আল হাসানাইন (আ.)

হযরত ইবরাহীম (আ.)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

হযরত ইবরাহীম (আ.) এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা পুরোপুরি মূর্তিপূজা, শিরক ও মানবপূজায় লিপ্ত ছিল। মানুষ নিজ হাতে নির্মিত মূর্তি ও তারকারাজির কাছে মাথা নোয়াত।

বাবিল বা ব্যাবিলন নগরী ছিল তাওহীদের মহান পতাকাবাহী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্মভূমি। ঐতিহাসিকগণ এ নগরীকে পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি বলে গণ্য করেছেন। আর এ নগরীর উন্নত কৃষ্টি ও সভ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে বিশদ আলোচনা হয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হেরোডোট লিখেছেন : “ব্যাবিলন নগরী বর্গাকৃতিতে তৈরি করা হয়েছিল যার (চতুর্দিকের) প্রতিটি পাশের দৈর্ঘ্য ১২০ ফারসাখ এবং পরিধি ৪৮০ ফারসাখ ছিল। যদিও এ বর্ণনাটি অতিশয়োক্তির দোষে দুষ্ট তারপরও একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা (এতৎসংক্রান্ত লিখিত অন্যান্য তথ্য ও গ্রন্থ বিবেচনায় আনলে) এ বর্ণনা থেকে ভালোভাবে উন্মোচিত হয়। কিন্তু আজ দজলা ও ফোরাতের মাঝখানে ছোট-খাটো একটি মাটির টিলা ব্যতীত ঐ সময়ের চিত্তাকর্ষক দৃশ্যাবলী, উঁচু উঁচু সুরম্য প্রাসাদ ও ভবনের আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। এখন ঐ জায়গার সর্বত্র মৃত্যুপুরীর নীরবতা বিরাজমান। তবে কখনো কখনো প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বাবিল নগরী ও রাজ্যের জনগণের সভ্যতার স্বরূপ জানা ও বোঝার জন্য খননকার্য চালানোর ফলে সেখানকার এ নীরবতার জাল ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলেন।

নমরুদ বিন কিনআন-এর রাজত্বকালে তাওহীদের মহানায়ক হযরত ইবরাহীম (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও নমরুদ মূর্তিপূজক ছিল, তথাপি সে জনগণের কাছে নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবি করত। সম্ভবত আশ্চর্যই লাগতে পারে যে, কিভাবে একই ব্যক্তি মূর্তিপূজক, আবার একই সাথে সে জনগণের কাছে নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবি করে? আর ঠিক মিশরের ফিরআউনের ব্যাপারেও আমরা পবিত্র কোরআন থেকে এ ধরনের বিষয়ই জেনেছি (অর্থাৎ ফিরআউন মূর্তিপূজক হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবি করেছিল)। যখন মূসা ইবনে ইমরান (আ.) শক্তিশালী যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ফিরআউনের প্রশাসন ও সরকারের ভিত টলিয়ে দিয়েছিলেন তখন ফিরআউনের সমর্থকগণ প্রতিবাদী কণ্ঠে তাকে (ফিরআউনকে) সম্বোধন করে বলেছিল,

)أ تذر موسى و قومه ليفسدوا في الأرض و يذرك و آلهتك(

“আপনি কি মূসা ও তার কওমকে পৃথিবীর বুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেবেন? সে আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।” (সূরা আরাফ : ১২৭)

এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, ফিরআউন নিজেকে খোদা বলে দাবি করত এবং

)أنا ربّكم الأعلى(

‘আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রভু’  ও

 )ما علمت لكم من إله غيري(

‘আমি ব্যতীত তোমাদের যে আর কোন উপাস্য আছে তা আমি জানি না’

-এ কথাগুলো বলত, অথচ সে ঐ একই সময় মূর্তিপূজকও ছিল। কিন্তু মূর্তিপূজক ও মুশরিকদের যুক্তিতে এতে কোন অসুবিধা নেই যে, কোন ব্যক্তি কোন এক গোষ্ঠীর খোদা ও উপাস্য হবে, অথচ ঐ একই সময় উক্ত উপাস্যও তার চেয়ে বড় খোদার পূজা করবে। কারণ খোদা ও উপাস্য শব্দের অর্থ বিশ্বব্র‏‏হ্মাণ্ডের স্রষ্টা নয়, বরং এমন সত্তা যার অন্যদের ওপর কোন এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে এবং তাদের জীবনের সর্বময় কর্তৃত্ব তার হাতেই ন্যস্ত। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে : রোমে কোন এক বংশের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগণকে বংশের অন্যান্য সদস্য পূজা করত, অথচ ঐ একই সময় ঐ সব পূজিত বয়োজ্যেষ্ঠগণেরও নিজস্ব উপাস্য ছিল যার পূজা তারা করত।

সবচেয়ে বড় যে দুর্গ নমরুদ নিজ হাতের মুঠোয় এনেছিল তা ছিল (তার প্রতি) একদল জ্যোতির্বিদ ও ভবিষ্যদ্বক্তার সমর্থন, মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ। এ সব জ্যোতির্বিদ ও ভবিষ্যদ্বক্তা সে যুগের জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হতো। তাদের নমরুদের প্রতি ভক্তি ও বিনয় সমাজের নিম্ন ও অজ্ঞ শ্রেণীকে দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অধিকন্তু হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আযরের মতো ব্যক্তিবর্গও ছিল। আযর ছিল মূর্তিনির্মাতা এবং সে তারকারাজির অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত। সে নমরুদের একজন সভাসদও হয়েছিল। আর এ বিষয়টিও হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্য এক বিরাট অন্তরায় ছিল। কারণ জনগণের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ছাড়াও তিনি তাঁর নিজ আত্মীয়-স্বজনদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

যখন নমরুদ স্বপ্নিল জীবনের মধ্যে বুঁদ ছিল ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে জ্যোতির্বিদগণ বিপদের প্রথম ঘণ্টা বাজিয়ে বলল, “তোমার হুকুমত এমন এক ব্যক্তির হাতে ধ্বংস হবে যে এ জনপদেরই সন্তান।” নমরুদের সুপ্ত চিন্তাধারা জাগ্রত হলো এবং সে জিজ্ঞেস করল, “সে কি জন্মগ্রহণ করেছে না করে নি?” তারা বলল, “সে এখনও জন্মগ্রহণ করে নি।” রাজা নমরুদ জ্যোতির্বিদদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যে রাতে তার উক্ত ভয়ঙ্কর শত্রুর ভ্রুণ মাতৃগর্ভে স্থিতি লাভ করবে সে রাতে সক্ষম নারী-পুরুষদের বিচ্ছিন্ন রাখার আদেশ দিয়েছিল। বর্ণনা অনুসারে নমরুদের জল্লাদরা ছেলে শিশুদের হত্যা করত। ধাত্রীদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তারা যেন নবজাতক শিশুদের মুখ নমরুদের বিশেষ দফতরে পাঠিয়ে দেয়।

ঘটনাক্রমে যে রাতে নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সে রাতেই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পবিত্র ভ্রুণ মাতৃগর্ভে স্থিতি লাভ করে। ইবরাহীম (আ.)-এর মা গর্ভধারণ করলেন এবং মূসা ইবনে ইমরানের মায়ের মতোই তাঁর গর্ভধারণকাল গোপনে সমাপ্ত হলো। প্রসব করার পর প্রাণপ্রিয় সন্তান নবজাতক ইবরাহীমকে নিয়ে তাঁর মা শহরের পাশে অবস্থিত এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাঁকে সেখানেই রেখেছিলেন। দিন-রাত যতবার সম্ভব ততবার তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে দেখতে ঐ গুহায় যেতেন। সময় গত হওয়ার সাথে সাথে এ ধরনের অত্যাচার নমরুদকে নিশ্চিত ও নিরুদ্বিগ্ন করে এবং তার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে, সে তার রাজত্ব ও রাজসিংহাসনের শত্রুকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে।

ইবরাহীম (আ.) পুরো ১৩ বছর ঐ গুহায় কাটিয়েছিলেন। স্মর্তব্য যে, ঐ গুহাটির একটি সরু প্রবেশপথ ছিল। ১৩ বছর পর ইবরাহীম (আ.)-এর মা তাঁকে গুহার বাইরে নিয়ে আসেন। ইবরাহীম (আ.) জনপদে পদার্পণ করলেন। নমরুদপন্থীদের জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়লে তাঁর মা বললেন, “এ আমার সন্তান; জ্যোতির্বিদদের ভবিষ্যদ্বাণী করার আগেই সে জন্মগ্রহণ করেছিল।”

ইবরাহীম (আ.) গুহা থেকে বের হয়ে এসে ভূপৃষ্ঠ, আকাশ, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ও তারকারাজি এবং বৃক্ষসমূহের সবুজ-শ্যামল হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে তাঁর ফিতরাতগত তাওহীদী (توحيد فطري) আকীদা-বিশ্বাসকে পূর্ণতর করেন। সমাজ ও জনপদে পদার্পণ করেই হযরত ইবরাহীম (আ.) কতিপয় ব্যক্তিকে তারকারাজির ঔজ্জ্বল্যের সামনে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি বিকিয়ে দিতে দেখলেন। তিনি আরেক দলকে দেখতে পেলেন যে, তাদের চিন্তাধারার পর্যায় পূর্বোক্ত গোষ্ঠীর চেয়েও নিকৃষ্ট এ কারণে যে, তারা কাঠ বা পাথর নির্মিত প্রতিমার পূজায় রত। আর এ সব কিছুর চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যাপার যা তিনি দেখতে পেলেন তা ছিল এই যে, এক ব্যক্তি (নমরুদ) জনগণের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে খোদা বলে দাবি করছে।

হযরত ইবরাহীম (আ.) তাই এ তিন রণাঙ্গনে সংগ্রাম করার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে হযরত ইবরাহীম যে এ তিনটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম করেছিলেন তা বর্ণিত হয়েছে।

মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সংগ্রাম

মূর্তিপূজার নিকষ কালো আঁধার সমগ্র ব্যাবিলন রাজ্যকে গ্রাস করেছিল। পার্থিব ও স্বর্গীয় অগণিত মিথ্যা খোদা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বিবেক-বুদ্ধি কেড়ে নিয়েছিল। তারা কতিপয় মিথ্যা খোদাকে মহাশক্তির এবং আরো কিছু মিথ্যা খোদাকে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে বিশ্বাস করত।

মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে মহান নবী-রাসূলদের পথ ও রীতিনীতি যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ মানুষের হৃদয়ের সাথে তাঁদের সম্পর্ক। আর তাঁরা চান এমন এক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যা ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থা বাহুবল ও তরবারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মহান নবীদের শাসনব্যবস্থা এবং নমরুদ ও ফিরআউনদের শাসনব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য করতে হবে। দ্বিতীয় গোষ্ঠীর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কোনভাবে তাদের শাসনকর্তৃত্ব  ও নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা, যদিও তাদের প্রশাসন তাদের মৃত্যুর পর ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণ (মহান নবিগণ ও তাঁদের অনুসারিগণ) এমন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান যা প্রকাশ্যে ও গোপনে, শাসকের ক্ষমতা-অক্ষমতার সময়, তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরবর্তীকালে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম। অর্থাৎ তাঁরা মানব জাতির হৃদয়ে কর্তৃত্ব করেন-দেহের ওপর নয়। আর এ মহান লক্ষ্যটি কখনই জোর করে বাস্তবায়িত হবে না।

হযরত ইবরাহীম (আ.) শুরুতেই নিজ আত্মীয়-স্বজনদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। আযর তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নেতৃত্ব দিত। এ সংগ্রামে পুরোপুরি সাফল্য আসতে না আসতেই ইবরাহীম (আ.) সংগ্রামের আরেকটি ক্ষেত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ দলটির চিন্তাধারার পর্যায় পূর্বোক্ত প্রথম দলটির চিন্তাধারা থেকে কিছুটা উন্নত ছিল। কারণ তারা হযরত ইবরাহীমের জ্ঞাতি-গোত্রের অনুসৃত রীতিনীতি ও ধর্মমতের বিপরীতে ভূলোকের নীচ ও হীন অস্তিত্ববান সত্তাসমূহকে পরিত্যাগ করে নভোমণ্ডলীয় গ্রহ, জ্যোতিষ্ক ও তারকারাজির পূজা করত। ইবরাহীম (আ.) মহাজাগতিক নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের পূজা-অর্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে কতগুলো ধারাবাহিক দার্শনিক ও তাত্ত্বিক সত্য যা সে সময়ের মানুষের চিন্তা-চেতনায় উদিতই হয় নি তা অত্যন্ত সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণ ও যুক্তিসমূহ আজও জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও কালামশাস্ত্রবিদদের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে যে, পবিত্র কোরআনে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এ কারণেই আমি একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ এ কয়েক পৃষ্ঠায় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বক্তব্য উল্লেখ করব।

ইবরাহীম (আ.) জনগণকে হেদায়েত করার জন্য এক রাতে সূর্যাস্তের শুরু থেকে পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত জেগে থেকে আকাশ পর্যবেক্ষণ করলেন। এ ২৪ ঘণ্টায় তিনি পূর্বোক্ত তিন দলের সাথে আলোচনা এবং উপরিউক্ত গোষ্ঠীত্রয়ের আকীদা-বিশ্বাস মজবুত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের আলোকে খণ্ডন করেছেন।

রাতের কালো আঁধার ছেয়ে গেল এবং অস্তিত্বজগতের নিদর্শনগুলো সেই কালো আঁধারের মাঝে ঢাকা পড়ে গেল। নভোমণ্ডলীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শুক্রগ্রহ দিকচক্রবাল রেখার কোণে আবির্ভূত হলো। ইবরাহীম (আ.) শুক্রগ্রহের পূজারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বাহ্যত তাদেরই রীতিনীতি অনুসরণ করে বললেন, “এ আমার প্রভু।” যখন তা অস্ত গেল এবং এক কোণে আত্মগোপন করল তখন তিনি বললেন, “যে খোদা অস্ত যায় তাকে আমি পছন্দ করি না।” তিনি তাঁর বলিষ্ঠ এ যুক্তির আলোকে শুক্রগ্রহের পূজারীদের আকীদা-বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান এবং এর অসারত্ব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেন।

পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর দৃষ্টি চাঁদের উজ্জ্বল গোলকের ওপর নিবদ্ধ হয় যার ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য সবাইকে আকৃষ্ট করছিল। তিনি চন্দ্রপূজারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চাঁদকে উপাস্য বলে বাহ্যত স্বীকার করলেন এবং এর পরেই তিনি দৃঢ় শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমে এ বিশ্বাসের তীব্র সমালোচনা করলেন। ঘটনাক্রমে মহান আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতা চাঁদকে দিকচক্রবাল রেখায় অদৃশ্য করে ফেলল। আর সে সাথে চাঁদের সকল আলো ও ঔজ্জ্বল্যও হারিয়ে গেল। উপত্যকা ও প্রান্তর কালো আঁধারে ছেয়ে গেল। ইবরাহীম (আ.) সত্যান্বেষীদের মনোবৃত্তি নিয়ে চন্দ্রপূজারীদের অন্তরে ব্যথা না দিয়ে বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আপনি যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তাহলে আমি নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হয়ে যাব। কারণ তারকাসমূহের ন্যায় চাঁদেরও উদয়-অস্ত আছে। আর তা নিজেই এমন এক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থার অধীন যা স্থায়ী এবং যাতে বিঘ্ন ঘটানো সম্ভব নয়।”

রাতের আঁধার কেটে গেলে পূর্ব দিকের দিকচক্রবাল রেখার বক্ষভেদ করে সূর্যোদয় হলো। সূর্যের সোনালী আলো মরুপ্রান্তর, উপত্যকা ও পাহাড়ের পাদদেশ আলোকোদ্ভাসিত করল। সূর্যপূজারীরা তাদের উপাস্যের দিকে নিজেদেরকে রুজু করল। ইবরাহীম (আ.) বিতর্কের মূলনীতি সংরক্ষণ করার ছলে বাহ্যিকভাবে সূর্যকে নিজ প্রতিপালক বলে স্বীকার করলেন। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলে তিনি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করলেন যে, সূর্যও এ অস্তিত্বজগতের অমোঘ নিয়মের অধীন। এরপর তিনি সূর্যের উপাস্য হওয়ার বিষয়টি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বর্জন করেন।

তখন তিনি উপরিউক্ত গোষ্ঠীত্রয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,

...)إنّي وجّهت وجهي للّذي فطر السّموات و الأرض حنيفا و ما أنا من المشركين(

“নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডল (তথা সমগ্র অস্তিত্বকে) একনিষ্ঠ চিত্তে এমন এক সত্তার দিকে নিবদ্ধ করলাম যিনি যমীন ও আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই।” (সূরা আনআম: ৭৫-৭৯)

ইবরাহীম (আ.)-এর বক্তব্যের উপলক্ষ ছিল ঐ সব ব্যক্তি যারা চিন্তা করত যে, পার্থিবজগতের যাবতীয় অস্তিত্ববান সত্তার প্রতিপালন ও পরিচালনা, যেমন তন্মধ্যে মানব জাতির অস্তিত্ব ও সৃষ্টির বিষয়টি নভোমণ্ডলীয় জ্যোতিষ্ক ও বস্তুসমূহের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনার চাপ অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর ছিল না। যথা : ১. স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ, ২. মহান আল্লাহর সত্তার একত্ব ও তিনি যে এক ও অদ্বিতীয় এবং একাধিক খোদার অস্তিত্ব নেই-এ বিষয়টি প্রমাণ করা, ৩. স্রষ্টার একত্ব (মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন স্রষ্টা নেই অর্থাৎ নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মাত্র একজন)-এ বিষয়টি প্রমাণ, বরং ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রভুত্ব, প্রতিপালন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে তাওহীদ বা একত্ববাদ। মহান আল্লাহ্ ব্যতীত সকল অস্তিত্ববান সত্তার প্রভু, পরিচালক ও প্রতিপালক অন্য কোন সত্তা নয়-এ বিষয়টির ওপর তিনি তাঁর আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ কারণেই তিনি নভোমণ্ডলীয় জ্যোতিষ্ক ও পদার্থসমূহের প্রভুত্ব খণ্ডন করার দলিল উপস্থাপন করার পর তৎক্ষণাৎ বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডল মহান আল্লাহর দিকেই নিবদ্ধ করেছি যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা।” অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশসমূহের স্রষ্টাই এগুলোর প্রভু, প্রতিপালক ও পরিচালক। কখনই এ নিখিল বিশ্বের একাংশের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কতিপয় নভোমণ্ডলীয় জ্যোতিষ্ক ও তারকার হাতে অর্পণ করা হয় নি। আর তাই স্রষ্টা এবং পালনকর্তা ও পরিচালক এক ও অদ্বিতীয়। ব্যাপারটি এমন নয় যে, মহান আল্লাহ্ স্রষ্টা আর পালনকর্তা তিনি ব্যতীত অন্য সত্তা।

মুফাসসির ও কালামশাস্ত্রবিদগণ যাঁরা পবিত্র কোরআনের তত্ত্বজ্ঞানে গভীরভাবে চিন্তা ও আলোচনা করেছেন তাঁরা ইবরাহীম (আ.)-এর প্রদত্ত যুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিরাট ভুল করেছেন। তাঁরা ভেবেছেন যে, ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনা ও কথোপকথনের লক্ষ্য এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের খোদায়ী অস্বীকার করা। অর্থাৎ যে খোদার প্রতি পৃথিবীর সকল জাতি বিশ্বাস রাখে এবং সমগ্র অস্তিত্বজগতই যার অস্তিত্বের নিদর্শন সেই খোদার অস্তিত্ব প্রমাণ। আবার কেউ কেউ ভেবেছেন যে, ইবরাহীম (আ.)-এর উপরিউক্ত আলোচনার আসল উদ্দেশ্য এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের সৃষ্টিক্ষমতা (خالقيّة) রদ করা। কারণ অনেকেই এমন ধারণা করতে পারে যে, নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহ্ এক পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্ববান সত্তাকে সৃষ্টি করার পর কতিপয় অস্তিত্বময় সত্তার কাছে সৃষ্টিকর্তার পদ হস্তান্তর করে থাকতে পারেন। যদি উপরিউক্ত ব্যাখ্যাদ্বয় সঠিক না হয় এবং অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ববান সত্তা (واجب الوجود) এবং তাঁর তাওহীদ (একত্ব) এবং স্রষ্টার একত্বের শিরোনামে কতিপয় বিষয় মেনে নেয়ার পর ‘তাওহীদে রুবূবী’ (প্রভুত্বের ক্ষেত্রে একত্ব) নামের অন্য এক ধরনের তাওহীদ প্রসঙ্গে এবং নিখিল বিশ্বের যে একজন স্রষ্টা ও পালনকর্তা আছেন-এ ব্যাপারে আলোচনা করাই ছিল ইবরাহীম (আ.)-এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ‘নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডলকে নিবদ্ধ করলাম... “ -এ আয়াতটি বর্ণিত ব্যাখ্যার সর্বোত্তম দলিল ও সাক্ষ্যপ্রমাণ। এ কারণেই প্রতিপালক এবং তারকা, চন্দ্র ও সূর্যের মতো নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের প্রভুত্বের মধ্যেই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনার সমগ্র চাপ ও দৃষ্টি নিহিত ছিল।

আলোচনা পূর্ণ করার জন্য ইবরাহীম (আ.)-এর প্রদত্ত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণকে আমরা আরেকভাবে ব্যাখ্যা করব :

হযরত ইবরাহীম (আ.) তিন ক্ষেত্রেই এ সব নভোমণ্ডলীয় পদার্থের উদয়-অস্তকে এ বিষয়ের ওপর সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন যে, এ সকল নভোমণ্ডলীয় বস্তু পৃথিবীর প্রপঞ্চ ও ঘটনাবলী, বিশেষ করে ‘মানুষ’ নামের প্রপঞ্চটির প্রতিপালন ও পরিচালনা করার কোন যোগ্যতাই রাখে না। এখন প্রশ্ন করা যায় যে, এ সব বস্তুর উদয়-অস্ত কেন এগুলোর প্রতিপালক ও পরিচালক না হওয়ার পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলস্বরূপ?

এ বিষয়টি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা সম্ভব। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা কোন না কোন গোষ্ঠীর জন্য উপকারী। নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের প্রতিপালক ও পরিচালক হওয়ার বিষয়টি অপনোদন করা সংক্রান্ত হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রদত্ত যুক্তিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন দিক, মাত্রা ও পর্যায় রয়েছে; আর এর প্রতিটি দিক ও পর্যায় কোন না কোন গোষ্ঠীর জন্য উপস্থাপন করা যায়।

ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রদত্ত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিচে দেয়া হলো :

ক. প্রভু ও প্রতিপালক হিসাবে গ্রহণ করার লক্ষ্য হচ্ছে এই যে, দুর্বল অস্তিত্ববান সত্তা তার শক্তি ও সামর্থ্যরে আলোকে পূর্ণতার পর্যায়ে উপনীত হয়। আর এ ধরনের প্রতিপালক ও প্রশিক্ষকের অবশ্যই প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অস্তিত্ববান সত্তাদের সাথে এমন গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে যে, প্রতিপালক ও প্রশিক্ষক সর্বদা প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সত্তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকবে, তার থেকে কখনই পৃথক হবে না এবং তার সামনে উপস্থিত থাকবে।

যে অস্তিত্ববান সত্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রতিপালিত সত্তার কাছ থেকে অনুপস্থিত থাকে, সম্পূর্ণরূপে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার থেকে সরাসরি আলো ও কল্যাণ উঠিয়ে নেয়, সে কিভাবে ভূলোকের অস্তিত্ববান সত্তাসমূহের প্রশিক্ষক ও প্রতিপালক হবে? এ কারণেই তারকার উদয়-অস্ত যা মর্ত্যলোকের ঘটনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নিদর্শন তা সাক্ষ্য দেয় যে, মর্ত্যলোকের অস্তিত্ববান সত্তাসমূহের অন্য কোন প্রশিক্ষক ও প্রতিপালক আছেন যিনি এ ত্রুটি থেকে মুক্ত।

খ. নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের উদয়-অস্ত এবং এগুলোর সুশৃঙ্খল গতি সাক্ষ্য দেয় যে, এগুলো সবই আজ্ঞাধীন এবং এমন সব নিয়মের অধীন যা ঐ সব বস্তুর ওপর কর্তৃত্বকারী ও ক্রিয়াশীল। আর এ সব বস্তুর সুশৃঙ্খল নিয়মসমূহ মেনে চলাই এগুলোর দুর্বলতা ও অক্ষমতার দলিলস্বরূপ। এ ধরনের দুর্বল অস্তিত্ববান সত্তাসমূহ অস্তিত্বজগৎ এবং বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা ও প্রপঞ্চের ওপর কর্তৃত্বশীল হতে পারে না। আর পৃথিবীর অস্তিত্ববান সত্তাসমূহ যদি এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুর আলো থেকে উপকৃত হয় তাহলে তা এ সব বস্তুর প্রভুত্বের দলিল বলে গণ্য হবে না, বরং এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে এ সব বস্তু এ পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনা ও প্রপঞ্চের বরাবরে দায়িত্ব পালন করে মাত্র; অন্যভাবে বলা যায় যে, এ বিষয়টি নিখিল বিশ্বের যাবতীয় অস্তিত্ববান সত্তার মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সামঞ্জস্য, নির্ভরশীলতা ও প্রভাব বিদ্যমান আছে তা প্রমাণ করে।

গ. এ সব (নভোমণ্ডলীয়) বস্তুসমূহের গতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই বা কি হতে পারে? লক্ষ্য কি এটিই যে, এগুলো অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে অথবা এর উল্টোটি? দ্বিতীয়টি মোটেও ভাবা যায় না। আর দ্বিতীয়টি যদি কল্পনা করা হয় তাহলে অস্তিত্ববান সত্তাসমূহের প্রতিপালক ও পরিচালক এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুর পূর্ণতার পর্যায় থেকে অপূর্ণতা, অস্তিত্বহীনতা ও ধ্বংসের দিকে ধাবমান হওয়ার কোন অর্থই হয় না। আর স্বয়ং এ বিষয়টি (পূর্ণতা থেকে অপূর্ণতার পর্যায়ে অবনতি) থেকে প্রমাণিত হয় যে, অন্য এক প্রতিপালক আছেন যিনি এ সব বাহ্যত শক্তিশালী অস্তিত্ববান সত্তাকে এক পর্যায় থেকে পূর্ণতর পর্যায়ে উন্নীত করেন এবং আসলে তিনিই প্রভু ও প্রতিপালক। আর তিনিই এ সব বস্তু এবং এগুলোর অধীনে যা কিছু আছে সেগুলোকেও পূর্ণতার দিকে পৌঁছে দেন।

আযর কি ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা ছিল?

উপরিউক্ত আয়াতসমূহ, সূরা তাওবার ১১৫ নং আয়াত এবং সূরা মুমতাহিনার ১৪ নং আয়াতের বাহ্য অর্থ হচ্ছে আযর ইবরাহীম (আ.)-এর পিতৃস্থানীয় ছিল এবং হযরত ইবরাহীমও তাকে পিতা বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং সকল নবী-রাসূলের পূর্বপুরুষগণ তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী ছিলেন-এতৎসংক্রান্ত সকল শিয়া আলেমের ঐকমত্যের (ইজমা) সাথে মূর্তিপূজক আযরের ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা হওয়া মোটেও খাপ খায় না। প্রসিদ্ধ আলেম শেখ মুফিদ (রহ.) তাঁর ‘আওয়ায়েলুল মাকালাত’ নামক গ্রন্থে উপরিউক্ত বিষয়টিতে যে ইমামীয়া শিয়া আলেমদের ইজমা রয়েছে তা লিখেছেন। এমনকি অনেক সুন্নী আলেমও এ ব্যাপারে তাঁদের সাথে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। এমতাবস্থায় উপরিউক্ত আয়াতসমূহের বাহ্য অর্থের অবস্থাই বা কি হবে এবং কিভাবে এ সমস্যাটি সমাধান করতে হবে?

অনেক মুফাসসির বলেছেন যে, أب (আব) শব্দটি যদিও সাধারণত আরবী ভাষায় ‘পিতা’র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তবুও এ শব্দটির ব্যবহার কেবল ‘পিতা’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এবং কখনো কখনো আরবী ভাষা ও পবিত্র কোরআনের পরিভাষায় ‘চাচা’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন নিচের আয়াতে أب শব্দটি ‘চাচা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে :

)إذ قال لبنيه ما تعبدون من بعدي قالوا نعبد إلهك و إله ءابائك إبراهيم و إسماعيل و إسحاق إلها واحدا و نحن له مسلمون(

“যখন ইয়াকুব নিজ সন্তানদেরকে বললেন : আমার পরে তোমরা কার উপাসনা করবে? তখন তারা বলেছিল : আমরা আপনার ও আপনার পূর্বপুরুষগণ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের এক-অদ্বিতীয় উপাস্যের উপাসনা করব। আর আমরা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।” (সূরা বাকারা:  ১৩২)

নিঃসন্দেহে হযরত ইসমাঈল হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর চাচা ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন না। কারণ হযরত ইয়াকুব হযরত ইসহাকের সন্তান। আর হযরত ইসহাক হযরত ইসমাঈলের ভাই ছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও হযরত ইয়াকুবের সন্তানগণ হযরত ইয়াকুবের চাচা হযরত ইসমাঈলকে পিতা বলেছে। অর্থাৎ তারা أب শব্দটি তাঁর (ইসমাঈল) ওপরও প্রয়োগ করেছে। এ দু’ধরনের ব্যবহার সত্ত্বেও এ সম্ভাবনা থেকে যায় যে, আযরকে হেদায়েত করা সংক্রান্ত যে সব আয়াত রয়েছে সেগুলোতে উল্লিখিত أب শব্দটির কাঙ্ক্ষিত অর্থ হচ্ছে চাচা, বিশেষ করে শেখ মুফীদ যে ইজমার কথা বর্ণনা করেছেন তা থেকে। আর আযরকে ইবরাহীম (আ.) পিতা বলেছিলেন তা সম্ভবত এ কারণে যে, ইবরাহীম (আ.)-এর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দীর্ঘদিন আযরের ওপর ছিল। এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ.) তাকে পিতার ন্যায় সম্মান প্রদর্শন করতেন।

কোরআন আযরকে ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা বলে নি

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সাথে আযরের আত্মীয়তার সম্পর্ক সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করার জন্য নিম্নোক্ত দু’টি আয়াতের ব্যাখ্যার দিকে আমরা সম্মানিত পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব :

১. আরব উপদ্বীপের পরিবেশ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপার আত্মত্যাগের কারণে ঈমান ও ইসলামের নির্মল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অধিকাংশ অধিবাসীই আন্তরিকতার সাথে ঈমান আনয়ন করেছিল এবং বুঝতে পেরেছিল যে, শিরক ও মূর্তিপূজার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে দোযখ এবং শাস্তি। তারা যদিও ঈমান আনয়ন করার কারণে আনন্দিত ও প্রফুল্ল ছিল কিন্তু তাদের পিতা-মাতাদের মূর্তিপূজারী হওয়ার তিক্ত স্মৃতি স্মরণ করে তারা কষ্ট পেত। যে সব আয়াতে কিয়ামত দিবসে মুশরিকদের জীবন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা এসেছে সেগুলো শ্রবণ করা তাদের জন্য ছিল খুবই কষ্টকর ও বেদনাদায়ক। নিজেদের এ আত্মিক যন্ত্রণা লাঘব ও দূর করার জন্য তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে অনুরোধ জানাত যেন তিনি তাদের প্রয়াত অতি নিকটাত্মীয় যারা কাফির ও মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর ঠিক এভাবেই হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর চাচা আযরের জন্যও এ কাজটিই করেছিলেন। নিম্নোক্ত আয়াতটি তাদের (আরবের নবদীক্ষিত মুসলমানগণ) অনুরোধের প্রতি উত্তরস্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছিল :

)ما كان للنَّبِيِّ وَ الّذين آمنوا أنْ يَسْتَغْفِروا للمشرِكين و لو كانوا أولي قُربى مِن بعدِ ما تبيَّن لهم أنَّهم أصحابُ الجحيم و ما كان استغفارُ إبراهيمَ لأبيه إلّا عن موعدةٍ وعدها إيّاه فلمّا تبيَّن له إنَّه عدوٌّ للهِ تبرَّأ منه إنَّ إبراهيمَ لأوّاهٌ حليم(

“নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য শোভনীয় নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে যদি তারা অতি নিকটাত্মীয়ও হয়, যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ঐ সব মুশরিক জাহান্নামের অধিবাসী। আর নিজ পিতার জন্য ইবরাহীমের ক্ষমা প্রার্থনা ছিল ঐ প্রতিজ্ঞার কারণে যা তিনি তাকে (চাচা আযরকে) করেছিলেন। তবে যখন ইবরাহীমের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে (আযর) আল্লাহর শত্রু তখন তিনি তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন। নিশ্চয়ই ইবরাহীম অত্যন্ত দয়ালু ও ধৈর্যশীল।” (সূরা তাওবা : ১১৩-১১৪)

অগণিত দলিল-প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আযরের সাথে ইবরাহীম (আ.)-এর কথোপকথন এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অঙ্গীকার ইবরাহীম (আ.)-এর যৌবনেই হয়েছিল। অবশেষে ইবরাহীম (আ.) চাচা আযরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। অর্থাৎ এটি ঐ সময় হয়েছিল যখন ইবরাহীম (আ.) তাঁর জন্মভূমি বাবেল ত্যাগ করে ফিলিস্তিন, মিশর ও হিজাযে গমন করেন নি। এ আয়াত থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, যখন আযর কুফর ও শিরকের মধ্যে দৃঢ়পদ থেকেছে তখন ইবরাহীম (আ.) তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে মোটেও স্মরণ করেন নি।

২. ইবরাহীম (আ.) তাঁর জীবনের শেষভাগে একটি মহান দায়িত্ব পালন (অর্থাৎ পবিত্র কাবার পুনঃনির্মাণ কার্য সমাপ্ত করার পর) এবং পবিত্র মক্কার শুষ্ক ও মরুপ্রান্তরে নিজ স্ত্রী ও সন্তানকে আনয়ণ করার পর এমন সব ব্যক্তি সম্পর্কে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেন যার মধ্যে তাঁর পিতা-মাতাও ছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর প্রার্থনা কবুল হওয়ার জন্য এ ধরনের দোয়াও করেছিলেন,

)ربَّنا اغْفِرْلي وَلِوالِدَيَّ و للمُؤْمنين يومَ يقومُ الحِساب(

“হে আমার প্রভু! আমাদেরকে, আমার পিতা-মাতা এবং মুমিনদেরকে যেদিন বিচার (হিসাব-নিকাশ) করা হবে সেদিন ক্ষমা করে দিন।” (সূরা ইবরাহীম : ৪১)

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পবিত্র কাবাগৃহ নির্মাণ করার পরই ইবরাহীম (আ.) বৃদ্ধাবস্থায় এ প্রার্থনা করেছিলেন। যদি উক্ত আয়াতে বর্ণিত والديَّ (আমার পিতা-মাতা) যাঁরা ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর দয়া, ভালোবাসা এবং ভক্তিশ্রদ্ধার পাত্র এবং তাঁদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেছেন তিনিই যদি আযর হন তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইবরাহীম (আ.) আমৃত্যু এবং তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত আযরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন নি এবং কখনো কখনো তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন, অথচ যে আয়াতটি মুশরিকদের অনুরোধের উত্তরে বর্ণিত হয়েছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর যৌবনকালেই আযরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন এবং তার থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। আর ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ মোটেও সংগতিসম্পন্ন নয়।

এ দু’টি আয়াত পরস্পর সংযোজন করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যে ব্যক্তি যৌবনকালে ইবরাহীম (আ.)-এর ঘৃণার পাত্র হয়েছিল এবং যার সাথে তিনি সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন সেই ব্যক্তিটি ঐ ব্যক্তি থেকে ভিন্ন  যাঁকে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বদা স্মরণ করেছিলেন এবং যাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।

মূর্তি ধ্বংসকারী ইবরাহীম

উৎসবের মুহূর্ত সমাগত হয়েছে। বাবেল শহরের অমনোযোগী জনগণ ক্লান্তি দূর করা, উদ্যম পুনঃসঞ্চার ও উৎসব উদযাপন করার জন্য মরুভূমির দিকে গমন করল এবং শহর সম্পূর্ণরূপে জনশূন্য হয়ে গেল। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর উজ্জ্বল ইতিহাস এবং শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য ও নিন্দাবাদ বাবেলের জনগণকে ভীষণভাবে চিন্তিত করে তুলেছিল। এ কারণেই তারা সবাই অনুরোধ করেছিল যে, ইবরাহীমও যেন তাদের সাথে ঐ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। তবে তারা এ ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করতে থাকলে ইবরাহীম (আ.) অসুস্থতার সম্মুখীন হন। তখন তিনি إنِّي سقيم (আমি অসুস্থ অথবা আমার শরীর ভালো নেই) এ কথা বলে তাদের কথার উত্তর দিয়েছিলেন এবং উৎসবে যোগদান করা থেকে বিরত ছিলেন।

সত্যিই ঐ দিন ছিল তাওহীদবাদী ও মুশরিকদের জন্য আনন্দের দিন। মুশরিকদের জন্য ঐ দিন ছিল প্রাচীন উৎসব উদযাপনের। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা উদযাপন এবং পূর্বপুরুষদের আচার-অনুষ্ঠান পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তারা পাহাড়ের পাদদেশ ও চিরসবুজ ক্ষেত-খামারে গিয়েছিল।

আর তাওহীদের বীর পুরুষের জন্যও এটি ছিল অতি প্রাথমিক ও অভূতপূর্ব উৎসবের দিন যার আগমনের জন্য তিনি (ইবরাহীম) দীর্ঘদিন যাবত অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন শহর জনশূন্য হয়ে যাক এবং সে সুযোগে শিরক ও কুফরের যাবতীয় নিদর্শন তিনি ধ্বংস করে দেবেন।

যখন জনতার সর্বশেষ দলটি শহর থেকে বের হয়ে গেল তখন হযরত ইবরাহীম (আ.) সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসাসহকারে মন্দিরে প্রবেশ করলেন। তিনি মন্দিরের মধ্যে নিস্প্রাণ মূর্তি ও কাষ্ঠনির্মিত প্রতিমাসমূহ দেখতে পেলেন। তাবাররুক হিসাবে মূর্তিপূজকরা যে সব খাবার মন্দিরে রেখে যেত তা হযরত ইবরাহীমের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তিনি সরাসরি খাদ্যের নিকটে গেলেন। তিনি এক টুকরা রুটি হাতে নিয়ে ঐ সব মূর্তির দিকে বিদ্রূপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কেন তোমরা বিভিন্ন ধরনের খাবার খাচ্ছ না?” বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুশরিকদের হস্তনির্মিত প্রতিমাসমূহের সামান্য নড়া-চড়া করার ক্ষমতাও ছিল না। তারা খাবে কি? মন্দিরের বিরাট অঙ্গনে সুনশান নীরবতা বিরাজ করছিল। কিন্তু ইবরাহীম (আ.) মূর্তিগুলোর হাত, পা ও দেহের ওপর কুঠার দিয়ে একের পর এক আঘাত হানতে লাগলেন। যার ফলে সেখানকার নীরবতা ভেঙ্গে গেল। তিনি মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আর এভাবে মন্দিরের মধ্যে কাঠ ও ধাতুর একটি বিরাট স্তূপের সৃষ্টি হলো। তিনি কেবল বড় মূর্তিটিকে অক্ষত রেখে দিলেন এবং ঐ মূর্তিটির কাঁধে কুড়াল ঝুলিয়ে রাখলেন। তাঁর কাজের লক্ষ্য ছিল এটিই যে, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন স্বয়ং বড় মূর্তিটিই মূর্তিগুলো ধ্বংস করেছে। কিন্তু তাঁর এ বাহ্য কার্যকলাপের পেছনে একটি সুমহান উদ্দেশ্য ছিল যা বর্ণিত হওয়া উচিত। ইবরাহীম (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে, মুশরিকরা উৎসবস্থল থেকে ফিরে আসার পর মন্দিরগুলোর মূর্তিসমূহ ধ্বংস করার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করবে এবং তারা এ ঘটনার বাহ্য রূপকে এক ধরনের অন্তঃসারশূন্য অবাস্তব কার্যকলাপ বলে অভিহিত করবে। কারণ তারা বিশ্বাস করবে না যে, এ বড় মূর্তিটিই এ সব আঘাত হেনেছে যার নড়াচড়া ও কাজ করার কোন ক্ষমতাই নেই। এমতাবস্থায় হযরত ইবরাহীম (আ.) প্রচারণার দৃষ্টিকোণ থেকে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলতে পারবেন যে, তোমাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যখন এ বড় মূর্তিটির সামান্যতম ক্ষমতাই নেই তখন কিভাবে তোমরা তার উপাসনা করছ?

দিকচক্রবাল রেখার ওপর সূর্যোদয় হলো। সূর্যের আলোয় মরুপ্রান্তর ও সমতলভূমি সবকিছু আলোকিত হলো। জনগণ দলে দলে শহরে রওয়ানা হলো। প্রতিমাপূজার লগ্ন উপস্থিত হলো। একদল মন্দিরে প্রবেশ করল। এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যা দেবতাদের হীনতা ও অপদস্থতা প্রকাশ করছিল তা যুবা-বৃদ্ধ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মন্দিরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। এক ব্যক্তি সেই নীরবতা ভেঙ্গে বলল, “কোন্ ব্যক্তি এ কাজ করেছে?”  ইবরাহীম (আ.) প্রতিমাসমূহকে যে পূর্ব হতেই মন্দ বলতেন এবং মূর্তিপূজার স্পষ্ট বিরোধিতা করতেন তা সকলের জানা ছিল। তাই তারা নিশ্চিত হতে পারল যে, ইবরাহীম (আ.)-ই এ কাজ করেছেন। নমরুদের তত্ত্বাবধানে একটি বিচারসভার আয়োজন করা হলো। যুবক ইবরাহীমকে মায়ের সাথে এক সর্বসাধারণ বিচার অধিবেশনে জেরা করা হলো।

মায়ের অপরাধ ছিল এই যে, কেন তিনি তাঁর সন্তানকে গোপন রেখেছিলেন এবং শিরোচ্ছেদ করার জন্য কেন তিনি সরকারের বিশেষ দফতরে তাঁর সন্তানের পরিচিতি প্রদান করেন নি? তখন ইবরাহীম (আ.)-এর মা জেরাকারীর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “আমি দেখতে পেলাম এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার এ সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে তা না জানা পর্যন্ত আমি তার ব্যাপারে কোন তথ্য প্রদান করি নি। যদি এ ব্যক্তি (ইবরাহীম) গণক ও ভবিষ্যদ্বক্তাদের ভবিষ্যদ্বাণীতে বর্ণিত ঐ ব্যক্তিই হয়ে থাকে তাহলে আমি পুলিশকে তার ব্যাপারে অবশ্যই তথ্য প্রদান করতাম যাতে করে তারা অন্যদের রক্তপাত সংঘটিত করা থেকে বিরত থাকে। আর এ যদি ঐ ব্যক্তি না হয়ে থাকে তাহলে আমি এ দেশের এক ভবিষ্যৎ যুবপ্রজন্মকেই রক্ষা করেছি। ইবরাহীম (আ.)-এর মায়ের যুক্তি বিচারকদের দৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে আকর্ষণ করেছিল।

এরপর ইবরাহীম (আ.)-কে জেরা করার পালা আসে। তিনি বললেন, “বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, এটি বড় প্রতিমারই কাজ। আর আপনারা ঘটনা সম্পর্কে তাকেই জিজ্ঞাসা করুন। যদি তাদের (প্রতিমাদের) বাকশক্তি থেকে থাকে!” তেজোদ্দীপ্ত এ জবাব যা ব্যঙ্গ ও অবজ্ঞাপূর্ণ ছিল তা আসলে অন্য উদ্দেশ্যেই দেয়া হয়েছিল; আর তা হলো : ইবরাহীম (আ.) নিশ্চিত ছিলেন যে, তারা তাঁর জবাবে এটিই বলবে, “ইবরাহীম! তুমি তো জান, এ সব প্রতিমার বাকশক্তি নেই।” তখন তিনি একটি মৌলিক বিষয়ের দিকে বিচারকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবেন। ঘটনাক্রমে তিনি যা পূর্ব হতে উপলব্ধি করেছিলেন তা-ই হলো। তাদের এ কথা মূর্তিগুলোর দুর্বলতা, অপদস্থতা ও অসামর্থ্যরেই পরিচায়ক ছিল। ইবরাহীম (আ.) জবাবে বললেন, “আসলেই যদি প্রতিমাগুলোর অবস্থা এমন হয় যা তোমরা বর্ণনা করেছ তাহলে কেন তোমরা তাদের উপাসনা করছ এবং তাদের কাছে নিজেদের মনস্কামনা প্রার্থনা করছ?!”

অজ্ঞতা, গোঁড়ামি, অন্ধভক্তি ও অনুসরণ বিচারকদের মন-মানসিকতার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল এবং ইবরাহীম (আ.)-এর দাঁতভাঙ্গা জবাবে তারা একদম নিরুপায় হয়ে পড়ে; তাই তারা ইবরাহীম (আ.)-কে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করার পক্ষে রায় দিল। অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করা হলো এবং তাওহীদের অমিত বিক্রম পুরুষ ইবরাহীম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে নিক্ষেপ করা হলো। কিন্তু ইবরাহীম (আ.)-এর প্রতি মহান আল্লাহ্ দয়া ও অনুগ্রহের হস্ত প্রসারিত করলেন এবং তাঁকে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন। মহান আল্লাহ্ মনুষ্য নির্মিত দোযখকে (অগ্নিকুণ্ডকে) চিরসবুজ পুষ্পোদ্যানে রূপান্তরিত করলেন।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর হিজরত

ব্যাবিলনের বিচারালয় হযরত ইবরাহীমকে বহিষ্কার করার পক্ষে রায় দিল। আর তিনিও বাধ্য হয়ে নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে ফিলিস্তিন ও মিশরের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে ফিলিস্তিনের শাসকবর্গ আমালিকগণ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। তারা তাঁকে প্রভূত উপঢৌকন প্রদান করে। তাদের প্রদত্ত উপঢৌকনসমূহের মধ্যে হাজার (হাজেরা) নাম্নী এক দাসীও ছিল।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর স্ত্রী সারাহ্ ঐ সময় পর্যন্ত মা হন নি (অর্থাৎ ইবরাহীম ও সারাহ্ দম্পতি তখনও নিঃসন্তান ছিলেন)। এ ঘটনা প্রাণপ্রিয় স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আবেগকে আরো বৃদ্ধি করল। তিনি (হযরত সারাহ্) দাসী হাজারের (হাজেরার) সাথে সহবাস করার জন্য ইবরাহীম (আ.)-কে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন এতদুদ্দেশ্যে যে, নিঃসন্তান ইবরাহীম (আ.) সম্ভবত হাজেরার মাধ্যমে সন্তানের জনক হতে পারেন। আর এর ফলে তাঁদের জীবন সন্তানের দ্বারা আলোকিত হয়ে যাবে। বিবাহ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হলো। হযরত হাজেরা কিছুদিন পরে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন যাঁর নাম ‘ইসমাঈল’ রাখা হলো। এর অল্প দিন পরেই হযরত সারাহ্ও মহান আল্লাহর অপার কৃপা ও করুণায় গর্ভধারণ করলেন। মহান আল্লাহ্ তাঁকে একটি পুত্রসন্তান দিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.) যাঁর নাম ‘ইসহাক’ রেখেছিলেন।

কিছুকাল পরে হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসমাঈল (আ.)-কে তাঁর মাতাসহ দক্ষিণে অর্থাৎ পবিত্র মক্কার অখ্যাত এক উপত্যকায় আবাসন দেয়ার আদেশপ্রাপ্ত হলেন। এ উপত্যকায় কোন মনুষ্য বসতি ছিল না। শাম থেকে ইয়েমেন এবং ইয়েমেন থেকে শামে যে সব কাফেলা যাতায়াত করত কেবল তারাই উক্ত উপত্যকায় (বিশ্রামের জন্য) সাময়িকভাবে তাঁবু স্থাপন করত। এছাড়া বছরের বাকী সময় এ উপত্যকা আরব উপদ্বীপের অন্য সকল অঞ্চলের মতোই মানবশূন্য উত্তপ্ত মরুপ্রান্তর হিসাবেই পড়ে থাকত।

এ ধরনের ভীতিপ্রদ অঞ্চলে বসবাস আমালিকদের দেশে বসবাসরত একজন নারীর জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও অসহনীয় ব্যাপার ছিল।

মরুভূমির দগ্ধকারী উত্তাপ ও এর উষ্ণ বাতাস তাঁর চোখের সামনে যেন মৃত্যুর ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তিকে উপস্থাপন করেছিল। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে বিধায় আর ইবরাহীম (আ.) নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সওয়ারী পশুর লাগাম ধরে অশ্রুসজল নয়নে স্ত্রী ও পুত্রকে বিদায় জানানোর সময় হযরত হাজেরাকে বললেন, “হে হাজেরা! এ সব কিছু মহান আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী করা হয়েছে। আর তাঁর আদেশ পালন করা থেকে পালিয়ে বেড়াবার কোন পথ নেই। মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার ওপর নির্ভর কর। আর নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস কর যে, তিনি আমাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করবেন না।” এরপর তিনি মহান আল্লাহর কাছে একাগ্রতা সহকারে প্রার্থনা করে বললেন :

)ربِّ اجعل هذا بلداً آمناً و ارْزُقْ أهْله مِنَ الثّمرات مَنْ آمنَ منهم باللهِ و اليومِ الآخرِ(

“হে প্রভু! এ স্থানকে নিরাপদ শহর ও জনপদে পরিণত কর। এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহ্ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের ফল ও খাদ্য রিযিক হিসাবে প্রদান কর।” (সূরা বাকারা : ১২৬)

আর যখন তিনি টিলা বেয়ে নিচে নামছিলেন তখন তিনি পেছনের দিকে তাকিয়ে তাঁদের জন্য মহান আল্লাহর দয়া, কৃপা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন।

এ হিজরত ও ভ্রমণ বাহ্যত অত্যন্ত কষ্টকর হলেও পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তা সুমহান ফলাফল ও পরিণতি বয়ে এনেছিল। কারণ কাবাগৃহ নির্মাণ, তাওহীদে বিশ্বাসীদের জন্য সুমহান ও সুবৃহৎ ঘাঁটির গোড়াপত্তন, অত্র এলাকায় তাওহীদের ঝাণ্ডা উত্তোলন এবং এক গভীর ধর্মীয় আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন-যা এতদঞ্চলে সর্বশেষ নবী কর্তৃক বাস্তবায়িত হবে-আসলে এগুলোই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এ সুমহান হিজরতের মহাপরিণতি বা ফলাফল বলে গণ্য।

যমযম কূপ আবিষ্কার

হযরত ইবরাহীম (আ.) সওয়ারী পশুর লাগাম হাতে ধরে অশ্রুসজল নেত্রে পবিত্র মক্কায় বিবি হাজেরা এবং নিজ সন্তান ইসমাঈলকে ত্যাগ করে রওয়ানা হলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে গেল এবং হাজেরার স্তন্য শুকিয়ে গেল। সন্তান ইসমাঈলের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে গেল। মা হযরত হাজেরার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সাফা পাহাড়ের পাথরগুলোর কাছে উপস্থিত হলেন। মারওয়া পাহাড়ের কাছে যে মরীচিকা ছিল তা দূর থেকে তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে তিনি দৌড়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছলেন। তবে প্রহেলিকাময় প্রাকৃতিক এ দৃশ্যের তিক্ততা তাঁর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক হয়েছিল। তাঁর শিশুসন্তানের অনবরত গগনবিদারী ক্রন্দনধ্বনি এবং সঙ্গীন অবস্থা তাঁকে সবচেয়ে বেশি কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছিল। আর এর ফলে তিনি (পানির খোঁজে) যত্রতত্র ছুটাছুটি করতে লাগলেন। তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে পানির আশায় সাত বার আসা-যাওয়া করলেন। কিন্তু অবশেষে নিরাশ হয়ে সন্তানের কাছে ফিরে আসলেন।

দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলের শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো গোনা যাচ্ছিল (ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তাঁর প্রাণ এতটা ওষ্ঠাগত হয়েছিল যে, তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস অত্যন্ত ধীর ও টানা-টানা হয়ে গিয়েছিল এবং তা গণনা করা যাচ্ছিল)। এর ফলে তাঁর ক্রন্দন ও চিৎকার করার শক্তিও যেন রহিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রার্থনা কবুল হলো। ক্লান্তশ্রান্ত মা দেখতে পেলেন ইসমাঈলের পায়ের তলদেশ থেকে স্বচ্ছ পানি বের হচ্ছে। যে মা সন্তানের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং নিশ্চিত ছিলেন যে, আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সন্তানের প্রাণপাখি দেহ থেকে বের হয়ে যাবে, তিনি এ পানি দেখে এতটা আনন্দিত হলেন যে যার কোন সীমা ছিল না এবং তাঁর চোখে জীবনের আলো ও দ্যুতি চমকাচ্ছিল। ঐ স্বচ্ছ পানি পান করে তিনি নিজে ও তাঁর সন্তানের তৃষ্ণা মেটালেন। হতাশা ও নিরাশার কালো মেঘ যা তাঁদের জীবনের আকাশে ছায়া বিস্তার করেছিল তা মহান আল্লাহর দয়ার মৃদুমন্দ সমীরণের দ্বারা দূরীভূত হয়ে গেল।

এ ঝরনাটি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ‘যমযম ঝরনা’ নামে পরিচিত। এ ঝরনাটির উদ্ভব হওয়ার কারণে সেটির ওপর পাখির আনাগোনা শুরু হয়। জুরহুম গোত্র যারা উক্ত উপত্যকা থেকে দূরবর্তী এক অঞ্চলে বসবাস করত তারা পাখিদের আনাগোনা ও উড়ে বেড়ানো থেকে নিশ্চিত হলো যে, ঐ উপত্যকার আশেপাশে কোথাও পানি পাওয়া গেছে। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য জুরহুম গোত্র দু’ব্যক্তিকে সেখানে প্রেরণ করল। তারা অনেক অনুসন্ধান করার পর মহান আল্লাহর রহমতের এ কেন্দ্রবিন্দুর সাথে পরিচিত হলো। যখন তারা হযরত হাজেরার কাছে আসলো তখন দেখতে পেল যে, একজন রমণী এক সন্তানের সাথে উক্ত পানির ধারে (যমযমের পাশে) বসে আছেন। তারা তৎক্ষণাৎ ফিরে গিয়ে এ ব্যাপারটি গোত্রপতিদেরকে জানাল। জুরহুম গোত্র দলে দলে রহমতের এ ঝরনাধারার চারপাশে তাঁবু স্থাপন করল। একাকিত্বের তিক্ততা যা হযরত হাজেরাকে ঘিরে রেখেছিল তা এখন বিদূরিত হয়ে গেল। ইসমাঈল (আ.) সেখানে শশীকলার ন্যায় বেড়ে উঠতে লাগলেন এবং বসতিস্থাপনকারী জুরহুম গোত্রের সাথে তাঁদের মেলামেশার কারণে ইসমাঈল (আ.) জুরহুম গোত্রে বিবাহ করেছিলেন। আর এ বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে তিনি জুরহুম গোত্রের যথেষ্ট সামাজিক সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসমাঈল (আ.) এ গোত্রেরই এক মেয়েকে বিয়ে করলেন। আর এ কারণেই হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধরগণ মায়ের মাধ্যমে এ গোত্রের সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ে।

পুনরায় দেখা-সাক্ষাৎ

মহান আল্লাহর আদেশে প্রাণপ্রিয় সন্তান ইসমাঈলকে তাঁর মা হাজেরার সাথে মক্কায় রেখে আসার পর সন্তানকে দেখার জন্য হযরত ইবরাহীম কখনো কখনো পবিত্র মক্কা অভিমুখে সফর করতেন। তিনি খুব সম্ভবত তাঁর প্রথম সফরে যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তিনি পুত্র ইসমাঈলকে ঘরে পেলেন না। ঐ সময় ইসমাঈল (আ.) শক্ত-সামর্থ্যবান যুবকে পরিণত হয়েছিলেন এবং জুরহুম গোত্রের এক রমণীকে বিয়ে করেছিলেন। ইবরাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.)-এর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার স্বামী কোথায়?” তখন সে উত্তরে বলেছিল, “সে শিকারে গিয়েছে।” এরপর তিনি ঐ মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের কাছে খাবার আছে কি?” সে তখন বলেছিল, “না, নেই।” ইবরাহীম (আ.) পুত্রবধুর এ নিষ্ঠুর আচরণে খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। তাই তিনি বললেন, “ইসমাঈল যখনই শিকার থেকে ফিরবে তখন আমার পক্ষ থেকে তাকে সালাম জানাবে। আর তাকে বলবে : তোমার ঘরের চৌকাঠটি (স্ত্রী) পাল্টে ফেলবে।” এ কথা বলে তিনি যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সে পথেই তাঁর লক্ষ্যস্থলের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন।

ইসমাঈল (আ.) শিকার থেকে ফিরে এসেই পিতার সুঘ্রাণ পেলেন এবং স্ত্রীর কথাবার্তা থেকেও নিশ্চিত হলেন যে, আগন্তুক ব্যক্তিটি ছিলেন তাঁর পিতা ইবরাহীম (আ.)। আর তিনি পিতার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পিতা তাঁকে তাঁর বর্তমান স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করার আদেশ দিয়েছেন। কারণ এমন রমণী তাঁর সহধর্মিণী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।

কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারে যে, হযরত ইবরাহীম (আ.) কেন এত দীর্ঘ পথ ও দূরত্ব অতিক্রম করেও ছেলের শিকার থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না এবং তিনি কিভাবে শত শত ফারসাখ দূরত্ব অতিক্রম করে সন্তানের সাথে দেখা না করেই ফিরে যেতে পারলেন?

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, তিনি স্ত্রী সারাহকে কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি এর চেয়ে বেশি বিলম্ব করবেন না। এ প্রতিশ্রুতিই ছিল তাঁর ত্বরা করার কারণ। যাতে করে তিনি তাঁর কথার খেলাপ না করেন সেজন্য তিনি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেন নি। এ সফরের পরে তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র মক্কা সফর করার জন্য পুনরায় আদিষ্ট হয়েছিলেন। হযরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পবিত্র কাবাগৃহের পুনঃনির্মাণ এবং একত্ববাদী বিশ্বাসীদের অন্তঃকরণ এ গৃহের পানে নিবদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

পবিত্র কোরআন সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনের শেষভাগে পবিত্র কাবা পুনঃনির্মাণের পর পবিত্র মক্কার মরু এলাকা শহরে পরিণত হয়েছিল। কারণ হযরত ইবরাহীম (আ.) নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হওয়ার পর মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন :

)ربِّ اجعلْ هذا البلدَ آمناً و اجنُبْني و بنيَّ أنْ نعبدَ الأصنام(

“হে প্রভু! এ শহরকে নিরাপদ নগরী করে দিন; আর আমাকে ও আমার বংশধরদেরকে মূর্তিপূজা করা থেকে বিরত রাখুন।” (সূরা ইবরাহীম : ৩৫)

হযরত ইবরাহীম (আ.) মক্কার মরুভূমিতে প্রবেশ করার সময় এ প্রার্থনা করেছিলেন,

)ربِّ اجعل هذا بلداً آمناً(

“হে আমার প্রভু! এ স্থানকে নিরাপদ নগরীতে পরিণত করে দিন।” (সূরা বাকারা : ১২৬)

(চিরভাস্বর মহানবী (সা.) গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)