আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আলে ইমরান;(৩৩ তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৭৪-১৭৮

সূরা আলে ইমরানের ১৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ ((১৭৪ 

"যে সব আহত মুজাহিদ দ্বিতীয়বার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল,তারা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে কোন ক্ষতির শিকার না হয়েই নিজেদের এলাকায় ফিরে এসেছিল। আল্লাহ যাতে রাজী,তারা তাই করেছিল এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।"(৩:১৭৪)

গত কয়েকটি পর্বে আমরা যেমনটি আলোচনা করেছিলাম,মহানবী (সা.)'র নির্দেশে ওহুদ যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা আহত মুজাহিদরা পুনরায় শত্রুদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। শত্রুরা মুসলমানদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পুনরায় মদীনায় গিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলার পরিকল্পনা ত্যাগ করে। তাই ওহুদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদদের সাহসী মনোভাবের প্রশংসার জন্য আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল-
প্রথমত : আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব পালন করি,তাহলে আল্লাহ আমাদের অনুগ্রহ করবেন। দায়িত্ব পালন না করেই আল্লাহর অনুগ্রহের আশা করা দূরাশা মাত্র।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর পথের পথিকদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই প্রয়োজনে জীবিত বা শহীদ কিংবা আহতও হতে পারে যে কেউ।

সূরা আলে ইমরানের ১৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ((১৭৫

"শয়তানই তোমাদের এবং তার বন্ধুদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ভয় দেখায়,কিন্তু যদি তোমরা বিশ্বাসী হও,তবে তাদের ভয় করোনা,বরং আমাকেই ভয় কর।" (৩:১৭৫)

আগের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে জীবনের লক্ষ্য করে নিয়েছে তারা কোন শত্রুকেই ভয় পায় না,এমনকি তারা আহত অবস্থায়ও শত্রুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হয়। আর এই আয়াতে আল্লাহ দুর্বলমনা মুসলমানদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন,শয়তানের কুমন্ত্রণা দুর্বল ঈমানদারদের ওপর এত প্রভাব ফেলেছে যে,তারা আল্লাহর আনুগত্যের পরিবর্তে শয়তানের আনুগত্য করছে। এজন্যেই তারা আল্লাহর রাস্তায় কষ্ট স্বীকার করতে রাজী নয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
প্রথমত : মুসলিম সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে এমন যে কোন কাজ যেমন,প্রচারণা ও গুজব ছড়ানো এবং এসবে কান দেয়া বা অংশ নেয়া শয়তানের কাজ।
দ্বিতীয়ত : যুদ্ধে অংশ নিতে ভয় পাওয়া দুর্বল ঈমানের লক্ষণ এবং শয়তানের আনুগত্যের শামিল।
তৃতীয়ত : মজলুম ও বঞ্চিত জনগণের প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য এবং তাদের জাগরণ ঠেকানোর জন্য হুমকি দেয়া শয়তান ও কুফরী শক্তির একটা বড় কৌশল।

সূরা আলে ইমরানের ১৭৬ ও ১৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

وَلَا يَحْزُنْكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْكُفْرِ إِنَّهُمْ لَنْ يَضُرُّوا اللَّهَ شَيْئًا يُرِيدُ اللَّهُ أَلَّا يَجْعَلَ لَهُمْ حَظًّا فِي الْآَخِرَةِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (১৭৬) إِنَّ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الْكُفْرَ بِالْإِيمَانِ لَنْ يَضُرُّوا اللَّهَ شَيْئًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ((১৭৭ 

"হে নবী,যারা কুফরীর ক্ষেত্রে অগ্রগামী আপনি তাদের জন্য দুঃখিত হবেন না,তারা কখনও আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ পরকালে তাদের জন্য কোন কল্যাণের অংশ রাখার ইচ্ছা করেন না এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।" (৩:১৭৬) 
"যারা বিশ্বাসের বিনিময়ে অবিশ্বাস কিনে নিয়েছে,তারা কখনও আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" (৩:১৭৭)

ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের ফলে একদল মুসলমানের মধ্যে ভয় ও আতংক দেখা দেয়। তারা এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যে,একে অপরকে প্রশ্ন করছিল ভবিষ্যতে তাদের কি হবে? তাদের এই প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ রাসূল (সা.)কে উদ্দেশ্য করে যা বলেছেন তার মর্মার্থ হলো,ওহুদ যুদ্ধে কাফেরদের জয়ের ফলে তারা সৌভাগ্যবান হয়ে যাবে না। বরং কাফেররা কুফরীর চোরাবালিতে আরো তলিয়ে যেতে থাকবে এবং তারা পরকালে কোন কল্যাণেরই অংশ পাবে না। তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহর তো কোন ক্ষতি হবেই না,বরং তারা নিজেরাই পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে। মহান আল্লাহ এ অবস্থাকে ঈমানের বিনিময়ে কুফরী কিনে নেওয়া বলে মন্তব্য করেছেন। এই দুনিয়ার বাজারে মানুষের অস্তিত্ব তার বিশ্বাস ও কাজ দোকানের পণ্যের মত। আর এসবই ত্যাগ করা তথা বিক্রি করা অপরিহার্য। কারণ বেঁচে থাকার বিষয়টি আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু ক্রেতা নির্বাচন আমাদের ইচ্ছাধীন। আমাদের খরিদদার বা ক্রেতা আল্লাহ হতে পারেন বা অন্য কেউও হতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর সাথে লেনদেন করাকেই কোরআন প্রশংসা করেন। কারণ এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বেহেশত অর্জন করা যায়। অন্যদিকে কোরআন ঐসব লেনদেনের সমালোচনা করেছে যার মাধ্যমে কোন লাভ বা মুনাফা পাওয়া যায়না বরং জীবনের এই লেনদেনের মাধ্যমে অজির্ত হয় অসীম ক্ষতি তথা অসীম শান্তি।

এবারে এই দুই আয়াতের মূল শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
প্রথমত : আল্লাহ আমাদের অস্তিত্ব ও আমাদের কাজের মোটেই মুখাপেক্ষী নন। কেউ কাফের হলে বা তার দায়িত্ব পালন না করলে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল্লাহর অবাধ্যতা ও কুফরীর কারণে কাফেরদের ধর্ম এবং বিধানও দুর্বল ও ব্যর্থ হবে।
দ্বিতীয়ত : যারা চিন্তা চেতনায় আল্লাহর অবাধ্য এবং কাজে কর্মে ও আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ তারা পরকালে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।
তৃতীয়ত : মুসলিম সমাজের সাথে কুফরী সমাজের তুলনার সময় শুধু কাফেরদের দুনিয়ার প্রাচুর্যের দিকেই দৃষ্টি দেয়া উচিত নয়। পরকালে তারা যে কোন কল্যাণই পাবে না সেটা মুসলমানদের ভাবা উচিত।

সূরা আলে ইমরানের ১৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ خَيْرٌ لِأَنْفُسِهِمْ إِنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ لِيَزْدَادُوا إِثْمًا وَلَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ ((১৭৮

"কাফেররা যেন এটা মনে না করে যে,তাদেরকে আমি যে অবকাশ বা সুযোগ দিয়েছি তা তাদের জন্য কল্যাণকর। আসলে আমি তাদেরকে পাপের পেয়ালা পূর্ণ করারই অবকাশ দিয়েছি এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।" (৩:১৭৮)

আল্লাহ আগের কয়েকটি আয়াতে ওহুদ যুদ্ধে কাফেরদের বিজয়ের জন্য দুঃখিত মুসলমানদের সান্ত্বনা দিয়ে তাদের দুঃখিত হতে নিষেধ করেছেন। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,অবিশ্বাসীদের সুযোগ দেয়া আল্লাহর একটি রীতি। এটা কাফেরদের ব্যাপারে আল্লাহর অজ্ঞতা বা অক্ষমতার লক্ষণ নয়। আল্লাহ বিশ্বাসী,অবিশ্বাসী,পাপী ও সৎকর্মশীল নির্বিশেষে সব মানুষকেই জীবনের পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই আল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সৎ ও পাপ কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। কাফেররা এই সুযোগের অপব্যবহার করে বলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই স্বাধীনতা বা অধিকারের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে এত বেশী যে স্বেচ্ছায় কোন কাজ করার স্বাধীনতাকে আল্লাহ কেড়ে নিতে চান না। তাই আল্লাহ পাপীকেও তার মন মত চলার আরো সুযোগ দেন। কেউ নিতান্ত অনিচ্ছায় সৎকাজ করবে ও আল্লাহকে মানবে আল্লাহ তা চান না। কাফেররা মনে করে,এই স্বাধীনতা বা সুযোগ তাদের জন্য লাভজনক এবং এর ফলে তারা তাদের দৃষ্টিতে ভালো কাজ চালিয়ে যেতে পারছে ও একই সাথে নিজেরাও ভালোই থাকছে। কিন্তু আসলে মন্দ কাজ ও অবিশ্বাসের পরিণতি হল পরকালের কঠোর শাস্তি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
প্রথমত : জীবনে পাপ করার স্বাধীনতাকে ভালো সুযোগ ভাবা উচিত নয়। এই সুযোগের কারণে বোকামী না করে বরং দেরী হবার আগেই কুফরী থেকে বিরত হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত : জীবনে দীর্ঘায়ু হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বয়সকে অর্থাৎ সময়কে ভালোভাবে কাজে লাগানোই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম হোসাইন (আঃ)'র পুত্র ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) তাঁর এক দোয়ায় বলেছেন- হে আল্লাহ! যদি আমার জীবন শয়তানের বিচরণ ক্ষেত্র হয়,তবে তা সংক্ষিপ্ত করে দাও।
তৃতীয়ত : কাফেরদের ভালো অবস্থা দেখেই তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা করা উচিত নয়,পরকালে তাদের শাস্তির বিষয়টি মনে রাখা উচিত।
চতুর্থত : কাফেরদের কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতাকে তাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষণ মনে করে নীরব থাকা উচিত নয়। বরং তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)