আল হাসানাইন (আ.)

পাশ্চাত্যে পারিবারিক সংকট:- গর্ভপাত

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

 পাশ্চাত্যের পরিসংখ্যানগুলো থেকেই এটা স্পষ্ট যে, সেখানে তালাকের পরিমাণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বিয়ের মাধ্যমে পরিবার গঠনের প্রতিও আগ্রহ অনেক কমে গেছে। যৌন স্বাধীনতা, ব্যক্তিবাদ ও ভোগ-বিলাসিতাই এখন পাশ্চাত্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ কারণে সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ শুধু নিজের স্বার্থ রক্ষাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এর ফলে বিয়ে ও পরিবার গঠনে তারা আগ্রহী নয়। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক ডেভিড এইচ. ওলসন লিখেছেন, 'আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই দেরিতে বিয়ে করছে। অনেকেই বলছে, তারা তাদের পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মতো তালাক নিতে চান না। তবে এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করার মতো কোনো আদর্শ তাদের সামনে নেই।' পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকাগুলোও মানুষকে পরিবার গঠনের বিষয়ে অনাগ্রহী করে তুলছে। ফরাসি ম্যাগাজিন 'এলে'তে কর্মরত একজন বিশেষজ্ঞ বিয়ে করতে ইচ্ছুক এক নারীকে পরামর্শ দিতে যেয়ে বলেছেন, তুমি কুকুরকে বিয়ে করো। কারণ একমাত্র কুকুরই তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
স্থায়ী সুখ ও প্রশান্তি পেতে চাইলে নারীকে বিয়ে ও পরিবার গঠনের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বের যেসব দেশে তালাকের হার সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে আমেরিকা অন্যতম। মার্কিন সাপ্তাহিকী নিউজউইক  লিখেছে, আমেরিকায় তালাক নেয়াটা ট্যাক্সি ভাড়া করার মতোই অতি সহজ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে যেসব  নারী তালাক নিচ্ছেন,তাদের এক-চতুর্থাংশই অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। এ ধরনের নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও সাধারণ নারীদের তুলনায় তিন গুণ। আমেরিকায় একজন স্বামী ও স্ত্রী কোনো কারণ উল্লেখ না করেই তালাক নিতে পারে। এর ফলে সেখানে তালাকের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। জাতিসংঘের বিশিষ্ট গবেষক ড. সিলভিয়া এন হিউলেট এ সম্পর্কে লিখেছেন, 'তালাক নেয়ার প্রক্রিয়া প্রতিদিনই আরো সহজতর হচ্ছে।' পুরুষরা আরো কম বয়সী নারীকে বিয়ে করার লক্ষ্যে তালাক দেয়ার এই সহজ পন্থাকে অপব্যবহার করছে বলে তিনি দাবি করেন। তার মতে, এতে নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ তালাকের পর সাধারণত নারীদেরকেই সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্বটি নিতে হয়।
আরেক লেখক ড. জেমস সি. ডেবসন এ সম্পর্কে লিখেছেন, বাবা-মা'র মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে-এমন  সন্তানের সংখ্যা সম্প্রতি ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। মার্কিন লেখক কোরনেল ওয়েস্ট এ সম্পর্কে জানিয়েছেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মা আলাদা হওয়ার পর সন্তানেরা বিশেষকরে মেয়ে সন্তানেরা মারাত্মক সমস্যার মুখে পড়ে। তারা অর্থনৈতিক সমস্যাসহ শিক্ষা ক্ষেত্রেও ক্ষতির শিকার হয়। পাশ্চাত্যে গর্ভপাতের পরিমাণও ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষকরে আমেরিকা, ব্রিটেন ও কানাডায় ভ্রুণহত্যার মতো অমানবিক ততপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কোনো পদ্ধতিতে গর্ভস্থ শিশুকে গর্ভের ভেতরেই মেরে ফেলা খুবই আমানবিক ও নৃশংস কাজ। এ কাজ মানুষের সহজাত প্রকৃতির বিরোধী। মাইকেল লিচফিল্ড এবং সুসান কেন্টিশ নামের দুই বৃটিশ গবেষক জানিয়েছেন, বৃটেনে গর্ভস্থ শিশুর জীবন নাশ বা গর্ভপাতের হার ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণে এইসব শিশুর মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য বিশেষ ধরনের অনেক চুল্লী বানানো হয়েছে।
প্রতিবছর গর্ভপাতের শিকার হাজার হাজার শিশুর মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছে চুল্লীতে। গর্ভস্থ শিশু হত্যার নৃশংস চিত্র এখানেই শেষ নয়। পাশ্চাত্যের এক শ্রেণীর মুনাফালোভী মানুষ আজকাল বিপুল অর্থের লোভে গর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করছে চিকিৎসা গবেষণায় তাদের ব্যবহার করার জন্য। কানাডীয় লেখক উইলিয়াম গার্ডনার লিখেছেন, "নিহত ভ্রুণ শিশুর কোষগুলো সুস্থ ও খুব তাজা বলে এসব কোষ চিকিৎসা গবেষণায় ব্যবহার করছে কেউ কেউ। গর্ভস্থ শিশু বা ভ্রুণ শিশুর মৃত্যুর পরপরই তার দেহের কোষ ও চামড়াগুলো সতেজ থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়। এইসব কোষ অন্যদের কোষের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।"
আরো দুঃখজনক খবর হল, আজকাল পাশ্চাত্যের চিকিৎসকরা ভ্রুণ-শিশুর চর্বিকে সাজ-সজ্জার বা প্রসাধন সামগ্রীর উপাদান তৈরির মতো বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন। গর্ভপাতের সমর্থক হিসেবে পরিচিত চিকিৎসক অধ্যাপক ক্রিস ব্যাগলি বলেছেন, "ভ্রুণ-শিশুর চর্বি প্রসাধন শিল্পের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।"
তিনি আরো বলেছেন," আমি পূর্ণতা প্রাপ্ত ভ্রু শিশু নষ্ট করি। আমি সাত মাসের ভ্রুণ শিশুকেও নির্দ্বিধায় হত্যা করি। এইসব শিশুর সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থাকে এবং ওরা বেশি সময় বেঁচে থাকে। ভ্রুণশিশুকে দ্রুত হিমায়িত করা আরো এক আমানবিক ও অনৈতিক পন্থা। আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও তারা নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে ত্যাগ করেছে। মর্কিন লেখক জর্জ গ্রান্ট লিখেছেন, "আজ যুক্তরাষ্ট্রের বহু হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নব জাতক বা ভ্রুণ-শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত রয়েছেন নামকরা চিকিৎসক ও গবেষকরা। তারা এসব কাজকে স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক রুটিনে পরিণত করেছেন। কিন্তু আমাদের সংবাদ মাধ্যমও এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, তারা এইসব অপরাধ তুলে ধরছে না।" ভ্রণ-শিশু হত্যার মতো নৃশংসতা সেই অন্ধকার যুগকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যখন মানুষ নিজ সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ১৫ লক্ষ ভ্রুণ-শিশু হত্যা করা হচ্ছে। একজন মার্কিন গবেষক গর্ভপাতের করুণ দৃশ্য রেকর্ড করেছেন গর্ভের ভেতরে ক্যামেরা বসিয়ে। তার এ ভিডিও চিত্রের নাম দেয়া হয়েছে "নীরব আর্তনাদ"। এই ফিল্মে দেখা গেছে, তিন মাসের এক অসহায় ভ্রুণশিশু কিভাবে যন্ত্রের হাত থেকে পালানোর হতাশাব্যাঞ্জক চেষ্টা করছে এবং গর্ভপাতকারী যন্ত্র কিভাবে একের পর এক ওই শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কেটে কেটে বের করে আনছে।
মার্কিন গণমাধ্যমগুলো এইসব বিষয় প্রচার না করায় জর্জ গ্রান্ট মার্কিন গণমাধ্যমের বড় রকমের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন,"যেসব ভ্রুণশিশু গর্ভপাতের পরও বেঁচে যায় সেসব শিশুকে জীবন্ত অবস্থায় নৃশংস ও অদ্ভুত নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। এইসব ভ্রুণশিশুকে প্রসাধন সামগ্রীর উপাদান থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরিসহ বিচিত্র কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বেচা-কেনা করা হয়। হাস্যকর বিষয় হলো, কানাডার আইন অনুযায়ী কোনো মেয়েকে তার কান ফোড়ানোর জন্য বাবা মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। অথচ তারা বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়াই গর্ভপাত করতে পারে।
ইসলাম ধর্মে গর্ভপাতকে মারাত্মক পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। গর্ভবতী মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা থাকলেই কেবল চিকিতসকের অনুমতি সাপেক্ষে ইসলাম ধর্মে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়া হয়। ইসলাম ধর্ম মতে, গর্ভস্থ ভ্রুণ মানব সন্তান এবং অন্য সবার মতো ভ্রুণশিশুরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। ভ্রুণশিশু অস্তিত্ব লাভের পর চিকিতসকতো দূরের কথা তার বাবা-মাও ভ্রুণকে হত্যার অধিকার রাখে না। যেমনিভাবে সন্তান জন্মলাভের পর বাবা-মা তার সন্তানকে হত্যার অধিকার রাখে না। কিন্তু পাশ্চাত্য নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা বর্জন করে অমানবিক ও নৃশংস ততপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সুখ ও সমৃদ্ধিকেই সর্বাগ্রে স্থান দেয়ার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানেরা সন্তান লালন-পালনকে ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ বলে মনে করে। কিন্তু কোনো সমাজ যখন ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে তখন এ ধরনের নানা অন্যায় ততপরতা সমাজকে গ্রাস করে।(রেডিও তেহরান)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)