্টান্ত টিলায় অবস্থিত উদ্যানের মত,যার ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করেছে। আর যদি প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়,তবে হালকা বৃষ্টিপাতই যথেষ্ট। আর মহান আল্লাহ্ তোমাদের কাজ-কর্ম যথার্থভাবে প্রত্যক্ষ করেন।

من أسدى إلى مؤمن معروفاً ثمّ آذاه بالكلام أو منّ عليه فقد أبطل الله صدقته

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি কোন মুমিনের উপকার করবে অতঃপর তাকে কথার মাধ্যমে কষ্ট অথবা খোটা দেবে মহান আল্লাহ্ তার দানকে বাতিল করে দেবেন।”

المنان بما يعطي لا يكلمه الله ولا ينظر إليه و لا يزكيه...

“যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয় সে যা দান করে সে ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ তার সাথে কোন কথা বলবেন না;তার প্রতি দৃষ্টি দেবেন না এবং তাকে পবিত্রও করবেন না...।”

এই উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে,যখন কেউ কাউকে কিছু দেবে তখন সে তাকে হীন-নীচ না ভাবে এবং তাকে সম্মান করে।

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,

إذا ناولتم السائل فليرد الذي ناوله يده إلى فيه فيقبله فإنّ الله عزّ و جلّ يأخذ الصدقات

“যখন তোমরা কোন ভিক্ষুককে কিছু দান করবে তখন তার হাত চুম্বন করবে। কারণ মহান আল্লাহ্ দান ও সদকাসমূহ গ্রহণ করেন।”

সম্ভবত এ কারণেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন মানুষ যতদূর সম্ভব দান-খয়রাত গোপনে করে।

قال رسول الله (ص) : سبعة يظلّلهم الله في ظلّه يوم لا ظلّ إلّا ظلّه (وعدّ منها) و رجلٌ تصدّق بصدقة فأخفاها حتّى لم تعلم يمينه ما تنفق شماله

মহানবী (সা.) বলেছেন,“মহান আল্লাহ্ সাত ধরনের মানুষকে তাঁর ছায়াতলে স্থান দেবেন ঐ দিবসে যে দিন কেবল তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কারো ছায়া থাকবে না। ঐ সাত ধরনের মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত যে দান করে তা গোপন রাখে,এমনকি তার বাম হাত কি দান করে তা তার ডান হাতও জানে না।”১০

তথ্যসূত্র

১. সূরা ফুরকান : ৬৭।

২.ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া।

৩.ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া,২য় খণ্ড,পৃ. ৫৩৪।

৪. সূরা বাকারাহ্ : ২৭।

৫. সূরা বাকারাহ্ : ২৬২।

৬. সূরা বাকারাহ্ : ২৬৪-২৬৫।

৭. ওসায়েলুশ্ শিয়া,২য় খণ্ড,পৃ. ৫৫।

৮. মাজমাউল বায়ান,সাইদা কর্তৃক মুদ্রিত,১ম খণ্ড,পৃ. ৩৭৫।

৯. জামেউস্ সায়াদাত,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩১।

১০. মাজমাউল বায়ান,১ম খণ্ড,পৃ. ৩৮৫।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)