আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(২৯তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১০৪-১০৯

সূরা নিসার ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَلَا تَهِنُوا فِي ابْتِغَاءِ الْقَوْمِ إِنْ تَكُونُوا تَأْلَمُونَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُونَ كَمَا تَأْلَمُونَ وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لَا يَرْجُونَ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ((১০৪

"হে মুমিনগণ! জিহাদের ময়দানে শত্রুদের অনুসরণে শিথিল হয়ো না, যদি তোমরা কষ্ট পাও তবে তারাও তোমাদের অনুরূপ কষ্ট পায় এবং আল্লাহর কাছ থেকে তোমাদের যে ভরসা আছে, তাদের সে ভরসাও নেই৷ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় ৷" (৪:১০৪)

ঐতিহাসিক বর্ণনায় বলা হয়েছে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হলে মক্কার কাফেররা মদীনায়ও হামলার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ইসলাম ও অবশিষ্ট মুসলমানরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়৷ এ অবস্থায় এই আয়াত নাযিল হলে মহানবী (সা.) সব মুসলমানকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দেন ৷ এ নির্দেশ পেয়ে যুদ্ধাহত মুসলমানরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়৷ মুসলমানরা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শুনে মক্কার কাফের বাহিনী নতুন করে হামলার চিন্তা পরিত্যাগ করে ৷

যুদ্ধের সাধারণ বিষয় হলো এটা যে, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয় পক্ষেরই কিছু সেনা হতাহত ও বন্দী হয়৷ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-তাদের লক্ষ্য ও পরিণতি৷ ইসলামের সেনারা আল্লাহর গায়েবী সাহায্যের উপর ভরসা রাখে৷ কিন্তু কাফের সেনাদের সে আশ্রয় বা ভরসা নেই৷ আহত ও শহীদ মুসলমানরা বেহেশতের মত মহাপুরস্কার পাবে৷ কিন্তু নিহত কাফেররা পরকালে বিশ্বাসী নয় বলে তাদের কোন ভালো পরিণতি নেই৷

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো,

প্রথমত: অবিশ্বাসী শত্রুদের কাছে কোন কোন সময় পরাজয়ের কারণে তাদের প্রতি কঠোরতায় শিথিলতা করা উচিত নয়৷ আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা রেখে মুসলমানদেরকে সব সময়ই মনোবল শক্তিশালী রাখতে হবে৷

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর দয়ার উপর ভরসা করা মুসলমান যোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি৷ তাই শহীদ হওয়া এবং বিজয় উভয়ই তাদের জন্য সৌভাগ্য৷

তৃতীয়ত: ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য যেসব কষ্ট ও ত্যাগ-তীতিক্ষা করা হয়েছে, সেসব বিফলে যাবে না৷ আল্লাহ সব কিছুই মনে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর হেকমত বা প্রজ্ঞা অনুযায়ী পুরস্কৃত করেন ৷

সূরা নিসার ১০৫ ও ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا (১০৫) وَاسْتَغْفِرِ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا ((১০৬

"নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষদেরকে আদেশ দেন বা তাদের ব্যাপারে ন্যায় বিচার করেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিখিয়েছে৷ আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হবেন না ৷" (৪:১০৫)

"আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন৷ নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়৷" (৪:১০৫)

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, এক মুসলমান একটি ঢাল চুরি করে কেলেঙ্কারী বা বদনাম এড়ানোর জন্য ঢালটি এক ইহুদীর কাছে ঘরে নিক্ষেপ করে এবং ঐ ইহুদীকে চোর হিসাবে সাব্যস্ত করার জন্য তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিতে নিজ বন্ধুদের অনুরোধ জানায় ৷ মহানবী (সা.) এ সব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ঐ মুসলমান ব্যক্তিকে নির্দোষ ঘোষণা করেন এবং ইহুদী ব্যক্তিটিকে চুরির জন্য অভিযুক্ত করেন৷ এ অবস্থায় আল্লাহ ওহী নাযেল করে তাঁকে আসল ঘটনা জানিয়ে দেন৷বিচার করার সময় বিচারককে উভয় পক্ষের কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে এবং এমন উপায় বের করতে হবে, যাতে অপরাধীরা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ না পায়৷ ঢাল চুরির ঘটনায় আইনের অপব্যবহার রোধের জন্য ওহী নাযেল করার দরকার ছিল এবং আল্লাহর সাহায্যের ফলে নবুওতের সত্যতা ও আল্লাহর সাথে মহানবী(সা.)এর সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত হবার পাশাপাশি নির্দোষ ব্যক্তিও শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেল৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল,

প্রথমত : পবিত্র কোরআনের বাণী নাযেলের উদ্দেশ্য হল মানুষের কাছে সত্য ও বাস্তবতা তুলে ধরা৷ কারণ পবিত্র কোরআন সমস্ত সত্য ও মানুষের প্রকৃত অধিকারের ভিত্তি৷ তাই বিচার কার্যের জন্যও পবিত্র কোরআনই সর্বোত্তম মানদণ্ড৷ অর্থাৎ বিচারকদেরকে পবিত্র কোরআনের আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে৷

দ্বিতীয়ত : কেউ শাস্তি পেলেই তা ঐ ব্যক্তির অপরাধের প্রমাণ নয় বা তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা ঠিক হবে না৷ কোন বিধর্মীও যদি নির্দোষ হয়, তাহলেও তাকে রক্ষা করতে হবে ৷

সূরা নিসার ১০৭, ১০৮ ও ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَلَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِينَ يَخْتَانُونَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا أَثِيمًا (১০৭) يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللَّهِ وَهُوَ مَعَهُمْ إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَى مِنَ الْقَوْلِ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطًا (১০৮) هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ جَادَلْتُمْ عَنْهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فَمَنْ يُجَادِلُ اللَّهَ عَنْهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْ مَنْ يَكُونُ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا ((১০৯

"যারা নিজের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনি তাদের পক্ষে কথা বলবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক পাপীদের ভালোবাসেন না৷" (৪:১০৭)

"তারা মানুষের কাছে পাপ গোপন করে, কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে গোপন করতে পারে না ৷ কারন তিনি তাদের সঙ্গে রয়েছেন, যখন তারা রাতে এমন বিষয়ে পরামর্শ করে যাতে আল্লাহ সম্মত নন ৷ তারা যা কিছু করে সবই আল্লাহর আয়ত্তাধীন ৷" (৪:১০৮)

"সাবধান, তোমরা পার্থিব জীবনে না হয় বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে কথা বলছো, কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে কে তাদের পক্ষে কথা বলবে অথবা সেদিন কে তাদের উকিল হবে ?"(৪:১০৯)

মহান আল্লাহ এই তিন আয়াতে তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ৷ বিচারকদের বলা হচ্ছে, বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে যেন তারা বিচার না করে এবং সত্য লঙ্ঘন না করে৷ আল্লাহ তাদের কাজ সম্পর্কে জানেন না এটাও যেন তারা মনে না করে বরং আল্লাহ তাদের সব কাজই দেখছেন৷ এরপর বিশ্বাসঘাতক অপরাধী ও তাদের সহযোগী এই দুই শ্রেণীকে বলা হচ্ছে, তোমাদের প্রতারণা যদি ইহকালে সফলও হয় তবুও পরকালে তা কোনই কাজে আসবে না৷ ১০৭ নম্বর আয়াতে একটা চমৎকার বিষয় বলা হয়েছে ৷ আর তা হলো,বিশ্বাসঘাতকরা যতটা না অন্যদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তার চেয়েও বেশী জুলুম ও বিশ্বাসঘাতকতা করছে নিজের ওপর৷ কারণ প্রথমত: সে খোদার দেয়া পবিত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে এবং পবিত্র ও ন্যায় বিচারকামী মন থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷ দ্বিতীয়ত: সে তার আচরণের মাধ্যমে নিজের ওপর অন্যদের জুলুম ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ সুগম করেছে৷

এসব আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

প্রথমত: পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে সমাজের সমস্ত মানুষ একটি দেহের মত৷ এখানে অন্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নিজের ওপর বিশ্বাসঘাতকতারই শামিল৷

দ্বিতীয়ত: তাক্বওয়া বা খোদাভীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হল, আল্লাহ সব কিছু দেখছে, শুনছেন এবং আমাদের সব কথা ও কাজের ওপর তার পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে বলে বিশ্বাস করা ৷

তৃতীয়ত: কাজী হয়তো বাহ্যিক প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীকে ছেড়ে দেবেন৷ কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহ বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিফল দিবেন এবং নিপীড়িত ব্যক্তিরা ইহকালে তাদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে ও তাদের অধিকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেও মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদেরকে ন্যায্য প্রতিদান দেবেন ৷

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)