আল হাসানাইন (আ.)

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-৬ষ্ঠ পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পিতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের খেলাফতকালে

হযরত উসমান নিহত হওয়ার পর আপামর মুসলিম জনসাধারণ অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে,হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দানে সক্ষম নয় এবং তাদেরকে সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার দিকে পরিচালিত করতে পারে না।

কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে তারা খুব বিলম্বে এটি বুঝতে পেরেছিল। আর তখন বক্রতা,কুঅভ্যাস,সুযোগ-সুবিধা ভোগ ও ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করার লিপ্সা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ এবং সমাজের ওপর কুপ্রভাব বিস্তার করেছিল। শাহাদাত বরণের আকাঙ্ক্ষা,সত্যের পথে আত্মোৎসর্গ,পার্থিব বিষয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা-এ সব সুকুমার গুণের স্থলে অর্থলিপ্সা,সুযোগ-সুবিধা ভোগ ও স্বার্থান্বেষণ,প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা,রাজনৈতিক দলাদলি ও নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি তখনকার মুসলিম সমাজে স্থান গেড়ে নিয়েছিল। ইমাম আলী (আ.) ইসলাম ধর্মে তাঁর সমুজ্জ্বল অবদান থাকা সত্ত্বেও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি প্রতিরোধ করে তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আনতে সক্ষম হননি। ইমাম আলী (আ.) যেহেতু ইসলাম ধর্মের ন্যায়পরায়ণতার দিকে আহ্বানকারী বিধানগুলো সমাজে প্রয়োগ করেছিলেন সেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতি দিন নব নব চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করা হতে থাকে। পরিস্থিতির এতটা মারাত্মক অবনতি হয় যে,এর ফলে মুসলিম বিশ্বে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী (নাকিসীন),খারেজী (মারিকীন) এবং জালেম (কাসিতীন)-এ তিন শ্রেণীর উদ্ভব হয়। উটের যুদ্ধ (জঙ্গে জামাল),সিফ্ফিনের যুদ্ধ ও নাহরাওয়ানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও সংঘটিত হয়। অবশেষে ইমাম আলীও কুফার মসজিদে ১৯ রমযানের প্রভাতে আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদী নামক এক খারেজীর হাতে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ২১ রমযান (৪৯ হি.) শাহাদাত বরণ করেন। এভাবে তিনি বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে তাঁর জীবন উৎসর্গ করলেন।

হযরত আলী (আ.)-এর হাতে জনগণের বাইআত

‘ইহ্তিজাজ’ নামক গ্রন্থে আল্লামা তাবারসী বর্ণনা করেছেন,যখন জনগণ ইমাম আলীর হাতে বাইআত করল তখন তিনি ইমাম হাসানকে বলেছিলেন,“দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দাও যাতে কুরাইশগণ আমার পরে তোমাকে ভুলে না যায়।”

ইমাম হাসান (আ.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা করার পর বলেছিলেন,“হে লোকসকল! আমার নানা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি : আমি জ্ঞানের নগরী এবং আলী তার দরজা। তাই কেবল দরজা ব্যতীত কি নগরীতে প্রবেশ করা সম্ভব?”

হযরত আলী (আ.) তখন ইমাম হাসানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর তিনি ইমাম হুসাইনের দিকে তাকিয়ে বললেন,“বৎস! তুমিও উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা কর যাতে করে কুরাইশরা আমার পরে তোমাকে ভুলে না যায়। আর তোমাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে,তোমার বক্তব্যও যেন তোমার ভাইয়ের বক্তব্যের অনুগামী হয়।”

এ কথা শুনে ইমাম হুসাইন (আ.) মিম্বরে দণ্ডায়মান হয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশধরদের ওপর দরুদ প্রেরণ করার পর বললেন,

معاش الناس سمعت رسول الله (ص) و هو یقول: إنّ علیّا هو مدینة هدی، فمن دخلها نجی و من تخلّف عنها هلك

“হে লোকসকল! আমি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি : নিশ্চয়ই আলীই হিদায়েতের নগরী;যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে তারাই সফলকাম হবে। আর যারা এ থেকে দূরে থাকবে (অর্থাৎ হেদায়েতের নগরীতে প্রবেশ করবে না) তারা ধ্বংস হবে।”

তখন হযরত আলী (আ.) উঠে দাঁড়িয়ে ইমাম হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন,

معاش النّاس اشهدوا أنّها فرخا رسول الله و ودیعته الّتی استودعهما و أنا أستودعکموا هما، معاش النّاس و رسول الله سائلکم عنها

 

“হে লোকসকল! তোমরা সাক্ষী থেকো যে,এরা দু’জন রাসূলুল্লাহর সন্তান এবং তাঁর আমানত যা তিনি তোমাদের কাছে রেখে গেছেন। আর আমিও তাদের দু’জনকে তোমাদের কাছে আমানতস্বরূপ রাখছি। হে লোকসকল! মহানবী তোমাদের সবাইকে এদের দু’জনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন।”

প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী,জালেম ও খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ

ইমাম হুসাইন (আ.) হযরত আলী (আ.)-এর অন্যান্য সন্তানের মতো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী,জালেম এবং খারেজীদের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধে পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সিফ্ফিনের যুদ্ধে যাত্রাকালে কুফাবাসীদের উদ্দেশে তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার পর যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা নিম্নে প্রদত্ত হলো : “হে কুফাবাসী! তোমরা সম্মানিত বন্ধু এবং তোমরা হচ্ছ অভ্যন্তরীণ পোশাক-তোমরা বহিরাবরণ নও। যে আগুন তোমাদের মাঝে প্রজ্বলিত হয়েছে তা নিভানো এবং অসমতলকে সমতল করার জন্য চেষ্টা চালাও। তোমরা জেনে রাখ যে,যুদ্ধের অপকারিতা ও ক্ষতিসাধন সত্যিই (মানুষকে প্রগতির পথ থেকে) বিরত রাখে ও বাধা প্রদান করে। আর এর স্বাদও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। যে ব্যক্তি যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুত করবে এবং যুদ্ধ বাধার আগেই যদি যুদ্ধের ক্ষতের ব্যথা চারিদিকে ছড়িয়ে না যায় তাহলে এ ধরনের ব্যক্তিই আসলে যোদ্ধা,তবে যে ব্যক্তি (এ ধরনের) সুযোগ আসার আগেই এবং নিজ কর্মতৎপরতা বিচক্ষণতার সাথে আঞ্জাম দেয়ার আগেই তাড়াহুড়া করে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয় তাহলে এ ধরনের ব্যক্তি নিজ জনগণের জন্য কোন কল্যাণ সাধন করতে পারে না,বরং নিজেকে ধ্বংস করে। আমরা এক অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন তিনি তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করার জন্য তোমাদেরকে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে সাহায্য করেন।

নাহরাওয়ান ও সিফ্ফিনের যুদ্ধে

সিফ্ফিনের যুদ্ধেও ইমাম হুসাইন (আ.) পিতার পক্ষে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। যদিও কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে মহানবী (সা.)-এর বংশধারা বিনষ্ট না হয় সেজন্য আলী (আ.) ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে যুদ্ধে যেতে দেননি। নাহজুল বালাগায় এ ব্যাপারে একটি হাদীস রয়েছে :

املکوا عنّی هذا الغلام فإنّی أنفس بهذین یعنی الحسن و الحسین لئلّا ینقطع بهما نسل رسول الله

“এ যুবককে (হাসানকে) যুদ্ধে গমন করা থেকে বাধা দাও। কারণ আমি এ দু’যুবকের (হাসান ও হুসাইন) মৃত্যুর ব্যাপারে বেশি ভয় পাচ্ছি যাতে মহান আল্লাহর রাসূলের বংশধারা নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়।”

আরো কতিপয় বর্ণনা রয়েছে যে,যুদ্ধে হযরত আলী (আ.) তাঁর অপর এক সন্তান মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াকে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতিরক্ষার জন্য ঢালস্বরূপ নিযুক্ত করেছিলেন। তাই এ ব্যাপারে যখন তাঁকে (ইবনে হানাফিয়া) জিজ্ঞেস করা হতো যে,আপনার পিতা হযরত আলী কেন আপনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেন,অথচ তিনি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে যুদ্ধে (প্রত্যক্ষ সমরে) যোগদান করার অনুমতি দিতেন না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলতেন,“সত্যিই এ দু’ভ্রাতা তাঁর নয়নমনি এবং আমি তাঁর ডান হাত। তাই তিনি তাঁর ডান হাতকে তাঁর চোখদ্বয়ের ঢালস্বরূপ ব্যবহার করতেন।”

মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার এ উত্তর তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.) এবং তাঁর দু’ভ্রাতার প্রতি তাঁর পূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধারই পরিচায়ক।

আব্বাস ইবনে বাক্কার নিজ সূত্রে ইবনে আব্বাসের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যে,সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলী (আ.) তাঁর সন্তান মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াকে ডেকে নির্দেশ দিলেন: “যাও,শত্রু বাহিনীর ডান বাহুর ওপর আক্রমণ চালাও।” মুহাম্মদ তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে শত্রুর সেনাবাহিনীর ডান বাহুকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেন;আর যখন আহত অবস্থায় মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া হযরত আলীর কাছে প্রত্যাবর্তন করে পিপাসা পিপাসা বলতে লাগলেন,তখন হযরত আলী তাঁর দিকে গেলেন এবং তাঁকে এক চুমুক পানি পান করালেন এবং কিছু পরিমাণ পানি তাঁর বর্ম ও দেহে ঢাললেন। ইবনে আব্বাস বলেন,“আমি যেন রক্তের ফোটাগুলো দেখতে পাচ্ছি যা তাঁর বর্ম থেকে বের হচ্ছিল। এরপর আলী (আ.) তাঁকে এক ঘণ্টা বিশ্রাম করার সুযোগ দিলেন। অতঃপর তাঁকে তিনি বললেন,“শত্রু বাহিনীর বাম অংশের ওপর আক্রমণ কর।”

মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে প্রথম বাবের মতো শত্রু বাহিনীর বাম বাহু বা অংশের ওপর আক্রমণ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। যেহেতু তিনি আহত ছিলেন তাই তিনি পিতার কাছে ফিরে এসে পানি পানি বলতে লাগলেন।

হযরত আলী উঠে দাঁড়িয়ে একই আচরণ করলেন (অর্থাৎ তিনি তাঁকে একটু পানি পান করালেন এবং অল্প পানি তাঁর বর্মের মধ্যে ঢাললেন)। এরপর তিনি তাঁকে বললেন,“শত্রু বাহিনীর মাঝ বরাবর আক্রমণ চালাও।”

মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া শত্রু বাহিনীর মাঝ বরাবর আক্রমণ চালালেন। যেহেতু তিনি অনেক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাই তিনি পিতার কাছে ফিরে এসে কাঁদতে লাগলেন। হযরত আলী দাঁড়িয়ে তাঁর চোখের অশ্রু মুছে দিলেন এবং চুমো দিয়ে বললেন,“তোমার জন্য তোমার পিতা কোরবান হোক। হে বৎস্য,খোদার শপথ! তুমি আমাকে আনন্দিত করেছ। তুমি কাঁদছ কেন? এটি কি আনন্দের কান্না নাকি অস্থিরতা ও যুদ্ধভীতিজনিত কান্না?

মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া বললেন,“কেন আমি কাঁদবো না। আপনি আমাকে তিন তিনবার মৃত্যুর মুখে পাঠিয়েছিলেন এবং মহান আল্লাহও আমাকে নিরাপদ রেখেছেন। যখনই আমি যুদ্ধের ময়দান থেকে শিবিরে ফিরে এসেছি তখন আমাকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়েই পুনরায় যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমার এ দু’ভাই হাসান ও হুসাইনকে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন না?”

ইমাম আলী মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার মাথায় চুম্বন করে বললেন,“হে বৎস্য! তুমি আমার সন্তান। আর এরা দু’জন রাসূলুল্লাহর সন্তান। তাদের কি আমি হেফাযত করব না?”

মুহাম্মদ তখন বললেন,“হ্যাঁ,আব্বা। আল্লাহ আমাকে আপনার এবং এ দু’জনের উদ্দেশ্য কোরবান করুন।”

সিফ্ফিনের যুদ্ধের পর সালিসীর ঘটনা,নাহরাওয়ানের যুদ্ধসহ সকল ঘটনা ও পরিস্থিতিতে ইমাম হুসাইন (আ.) সর্বত্র পিতা হযরত আলীর সাথেই ছিলেন। আর এ বিষয়টি কতিপয় হাদীস ও রেওয়ায়েত থেকে প্রমাণিত। আর তিনি নিকট থেকে তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি জনগণের বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁর আদর্শের ওপর দৃঢ়পদ না থাকার বিষয়টিও প্রত্যক্ষ করেছেন। বিচক্ষণতা ও অনুধাবন করার প্রতি শক্তি তাঁর মধ্যে অলৌলিক মাত্রায় বিরাজ থাকার কারণে এ বিরাট মুসিবতের তিক্ততা সহ্য করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন।

এ সব তিক্ত ও বিপজ্জনক ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় অর্থাৎ হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর তরবারী দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শাহাদত বরণের কারণ হয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর পরে আলী (আ.) ছিলেন মানবতার সর্বোত্তম আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদীর হাতে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। তদানীন্তন পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,খারেজী ও উমাইয়্যাদের একটি যৌথ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন মহানবীর পরে মানব জাতির ইতিহাসের সর্বোত্তম ব্যক্তি হযরত আলী (আ.) মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীরত অবস্থায় ১৯ রমযানের প্রভাতে (ফজরের সময়)। পাপিষ্ঠ নরাধম ইবনে মুলজিম মুরাদীর তরবারীর আঘাতে যখন তার পবিত্র ললাট ফেটে যায় তখন তিনি বলেছিলেন,فزت ربّ الکعبة “কাবার প্রভুর শপথ! আমি সফল হয়েছি।

হযরত আলী (আ.) যেমন মহানবীর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র এবং তাঁর নিজ সন্তানের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁর শিক্ষা ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি,এ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত কোন সুযোগই তিনি হেলায় হারান নি এবং মৃত্যুবরণের পূর্বে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য সৃজনশীল কর্মসূচী ও দিকনির্দেশনাবলী সম্বলিত অসিয়ত প্রদান করেছেন ঠিক তদ্রূপ তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতিও একই মনোযোগ ও দৃষ্টি দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সময় ও সুযোগের লক্ষ্যে তিনি তাঁকেও সৃজনশীল উপদেশ এবং উপকারী দিকনির্দেশনা দান করেছেন। নিচে আমরা কিছু সম্মানিত পাঠকবর্গের সামনে এগুলো থেকে উপস্থাপন করছি :

নাহজুল বালাগাহ্ থেকে : ইবনে মুলজিম (মহান আল্লাহর অভিশাপ তার ওপর) যখন হযরত আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী ইবনে আবি তালিবকে তরবারি দিয়ে আঘাত করেছিল তখন তিনি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি অসিয়ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,“আমি তোমাদের দু’জনকে মহান আল্লাহর তাকওয়া-পরহেজগারী অবলম্বন করতে,দুনিয়া অন্বেষণ না করতে এমনকি দুনিয়াও যদি তোমাদের অন্বেষণ করে তবুও এবং দুনিয়াবী কোন জিনিস যা তোমাদের হাত থেকে চলে গেছে ও তোমাদের থেকে দূরে সরে গেছে তা নিয়ে আক্ষেপ না করতে উপদেশ দিচ্ছি। তোমরা ন্যায্য কথা বলবে,আখেরাতের পুরস্কার পাওয়ার জন্য কাজ করবে। জালিমের শত্রু এবং মজলুমের সাহায্যকারী হবে। তোমাদের দু’জনকে আমার সকল সন্তান-সন্ততি আমার পরিবার-পরিজন এবং যার কাছে আমার এ অসিয়তনামা পৌঁছবে তাদের সবাইকে মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে তাকওয়া-পরহেজগারী অবলম্বন,তোমাদের নিজেদের কাজ-কর্মে শৃঙ্খলা বিধান এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন করার জন্য অসিয়ত করছি। কারণ আমি তোমাদের নানা মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি : মানুষের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন ও তাদের ঝগড়া-বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান সকল নামায ও রোযা অপেক্ষা উত্তম। ইয়াতীম-অনাথদের ব্যাপারে তোমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ কর এবং সতর্ক থেক। তাই ইয়াতীমদেরকে একদিন অন্তর খাদ্য খাওয়ায় অভ্যস্ত কর না (অর্থাৎ এক বেলা বা একদিন আহার দান করে অন্য বেলা বা অন্য দিন ক্ষুধার্ত ও অনাহারে রেখ না) এবং তোমাদের পাশে (ক্ষুধার্ত ও অভিভাবকহীন থাকার কারণে) তারা যেন ধ্বংস না হয়ে যায়। নিজ প্রতিবেশীদের ব্যাপারে তোমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ কর। তাদের ব্যাপারেও তোমাদের নবী (সা.)-এর অসিয়ত রয়েছে। তিনি সর্বদা প্রতিবেশীদের ব্যাপারে এতটা অনুরোধ করেছেন যে,আমরা ধারণা করেছিলাম যে,তিনি তাদেরকেও মৃতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করবেন। পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে তোমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ কর। কোরআন অনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে অন্যেরা যেন তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী না হয়। নামাযের ব্যাপারে তোমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ কর। কারণ তা তোমাদের ধর্মের স্তম্ভ। তোমাদের প্রভুর ঘরের (কাবা) ব্যাপারে তোমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ কর। তোমরা যতদিন জীবিত আছ ততদিন পবিত্র কাবাকে বিরাণ রেখ না। যদি তা ত্যাগ করা হয় (বিরাণ রাখা হয়) তবুও তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না (এবং পবিত্র কাবা বর্জন করার কারণে তোমরা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে)। মহান আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ,জীবন ও ভাষার দ্বারা জিহাদ করার ব্যাপারে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর। আত্মীয়তার বন্ধন ও সম্পর্ক রক্ষা করা এবং পারস্পরিক দান ও ব্যয় করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য। তোমাদেরকে পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদ ও একে অপরের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

তোমরা সৎ কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের নিষেধ করা থেকে বিরত থেক না। তাহলে তোমাদের ওপর তোমাদের মধ্য থেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তিরা কর্তৃত্বশীল হয়ে যাবে। এ অবস্থায় যখন তোমরা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে তোমাদের প্রার্থনা কবুল হবে না।”

এরপর তিনি বললেন,“হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! ‘আমীরুল মুমিনীনকে হত্যা করা হয়েছে’-এ কথার ধুয়ো তুলে মুসলমানদের রক্ত ঝড়াতে লিপ্ত না দেখি। জেনে রাখ যে,আমার হত্যাকারী ব্যতীত আর অন্য কোন ব্যক্তিকে যেন হত্যা করা না হয়। তোমরা লক্ষ্য রেখ যে,যদি আমি এর এই আঘাতে মৃত্যুবরণ করি তাহলে কেবল একটি আঘাতের বদলে একটি আঘাত করে একে হত্যা কর। তার লাশ বিকৃত কর না। কারণ আমি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছি : তোমরা লাশ বিকৃত কর না,এমনকি তা যদি ক্ষেপা বা পাগল দংশনকারী কুকুরেরও লাশ হয়।” (চলবে)

তথ্যসূত্র

১. ইবনে আবিল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ২৮৪।

২. শারহু নাহজিল বালাগাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ১১৮।

৩. নাহজুল বালাগাহ্,চিঠিপত্র অধ্যায়,চিঠি নং ৪৭।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)