আল হাসানাইন (আ.)

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-৪):ইমামত

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

 

ইমামত সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

 

আমরা বিশ্বাস করি যে,ইমামত হলো দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহের একটি যার উপর বিশ্বাস ব্যতীত ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। এক্ষেত্রে পূর্বপুরুষ,আত্মীয়-স্বজন ও শিক্ষক কাউকেই অনুসরণ করা বৈধ নয় যদিও তারা উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। বরং এর উপর অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা ও নিরীক্ষা চালানো জরুরী। যেমন- তা জরুরী হলো তাওহীদ ও নবুওয়াতের ক্ষেত্রে।

ন্যূনতমপক্ষে,কারো উপর অর্পিত শরীয়তের কোন বিষয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে তার ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক বিশ্বাসের উপর। সুতরাং যদি কেউ মনে করে যে,ইমামতের ব্যাপারটি দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহের অন্তর্গত নয়,তথাপি তাকে ইমামতের ধারণাকে পরীক্ষা করে নিতে হবে যদি এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। কিন্তু কারো অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না। আমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ধরে নিই যে আমরা সকলেই ইসলামী বিধান অনুসারে চলতে বাধ্য কিন্তু আমরা সঠিকভাবে সে হুকুমগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত নই। তবে ঐ সকল ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বস্ত কারো শরনাপন্ন হতে হবে যার ফলে আমরা এর (ভুল-ত্রুটি) দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে পারি। শীয়া মাযহাবের বিশ্বাস মোতাবেক বর্ণিত এমন ব্যক্তিবর্গ হলেন আহলে বাইতের ইমামগণ (আ.)। আবার অন্যদের দৃষ্ঠিকোণ থেকে অন্য কেউ।

আমরা বিশ্বাস করি যে,নবুওয়াতের মতই ইমামতও হলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও করুণা। সুতরাং প্রত্যেক যুগেই পথ প্রদর্শক ইমাম থাকা আবশ্যক যিনি মানুষের হেদায়াতকারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের সংবাদদাতা হিসেবে মহানবীর (সা.) প্রতিনিধিত্ব করবেন। মহানবী (সা.) সর্বসাধারণের উপর যেরূপ সার্বজনীন বেলায়াত বা কর্তৃত্ব করতেন তিনি সেরূপ কর্তৃত্ব করবেন জনগণকে যাবতীয় কল্যাণের পথে পরিচালনা করার জন্য,ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য,অন্যায়-অত্যাচার নির্মূল করার জন্য এবং তাদের পারস্পরিক শত্রুতা দূর করার জন্য।

অতএব,ইমামত হলো প্রকারন্তরে নবুওয়াতের মিশনেরই ধারাবাহিকতা। নবী ও রাসূল প্রেরণ যে কারণে আবশ্যক ঠিক একই কারণেই রাসূলের পরে ইমাম নিযুক্ত করাও আবশ্যক। আর একারণেই আমরা বলি,ইমাম কেবলমাত্র মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই নবীর মাধ্যমে অথবা পূর্ববর্তী ইমামের মাধ্যমেই নিয়োগ লাভ করেন। মানুষের ইচ্ছা বা রায়ের কোন অধিকার এখানে নেই। সুতরাং বিষয়টি এমন নয় যে মানুষ যখন যাকে ইচ্ছে করবে তাকে ইমাম বানাবে,আবার যখন যাকে ইচ্ছে করবে তাকে প্রত্যাখান করবে। অনুরূপভাবে,তাদের পক্ষে ইমাম ব্যতীত টিকে থাকা সম্ভব নয়। মহানবী (সা.) থেকে এক মোস্তাফিজ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে –

“যদি কেউ তার যামানার ইমামকে না চিনে মৃত্যুবরণ করে,তবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু।”

সুতরাং এমন কোন সময় থাকা সম্ভব নয় যখন আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত কোন ইমাম থাকবেন না। এখন মানুষ তাকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করুক বা না করুক,তাকে সাহায্য করুক বা না করুক,তাকে মান্য করুক বা না করুক,তিনি প্রকাশ্যে থাকুন বা লোক চক্ষুর আড়ালে থাকুন তাতে কিছু যায় আসে না। যদি মানুষের নিকট থেকে গুহায় এবং পাহাড়ী পথে আত্মগোপন করা মহানবীর (সা.) জন্যে সঠিক হয়,তবে ইমামের জন্যও তা সঠিক। অপরদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ আত্মগোপন সুদীর্ঘ হোক বা নাতিদীর্ঘ হোক তাতে কোন তফাৎ নেই। মহান আল্লাহ বলেন-

“প্রত্যেক জাতির জন্য্ইে রয়েছে পথ প্রদর্শক।”(সূরা রা’দ- ৮)

তিনি আরও বলেন-

“এমন কোন জাতি ছিলনা যেখানে ভয় প্রদর্শনকারী ছিল না।”(সুরা ফাতির -২২)

ইমামের পবিত্রতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে,ইমামগণেরও (আ.) নবীগণের (আ.) মতই প্রকাশিত অপ্রকাশিত সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক। অনুরূপ তারা সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির উর্ধে। কারণ ইমামগণ (আ.) হলেন শরীয়তের রক্ষাকারী ও প্রতিষ্ঠাতা,যেরূপ করেছিলেন নবী (সা.)। যে কারণে নবীদের পবিত্রতায় বিশ্বাস করা আমাদের জন্য আবশ্যক ঠিক একই কারণে ইমামগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করাও আমাদের জন্য আবশ্যক। এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই। আরবীতে একটা প্রবাদ আছে-

“আল্লাহর পক্ষে এটা অসম্ভব নয় যে তিনি সমস্ত গুণকে একজনের মধ্যে পুঞ্জীভূত করতে পারেন।“

ইমামের জ্ঞান ও গুণাবলী সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে,ইমামেরও মহানবীর (সা.) মত বীরত্ব,মহত্ত্ব ,আত্মসম্মান,সত্যবাদিতা,ন্যায় পরায়ণতা,বিচক্ষনণতা,জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও নৈতিকতা ইত্যাদি পরিপূর্ণ গুণের ক্ষেত্রে সবার সেরা হওয়া আবশ্যক। আর এক্ষেত্রে নবীর (সা.) শ্রেষ্টত্বের জন্য যে দলিল প্রযোজ্য ইমামের শ্রেষ্ঠত্বের জন্যও সেই একই দলিল প্রযোজ্য।

ইমাম তার শিক্ষা,ঐশী হুকুমসমূহ এবং সমস্ত জ্ঞান নবীর মাধ্যমে কিংবা তার পূর্ববর্তী ইমামের মাধ্যমে লাভ করে থাকেন। যদি কোন নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি হয় তবে তিনি তা আল্লাহ প্রদত্ত তার পবিত্র আত্মিক যোগ্যতার কারণে এলহামের মাধ্যমে জানতে পারেন। সুতরাং তিনি যখন কোন কিছুর প্রতি মনোনিবেশ করেন ও তার স্বরূপ উদঘাটন করতে প্রয়াসী হন তখন কোন প্রকার ভুল-ত্রুটি ব্যতীতই ঐ বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত হন। আর এ জন্য তাকে কোন প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল কিংবা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হয় না। তথাপি তাদের জ্ঞান ততোধিক বৃদ্ধি ও দৃঢ়করণ সম্ভব। (অর্থাৎ এমন নয় যে তাদের জ্ঞান এমন পর্যায়ে আছে যে আর বাড়তে পারে না।)

এ জন্যে মহানবী (সা.) তার দোয়ায় বলতেন-

“প্রভু হে! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।”

মনস্তাত্বিক আলোচনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে,প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন ঘটনা অন্ততঃ দু’একবার ঘটে থাকে যে,সে তার অনুমান শক্তির মাধ্যমে কোন বিষয়ের জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটিও এলহামের একটি অংশ। কারণ,মহান আল্লাহই তাকে এ শক্তি দিয়েছেন। আর এ অনুমান-শক্তি ব্যক্তিভেদে দুর্বল বা শক্তিশালী কিংবা কম বা বেশী হতে পারে। যাহোক এমন একটি মুহুর্তে মানুষের অন্তর এক ধরনের জ্ঞান লাভ করে থাকে। অথচ এজন্য তাকে চিন্তা,দলিলের অবতারণা কিংবা শিক্ষকের শরণাপন্ন হতে হয় না। প্রত্যেকেই তার জীবনে অসংখ্যবার এ ধরনের সুযোগ লাভ করে। সুতরাং মানুষের পক্ষে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ উৎকর্ষে পৌঁছা সম্ভব। আর এ ব্যাপারে সমসাময়িক ও প্রাক্তন উভয় যুগের দার্শনিকগণ আলোচনা করেছেন।

সুতরাং আমরা মনে করি ইমাম এলহাম লাভের সর্বোচ্চ যোগ্যতায় পৌঁছে যান এবং আমরা বলি এটা আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি। ফলে তার পবিত্র পরিশুদ্ধ আত্মার মাধ্যমে তিনি যে কোন অবস্থায় যে কোন মুহুর্তে যে কোন বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। সুতরাং তিনি যখন কোন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন ও সে সম্পর্কে জানতে চান তখন কোন প্রকার নাম ভূমিকা বা শিক্ষা ব্যতীতই তার এ পবিত্র এলহাম শক্তির মাধ্যমেই ঐ বিষয়ে অবগত হন। তিনি যখন কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তখন তা তার পবিত্র আত্মার উপর সুষ্পষ্টরূপে আপতিত হয় যেমন আপতিত হয় নির্মল আয়নার উপর কোন বস্তুর প্রতিচ্ছবি।

পবিত্র ইমামগণের (আ.) জীবন ইতিহাস থেকে এ ব্যাপারটি সুষ্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। আমরা দেখতে পাই যে,মহানবীর (সা.) মত ইমামগণও শৈশব জীবনের কোন সময়ই কারো নিকট প্রশিক্ষণ লাভ করেননি,কোন শিক্ষকের শরণাপন্ন হননি-এমনকি লেখাপড়াও করেননি। তাদের জীবনে এমন কোন লেখক ও শিক্ষক দেখা যায় না যে তাদেরকে জ্ঞান দিয়েছেন। অথচ তারা হলেন পৃথিবীতে সমস্ত জ্ঞানের আধার এবং অতুলনীয়। সুতরাং তাদের জীবনে এমন কোন প্রশ্ন আসেনি যার তাৎক্ষনিক জবাব তারা দেননি। তারা কখনো "জানিনা’কথাটি উচ্চারণ করেননি। এমন কোন প্রশ্ন ছিল না যার জন্যে তারা কালক্ষেপণ করেছিলেন কিংবা চিন্তার আশ্রয় নিয়েছিলেন।

অপরদিকে এমন কোন ইসলামী পন্ডিত বক্তা কিংবা বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তার জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন যে,তিনি পড়ালেখা করেননি কিংবা কোন পন্ডিতের নিকট জ্ঞানার্জন করেননি অথবা কোন বিষয়ের জ্ঞানে তার কোন সন্দেহ নেই। কারণ মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি এরকমই।

ইমামগণের (আ.) আনুগত্য সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে,ইমামগণ (আ.) হলেন সেই কর্তৃপক্ষ যাঁদের আনুগত্য করা মহান আল্লাহ আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক করেছেন। তারা মানুষের জন্য স্বাক্ষী। তারা হলেন আল্লাহর পথে দ্বার স্বরূপ ও পথ নির্দেশক। তার (আল্লাহর) জ্ঞানের সংরক্ষক,ওহীর ব্যাখ্যাকারী,তাওহীদের স্তম্ভ,তার মারেফাতের তত্ত্বাবধায়ক। তারা পৃথিবীর মানুষের নিরাপত্তা বিধায়ক। যেমন- নক্ষত্ররাজি আকাশবাসীর নিরাপত্তা বিধায়ক,যা মহানবীর (সা.) বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি। মহানবী (সা.) আরও বলেন-

“তাদের উপমা,এ উম্মতের জন্য তারা হলেন নূহের কিস্তির মত-যে কেউ এতে আরোহন করল মুক্তি পেল,আর এর অন্যথাকারীরা নিমজ্জিত হলো।”

অনুরূপ,পবিত্র কোরআনে এ উক্তির প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই যে,ইমামগণ (আ.) হলেন-

“সম্মানিত বান্দা যারা তার অগ্রে কোন কথা বলেন না এবং তারা তার (আল্লাহর) আদেশ (উত্তমরূপে) সম্পাদন করেন।”(সূরা আম্বিয়া-২৭)

তারা হলেন সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের সকল অপবিত্রতা দূর করে মহান আল্লাহ তাদেরকে পবিত্রের মত পবিত্র করে দিয়েছেন।

আমরা বিশ্বাস করি যে,তাদের আদেশ হলো মহান আল্লাহরই আদেশ,তাদের নিষেধ হলো মহান আল্লাহরই নিষেধ,তাদের আনুগত্য আল্লাহরই আনুগত্য,তাদের অবাধ্যতা আল্লাহরই অবাধ্যতা,তাদের বন্ধু হওয়া আল্লাহরই বন্ধু হওয়া,তাদের শত্রু হওয়া আল্লাহরই শত্রু হওয়া। তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়। মূলতঃ তাদেরকে অস্বীকার করার মানে হলো আল্লাহর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করা। আর আল্লাহর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করার মানে হলো মহান আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করা। সুতরাং তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করা,তাদের আদেশ মেনে চলা ও তাদের কথা অনুসরণ করা প্রত্যেকের জন্যই আবশ্যক।

আর এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি যে,সকল ঐশী নির্দেশই তাদের শিক্ষা থেকে গ্রহণ করতে হবে,তাদের ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে তা গ্রহণ করা যাবে না। তাদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি সমর্পিত হলে দ্বীনী দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পাওয়া যাবে না। কেউই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না যে মহান আল্লাহর প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করেছে কিংবা সঠিকরূপেই দায়িত্ব পালন করেছে। সেই নূহের তরীর মতই যে কেউ তাতে আরোহন করবে সে মুক্তি পাবে আর যে কেউ তা ত্যাগ করবে সে সন্দেহ,অজ্ঞতা,মিথ্যাচার ও বিরোধের ক্রুব্ধ তরঙ্গের অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত হবে।

অদ্য ইমামতের উপর আলোচনার উদ্দেশ্যে আহলে বাইত (আ.) যে বৈধ খলিফা বা ঐশী নেতৃত্ব তা প্রমাণ করা নয়। কারণ,ইতিহাসের স্কন্ধে ভর করে যা অতীত হয়ে গিয়েছে তাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিংবা প্রকৃত হকদারের অধিকার ফিরিয়েও দেয়া যাবে না। বরং ঐশী আদেশ নিষেধের জন্য আহলে বাইতের (আ.) শরণাপন্ন হওয়ার আবশ্যকতাকে প্রতিপাদন করাই আমাদের প্রয়াস। আর সেই সাথে মহানবী (সা.) প্রকৃতপক্ষে যা বলেছেন তা খুজে বের করার চেষ্টা করছি।

যারা ইমামগণ (আ.) কর্তৃক প্রশিক্ষিত হয়নি কিংবা তাদের আলোয় যাদের অন্তর আলোকিত হয়নি প্রকৃতার্থে তারা ইসলামের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত। আর সে ক্ষেত্রে কেউ আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পাদনের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না। কারণ,শরীয়তের আহকামের ক্ষেত্রে বিভিন্নদল ও গোত্রের মধ্যে বিদ্যমান আপোষহীন বিরোধের ফলে কারো জন্য এ অবকাশ থাকে না যে,কোন এক মাযাহাবকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবে। সুতরাং কোন মাযহাবের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং নিশ্চিতরূপে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত না পাওয়া পর্যন্ত তাকে অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়ে যাওয়া ব্যতীত তার কোন উপয়ান্তর নেই। শরীয়তের আহকাম সম্পর্কে নিশ্চিত হলে তা সম্পাদন করা আবশ্যক। আবার নিশ্চিত দায়িত্ব আসলে নিশ্চিত কর্তব্য সম্পাদন আবশ্যক।

আহলে বাইতের (আ.) শরণাপন্ন হওয়ার আবশ্যকতা এবং মহানবীর (সা.) পর তারাই যে আল্লাহর বিধানের প্রকৃত উৎস সে সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ও নিশ্চিত দলিল বিদ্যমান। ন্যূনতমপক্ষে মহানবীর (সা.) বক্তব্যই এক্ষেত্রে উত্তম উপস্থাপনা -শিয়া ও সুন্নী উভয়ই এ রেওয়ায়েতের ব্যাপারে একমত-  “নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আমি দু’টি ভারীবস্তু রেখে যাচ্ছি যার একটি আরেকটি অপেক্ষা বেশী ভারী। একটি হলো আল্লাহর কিতাব যা আকাশ থেকে জমিন পর্যন্ত ঝুলন্ত রশির মত। আর অপরটি হলো আমার এতরাত- আহলে বাইত। হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কখনো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। যে কেউ এঁকে আঁকড়ে ধরবে কখনোই আমার পরে সে পথভ্রষ্ট হবে না।”

যদি এ মূল্যবান হাদীসের প্রতি সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে আমরা এর অপরূপ অভিব্যক্তিতে মুগ্ধ হব। কারণ,সর্বপ্রথম তা বলছে-

“যদি তুমি এতদ্ভয়কে আঁকড়ে ধর তবে আমার পরে কখনোই বিচ্যুত হবে না।”

আর আমাদের নিকট রেখে যাওয়া হয়েছে দু’টিভারী বস্তু একই সাথে যেন একই বস্তুরূপে-এর কোন একটিকে আঁকড়ে ধরা যথেষ্ট নয়। কারণ তাদেরকে কেবলমাত্র একত্রে ধরে রাখলেই আমরা কখনো পথভ্রষ্ট হব না। ঐটা আরও সুষ্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান হয় এ কথায় যে,‘হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনোই পৃথক হবে না।’সুতরাং যদি কেউ এতদ্ভয় থেকে দূরে থাকে এবং এ গুলোকে আঁকড়ে না ধরে সে কখনোই হেদায়াত প্রাপ্ত হবে না। অনুরূপ,তারা হলেন ‘নাজাতের তরী’-পৃথিবীবাসীর রক্ষাকারী। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করে সে গোমরাহীর উত্তাল তরঙ্গে নিমজ্জিত হবে এবং সে ধ্বংস থেকে নিস্তার পাবে না।

সুতরাং এটা বলা সঠিক নয় যে,এ হাদীসের অর্থ হলো,আহলে বাইতকে (আ.) আন্তরিক ভাবে ভালবাসা,তাদেরকে অনুসরণ করা বা মান্য করা শর্ত নয়। মূর্খ ব্যতীত কেউই একথা বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ এটা হলো সুষ্পষ্ট আরবীর বিকৃত অর্থ।

আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

পবিত্র কোরআনের সূরা শুরা-র ২৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-

“বলুন আমি তোমাদের নিকট আমার নিকটাত্মীদের সৌহার্দ ব্যতীত কিছুই চাই না।”

আমরা বিশ্বাস করি যে,মহানবীর (সা.) আহলে বাইতকে (আ.) দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রাখার পাশাপাশি দ্বীনের দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তাদের প্রতি ভালবাসা ও মাওয়াদ্দাত রাখা আবশ্যক। কারণ মহান আল্লাহ প্রাগুক্ত আয়াতে মানুষের জন্যে এটা বাধ্যতামূলক করেছেন।

মহানবীর (সা.) থেকে বর্ণিত এক বহুল আলোচিত হাদীসে বলা হয়-

“নিশ্চয়ই আহলে বাইতের (আ.) প্রতি ভালবাসা ঈমানের লক্ষণ,আর তাদের প্রতি বিদ্বেষ হলো শঠতা বা মোনাফেকীর লক্ষণ। নিশ্চয়ই যে তাদেরকে ভালবাসে সে আল্লাহ ও তার রাসূলকেও ভালবাসে এবং যদি কেউ তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।”

সুতরাং তাদের প্রতি ভালবাসা ইসলামের আবশ্যকীয় বিষয়সমূহের অন্তর্ভূক্ত। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। বিভিন্ন মাযহাব ও গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যান্য বিষয়ে পারস্পরিক বিরোধ থাকলেও এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে। তবে নাসেবী নামে খ্যাত ক্ষুদ্র একটি দল আছে যারা আহলে বাইতের (আ.) প্রতি ভালবাসা যে ইসলামের আবশ্যকীয় বিষয় তা স্বীকার করে না। আর নামায,যাকাত ইত্যাদির মত ইসলামের সন্দেহাতীত আবশ্যকীয় বিষয়সমূহকে অস্বীকার করার অর্থ প্রকারন্তারে মূল রেসালাতকে অস্বীকার করা। প্রকৃতই তারা রেসালাতাকে অস্বীকারকারী যদিও বাহ্যিকভাবে মুখে তারা শাহাদাতাইন বলে থাকে। আর এ কারণে আহলে বাইতের (আ.) প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা মোনাফেকীর লক্ষণ। আর তাদের প্রতি মহব্বত রাখা ঈমানের লক্ষণ। ফলে তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখা প্রকারন্তরে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা।

নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ মহব্বত ও অভিভাবকত্বের যোগ্য ব্যক্তিবিশেষ ব্যতীত আর কারো মহব্বত ও মাওয়াদ্দাত আবশ্যক করেন নি। কারণ তারা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা,আল্লাহ নিকট রয়েছে তাদের মর্যাদা। তারা শিরক,পাপাচার এবং যাবতীয় বিষয় যা কিছু আল্লাহর তুষ্টি ও করুণা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা থেকে পবিত্র। আর এটা কখনোই সম্ভব নয় যে তিনি এমন কারো আনুগত্যকে আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক করবেন যারা গুনাহে লিপ্ত হয়,তার আনুগত্য করে না,যারা মহান আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত নয়। সমস্ত মানুষই তার বান্দা এবং সৃষ্টিগত দিক থেকে সমান। মানুষের মধ্যে একমাত্র যে যত বেশী তাকওয়ার অধিকারী মহান আল্লাহর কাছে সে তত বেশী মর্যাদার অধিকারী। সুতরাং তিনি যদি কাউকে ভালবাসতে আদেশ দেন,তবে অবশ্যই ঐ ব্যক্তি সমস্ত মানুষের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু ও সবদিক থেকে উত্তম। নতুবা কেউ ভালবাসার জন্যে কারো উপর শ্রেষ্টত্ব পেত না। কিংবা মহান আল্লাহ কারো জন্যে কারো ভালবাসা আবশ্যক করতেন না। যদি তা করতেন তবে বেলায়াত অসার ও খেলনারূপে পর্যবসিত হত। এর কোন মহত্ত্ব ও বিশেষত্ব থাকত না।

ইমামগণের প্রতি আমাদের বিশ্বাস :

ইমামগণের (আ.) প্রতি আমাদের বিশ্বাস গোল্লাত ও হলুলিদের মত অতিরঞ্জিত নয়। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে-

“---- কত গুরুতর তাদের মুখের কথা।” (সুরা কাহাফ-৫)

বরং আমাদের বিশ্বাস হলো স্বতন্ত্র। আমরা বিশ্বাস করি যে,তারা (আ.) আমাদের মতই মানুষ -- আমাদের যা আছে তাদের তা আছে,আবার তাদের যা আছে আমাদেরও তা আছে। তথাপি তারা হলেন মর্যাদাবান,মহান আল্লাহ তাদেরকে তার বিশেষ অনুগ্রহে ধন্য করেছেন,দিয়েছেন বেলায়াত। কারণ তারা জ্ঞান,তাকওয়া,বীরত্ব,আত্মসম্মান,সকল সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রশংসিত গুণে সকল মানুষের সেরা এবং পরিপূর্ণ। এ সকল দিক থেকে কেউই তাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। সুতরাং ইমামতের ক্ষেত্রে তারাই যোগ্যতম ব্যক্তি। হেদায়াতকারী হিসেবে তারাই শ্রেষ্ট এবং শরীয়তের হুকুম আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রে,কোরআন ও দ্বীনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মহানবীর (সা.) পর তারাই বিশ্ববাসীর জন্যে আশ্রয়স্থল। আমাদের ষষ্ঠ ইমাম সাদিক (আ.) বলেন-

“আমাদের সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় তা যদি সৃষ্টির জন্য অসম্ভব না হয়ে থাকে যদিও তুমি তা জান না বা বুঝ না তাকে প্রত্যাখ্যান করোনা বরং তা আমাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। আর যদি সৃষ্টির জন্য সম্ভব নয় এমন কিছু আমাদের সম্পর্কে বলা হয়,তবে তা প্রত্যাখ্যান কর এবং আমাদের উপর আরোপ করো না।”

ইমাম নিয়োগ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে,নবুওয়াতের মত ইমামতও রাসূল কিংবা নিযুক্ত কোন ইমামের মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইমামত নবুওয়াতের মতই। এক্ষেত্রে কোন প্রভেদ নেই। সুতরাং যাকে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক নেতারূপে প্রেরণ করেছেন তার সম্পর্কে বাদানুবাদ করা সমীচীন নয়। অনুরূপ তাকে নির্বাচন,নির্ধারণ বা নিয়োগ দানের অধিকারও মানুষের নেই। কারণ যে ব্যক্তি পবিত্র আত্মার অধিকারী হবেন এবং মানুষের হেদায়েত ও নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতার অধিকারী হবেন তাকে কেবলমাত্র মহান আল্লাহ ব্যতীত কেহই পরিচিত করিয়ে দিতে পারে না। কিংবা নিয়োগ ও অনুমোদন দিতে পারে না।

আমরা বিশ্বাস করি যে,মহানবী (সা.) তার উত্তরাধিকারী ও ইমামের নাম ঘোষনা করেছিলেন। তিনি তার উত্তরাধিকারী হিসেবে তারই চাচাত ভাই হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) কথা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি হলেন মহানবীর (সা.) পর মুমিনদের আমীর,ওহীর অভিভাবক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের ইমাম। তার নিয়োগ এবং আমীরুল মুমিমীন হিসেবে তার প্রতি বাইয়াত গ্রহণ করা হয়েছে ঐতিহাসিক গাদীর দিবসে। মহানবী (সা.) সেদিন বলেছিলেন-

“হে মুমিনগণ! আমি যার মাওলা (অভিভাবক) এ আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ বন্ধু হও তার যে তার সাথে বন্ধুত্ব করে,শত্রু হও তার যে তার সাথে শত্রুতা করে,সাহায্য কর তাকে যে তাকে সাহায্য করে,লাঞ্ছিত কর তাকে যে তাকে লাঞ্ছনা দেয় এবং সত্যকে সর্বদা তার (আলীর) সাথে রাখ।”

হযরত আলীর (আ.) ইমামত ও বেলায়াতের কথা সর্বপ্রথম ঘোষণা করা হয়েছিল সেদিন,যেদিন সকল নিকট-আত্মীয়কে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। মহানবী (সা.) সেদিনও ঘোষণা করেছিলেন-

“তিনি (আলী) আমার ভাই,উত্তরাধিকারী (ওয়াসী) এবং আমার পরে আমার প্রতিনিধি। সুতরাং তোমরা তার কথা মেনে চলবে এবং তাকে অনুসরণ করবে।”

মহানবী (সা.) যখন তাকে একথা বলেছিলেন তখন হযরত আলী (আ.) শিশু ও অপরিণত বয়সের ছিলেন।

মহানবী (সা.) আলীর (আ.) উত্তরাধিকারীর ব্যাপারটি একাধিকবার ঘোষণা করেছিলেন। যেমন বলেছিলেন-

“তুমি আমার নিকট সেরূপ,যেরূপ মূসার নিকট হারুন। তবে আমার পরে কোন নবী আসবে না।”

হযরত আলীর (আ.) বেলায়াতের প্রমাণস্বরূপ হাদীস ব্যতীত একাধিক আয়াতও বিদ্যমান। যেমন-পবিত্র কোরআনে সুরা মায়েদা-র ৫৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে -

“নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী হলেন কেবলমাত্র আল্লাহ,তার রাসূল এবং যাঁরা ঈমান এনেছে,যাকাত দিয়েছে রুকু অবস্থায়।”

উপরোক্ত আয়াতের সর্বশেষ অংশ নাযিল হয়েছিল হযরত আলী (আ.) প্রসংগে যিনি রুকু অবস্থায় তার আংটি ভিক্ষুককে প্রদান করেছিলেন। ইমামতের স্বপক্ষে যে সকল আয়াত,রেওয়ায়েত এসেছে তার সবগুলো বর্ণনা করা কিংবা সেগুলো সম্পর্কে যুক্তির অবতারণা করা এ পুস্তিকার ক্ষুদ্র কলেবরে অসম্ভব।

ইমামগণের (আ.) সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে,ইমামগণ যাঁদের সত্যিকার অর্থে ইমামত্বের বৈশিষ্ট্য আছে এবং যাঁরা মহানবীর (সা.) পর আমাদের জন্য শরীয়তের আহকামের উৎসরূপে নিয়োগ লাভ করেছেন তারা হলেন বারজন। মহানবী (সা.) তাদের সকলকে নাম উল্লেখ পূর্বক নিয়োগ দিয়েছিলেন। অতঃপর তাদের অগ্রজ নিয়োগ দিয়েছিলেন অনুজকে। আর তা নিম্নরূপ :-

১। আবুল হাসান আলী ইবনে আবি তালিব (আল-মুর্তাজা) যাঁর জন্ম ২৩ হিজরী পূর্বাব্দ এবং হিজরী ৪০ সালে শাহাদাৎ বরণ করেন।

২। আবু মোহাম্মদ আল হাসান ইবনে আলী (আযযাকি) (২হিঃ-৫০ হিঃ)

৩। আবু আব্দুল্লাহ আল হুসাইন ইবনে আলী (সাইয়্যেদুশশোহাদা)(৩ হিঃ-৬১ হিঃ)

৪। আবু মোহাম্মদ আলী ইবনিল হুসাইন (যয়নুল আবেদীন) (৩৮ হিঃ- ৯৫হিঃ)

৫। আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে আলী (আল বাকের) (৫৭ হিঃ-১১৪ হিঃ)

৬। আবু আব্দুল্লাহ জাফর ইবনে মোহাম্মদ (আস-সাদিক)(৮৩ হিঃ-১৪৮ হিঃ)

৭। আবু ইব্রাহিম মূসা ইবনে জাফর (আল কাযিম) (১২৮ হিঃ -১৮৩ হিঃ)

৮। আবুল হাসান আলী ইবনে মূসা (আর রেযা)(১৪৮ হিঃ - ২০৩ হিঃ)

৯। আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে আলী (আল জাওয়াদ) (১৯৫ হিঃ - ২২০ হিঃ)

১০। আবুল হাসান আলী ইবনে মোহাম্মদ (আল -হাদী) (২১২ হিঃ-২৫৪ হিঃ)

১১। আবু মোহাম্মদ আল হাসান ইবনে আলী (আল আসকারী) (২৩২ হিঃ- ২৬০ হিঃ)

১২। আবুল কাশেম মোহাম্মদ ইবনিল হাসান (আল মাহদী) (২৫৬ হিঃ -)

আর সর্বশেষ ইমামই হলেন আমাদের সময়কালের ইমাম যিনি লোকান্তরিত,আমরা তার জন্য অপেক্ষামান,মহান আল্লাহ তার আবির্ভাব তরান্বিত ও সহজ করুন যাতে তিনি পৃথিবীতে সেরূপে ন্যায়-নীতিতে পরিপূর্ণ করে দিতে পারেন,যেরূপে পৃথিবী জুলুম ও অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

ইমাম মাহদীর (আ.) প্রতি আমাদের বিশ্বাস :

নিশ্চয়ই ইমাম মাহদীর (আ.) আবির্ভাবের সুসংবাদ মহানবীর (সা.) হাদীস থেকে তাওয়াতুর রূপে প্রমাণিত হয়েছে। ইমাম মাহদী (আ.) হবেন হযরত ফাতেমা যাহরা সালামুল্লাহ আলাইহার রক্তজ সন্তানের অন্তর্ভূক্ত। তিনি পৃথিবীকে সেরূপ ন্যায়-নীতিতে পূর্ণ করে দিবেন যেরূপ পৃথিবী অন্যায় ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভাষার পার্থক্য থাকলেও মুসলমানদের সকল মাযহাব সামগ্রিকভাবে ইমাম মাহদীর (আ.) সুসংবাদ সম্পর্কে একমত। এটা শীয়া মাযহাব কর্তৃক উদ্ভাবিত কোন নতুন চিন্তা নয়। অত্যাচার ও জুলুম থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য এমন কারো স্বপ্নও নয় যিনি পৃথিবীকে জুলুম থেকে রক্ষা করবেন যা কুতার্কীকরা বলে গিয়েছে। বরং ইমাম মাহদীর (আ.) আবির্ভাবের বিষয়টি মহানবীর (সা.) বর্ণনা থেকে স্পষ্ট রূপে মুসলমানদের অন্তরে প্রথিত ও প্রতিষ্ঠিত আছে এবং সকল মুসলমান এতে বিশ্বাসী। এর প্রমাণস্বরূপ বলা যায় যে,ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই একদল লোক নিজেকে মাহদী হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিল। এদের মধ্যে কিসানিয়াহ,আব্বাসীয়ীন এবং একদল আলাভীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তারা এ প্রক্রিয়া মানুষের মধ্যে প্রথিত বিশ্বাসকে ভ্রান্তিতে পতিত করে ক্ষমতা হস্তগত করার চেষ্টা চালিয়েছিল। সুতরাং ‘মাহদীর’মিথ্যা দাবী তুলে তারা সাধারণের উপর প্রভাব খাটাতে চেয়েছিল। {কারণ মাহদীর (আ.) আবির্ভাবের ব্যাপারটি সর্বজন স্বীকৃত}

আমরা দ্বীন ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাস করার পাশাপাশি বিশ্বাস করি যে,এ দ্বীন সর্বশেষ দ্বীন এবং মানব জাতির সংস্কারের জন্য অন্য কোন দ্বীন আসবে না। অপরদিকে আমরা দেখতে পাই যে,ন্যায় ও কল্যাণকর্মের অভাবে জুলুম ও অত্যাচার ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। অথবা আমরা আরো দেখতে পাই যে,মুসলমানরা স্বয়ং ইসলামের নিয়ম নিজেদের দেশেই উপেক্ষা করে চলছে। তারা এমনকি একহাজার ইসলামী বিধানের মধ্যে একটি বিধানও পালন করে না। তথাপি আমরা পূর্ণ শক্তিতে ইসলামের পুনঃ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জুলুম ও অত্যাচারে নিমজ্জিত এ বিশ্বের সংস্কারের আশায় অপেক্ষমান।

প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি ইসলামী বিধানের বিকৃতি ও মুসলমানদের চিন্তা চেতনার ফলে যে পারস্পরিক ব্যবধান ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাতে স্বীয় শক্তি ও আধিপত্য নিয়ে ইসলামের ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা দেখা যায় না। প্রকৃতার্থেই ইসলাম কখনো সশক্তিতে ফিরে আসবে না যদি না কোন মহান সংস্কারক আবির্ভূত হন এবং ঐশী অনুগ্রহ ও দিক নির্দেশনায় মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ইসলামের সাথে মিশে যাওয়া ভুল-ত্রুটি ও বিচ্যুতিকে দূর করেন। নিশ্চিতরূপে ঐ মহান সংস্কারকের থাকবে সুমহান মর্যাদা,সর্বময় কর্তৃত্ব,অলৌকিক শক্তি যার মাধ্যমে তিনি জুলুম ও অন্যায়ে পরিপূর্ণ পৃথিবীকে ন্যায় ও সাম্যে পরিপূর্ণ করে দিবেন।

সংক্ষেপে পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে,বিশ্বমানবতা আজ অত্যাচারে নিদারুণ ভাবে বিপর্যস্ত। এ দ্বীনই সঠিক দ্বীন ও সর্বশেষ দ্বীন এ বিশ্বাসের দাবী আমাদেরকে এমন এক সংস্কারের (আল-মাহদী) জন্য অপেক্ষমান থাকার জন্য আশান্বিত করে যিনি পৃথিবীকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করবেন। মুসলমানদের সমস্ত মাযহাবই এ অপেক্ষায় বিশ্বাস করে। এমনকি অমুসলিম সম্প্রদায়ও এতে বিশ্বাসী। ইমামীয়াদের সাথে অন্যান্য সম্প্রদায়ের পার্থক্য শুধু এখানেই যে ইমামীয়ারা বিশ্বাস করে যে,এ সংস্কারক হলেন মাহদী (আল্লাহর তার আবির্ভার ত্বরান্বিত করুন)। তাদের বিশ্বাস তিনি ২৫৬ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখনও বেঁচে আছেন। তিনি ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) সন্তান যার নাম ‘মোহাম্মাদ’। মহানবী (সা.) ও আহলে বাইতের (আ.) বর্ণিত হাদীস থেকে তার জন্ম ও আত্মগোপনের ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়েছে।

কোন কালে বা যুগেই ইমামতের এ মিশন ব্যাহত হবে না যদিও ইমাম লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুত দিন ব্যতীত আত্মপ্রকাশ করবেন না। আর সেই প্রতিশ্রুত দিবস একমাত্র মহান আল্লাহরই জানা। কারণ এটি এক ঐশী রহস্য।

এত সুদীর্ঘ সময় ধরে ইমামের বেঁচে থাকা এবং সুদীর্ঘ জীবন মোজেযা বহির্ভূত কোন কিছুই নয় যা মহান আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করেছেন। এটা ইমামের জন্য বেশী কিছু নয় যে,তার পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা মহান আল্লাহর নিকট চলে যাবার পর তিনি বিশ্বমানবতার জন্য ইমাম নিযুক্ত হন। এটা (তার দীর্ঘজীবন লাভ) তার ইমাম হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির চেয়ে বেশী আশ্চর্যের বিষয় নয়। এটা ঈসার (আ.) মোজেযা থেকে বেশী কিছু নয় যে শিশু বয়সে দোলনায় থেকে তিনি মানুষের সাথে কথা বলেছিলেন এবং নবীরূপে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী দীর্ঘজীবি হওয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব নয় বা চিকিৎসা বিজ্ঞান একে অস্বীকার করে না। যদিও আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের দীর্ঘজীবিতার ক্ষেত্রে এখনও অক্ষম। বিজ্ঞান এক্ষেত্রে অপারগ হলেও মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তদুপরি নূহের (আ.) সুদীর্ঘ জীবন লাভ এবং ঈসার (আ.) এখনও জীবিত থাকার কথা পবিত্র কোরআন থেকে আমরা জানতে পারি। আর যদি কোন সন্দিগ্ধ ব্যক্তি কোরআনের অবিকৃত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে তবে ইসলামকে সে চিরবিদায় জানাল। এটা আশ্চর্যের বিষয় যে মুসলমান নিজেকে কোরআনে বিশ্বাসী বলে দাবী করছে অথচ এর সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে।

এখানে আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে,ইমাম মাহদীর (আ.) জন্য অপেক্ষামান থাকার অর্থ এ নয় যে,মুসলমানরা তাদের ধর্ম বিষয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এবং তাদের জন্যে দ্বীনের সাহায্যে এগিয়ে আসা ও দ্বীনের পথে জিহাদ করা কিংবা দ্বীনের আহকাম পালন করা অথবা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের বারণ করা আবশ্যক নয়। বরং মুসলমানরা সব সময়ই দ্বীনের আহকাম পালন করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত। তার জন্য আবশ্যক হলো সঠিক পন্থায় সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালানো। তার জন্য আবশ্যক হলো যতটুকু সম্ভব সৎ কাজের আদেশ করণ ও অসৎ কাজের নিষেধ করণ। মহানবী (সা.) বলেছেন-

“তোমরা সকলেই পথ নির্দেশক আর সকলেই নিজ নিজ জাতির জন্য দায়িত্বশীল।”

অতএব,কেবলমাত্র মাহদীর (আ.) জন্য অপেক্ষমান থেকে সকল দ্বীনী দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীন থাকা মুসলমানদের জন্যে সমীচীন নয়। এর ফলে মুসলমানের দায়িত্ব সমাপ্ত হয় না কিংবা দায়িত্ব স্থগিত হয় না এবং পশুর মত মানুষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন নয়।

রাজআত (পুনরাবর্তন) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

এ ক্ষেত্রে শিয়ারা তা-ই বিশ্বাস করে যা রাসূলের (সা.) আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত বর্ণনা মতে মহান আল্লাহ একদল মৃতব্যক্তিকে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবেন পূর্বে ঠিক যে অবস্থায় তারা ছিল সে অবস্থায়। তখন মহান আল্লাহ একদলকে সম্মানিত করবেন এবং অপর দলকে লজ্জিত করবেন। তিনি সৎ কর্ম সম্পাদনকারীকে অসৎ কর্ম সম্পাদনকারীদের থেকে পৃথক করে দিবেন,পৃথক করবেন অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারীকে। আর ইমাম মাহদীর (সা.) আবির্ভাবের পর এ ঘটনা ঘটবে।

কাজেই পুনরাবর্তন ঘটবে না যদি না সে ঈমানের চুড়ান্ত শিখরে পৌঁছে কিংবা অনাচারের নিকৃষ্টতম স্তরে তলিয়ে যায়। এরপর তারা পুনরায় মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর তাদেরকে বিচার দিবসে পুনরায় জীবিত করা হবে এবং যার যার প্রাপ্তি অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। এ কারণে পবিত্র কোরআনে যারা পৃথিবীতে দু’বার প্রত্যাবর্তন করেছিল তৃতীয়বার আসার জন্য তাদের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন-

“তারা বলবে,হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদেরকে দু’বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু’বার জীবন দিয়েছেন। আমরা আমাদের দোষ স্বীকার করছি। সুতরাং এখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় আছে কি?” (সুরা মুমিন -১১)

হ্যাঁ,পবিত্র কোরআনে এ পৃথিবীতেই রাজআত বা পুনরাবর্তনের সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে বক্তব্য এসেছে। এছাড়া পবিত্র আহলে বাইত (আ.) থেকেও এ সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা এসেছে। শীয়াদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যতীত সকলেই এ ব্যাপারে একমত। শীয়াদের ঐ ক্ষুদ্রাংশের মতে রাজআতের অর্থ হলো অপেক্ষমান ইমামের (আ.) ফিরে আসার মাধ্যমে আহলে বাইতের (আ.) নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং আদেশ নিষেধের অধিকার ফিরে আসা। লোকদের প্রত্যাবর্তন বা মৃত্যুর পর পূর্নজীবন লাভ নয়।

রাজআতের ব্যাপারটি আহলে সুন্নত কর্তৃক অস্বীকৃত হয়ে আসছে। তাদের মতে এটা হলো ধর্ম বিরোধী বিশ্বাস। তাদের হাদীস সংকলনকারীরা রাজআত সম্পর্কে বর্ণনাকারী রাবীদের (হাদীস বর্ণনাকারী) উপর দূর্নাম দিয়েছেন যাতে করে তাদের বর্ণনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যায়। এমনকি তারা রাজআতে বিশ্বাসকারীদেরকে কাফের ও মোনাফেক অথবা তদপেক্ষা কুৎসিত কোন অ্যাখ্যা দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। সুন্নি কর্তৃক শীয়ারা ধিকৃত ও নিন্দিত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো রাজআতের এ বিশ্বাস।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের ব্যাখ্যা হলো সেই অস্ত্র যা পূর্বে বিভিন্ন ইসলামী দলগুলো পরস্পরকে অপবাদ দিতে ব্যবহার করত এবং যা নিয়ে বিবাদ করত। প্রকৃতপক্ষে পরস্পরকে দোষারোপ করার কোন কারণই আমরা দেখি না। কারণ,রাজআতের প্রতি বিশ্বাস না তাওহীদের বিশ্বাসকে খর্ব করে,আর না নবুওয়াতের বিশ্বাসকে। বরং এগুলোর সত্যতার উপর গুরুত্বারোপ করে। কেননা রাজআত হলো পুনরুত্থান দিবসের মতই মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার প্রমাণ। এটি হলো মহানবী (সা.) এবং তার আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত মোজেযা (অলৌকিক ঘটনা) কিংবা ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবিতকরণের মোজেযার মত বরং তার চেয়েও বড়। কারণ,পচে গলে যাওয়া লাশকে জীবিত করা হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

“বলে যে,কে নষ্ট হয়ে যাওয়া হাড়গুলোতে প্রাণ সঞ্চার করবে? বলুন,তিনিই যিনি তাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। ” (সুরা ইয়াসীন- ৭৯)

তবে যারা রাজআতকে অসার পুর্নজন্মবাদ (তানাসুখ) মনে করে অভিযোগ তুলছে তারা প্রকৃত পক্ষে এ তানাসুখ এবং শারীরিক পুনরুত্থানের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে নি। আর রাজআত হলো শারীরিক পুনরুত্থানের অনুপ্রকরণ। অপরদিকে তানাসুখ হলো পূর্বের দেহ ব্যতিরেকে অন্য কোন দেহে প্রত্যাবর্তন। অথচ শারীরিক পুনরুত্থানের অর্থ স্বতন্ত্র। কারণ,এর মানে হলো পূর্বতন দেহে আত্মার প্রত্যাবর্তন। আর এরূপই হলো রাজআত বা পূনর্জীবন লাভ। যদি রাজাআত তানাসুখ হয়,তবে ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবন দানও তানাসুখ হবে। তদ্রূপ,যদি রাজাআত তানাসুখ হয়,তবে দৈহিক পুনরুত্থানও তানাসুখ হবে।

এখন রাজআতের উপর দুটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

প্রথমত : এটা ঘটা অসম্ভব এবং

দ্বিতীয়তঃ রাজআত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো সঠিক নয়।

বর্ণিত সমস্যা দু’টিকে সঠিক ধরে নিলেও রাজআতের প্রতি বিশ্বাস এতটা ঘৃণ্য নয় যা শীয়াদের শত্রুরা করে থাকে। মুসলমানদের অন্যান্য দলগুলোর এমন কত বিশ্বাস আছে যা অসম্ভব কিংবা যা সঠিক উৎস দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। অথচ এর কারণে কাফের বা ইসলাম থেকে বের করে দেয়া আবশ্যক হয়নি। আর এগুলোর উদাহরণও কম নয়। যেমন : নবী কর্তৃক ভুল-ত্রুটি ও পাপ হওয়া,কোরআন অনাদি হওয়া,কিংবা এ বিশ্বাস করা যে আল্লাহ যখন বললেন যে তিনি শাস্তি দিবেন,তখন তিনি তা করতে বাধ্য (ওয়াযিব)। অথবা মহানবী (সা.) তার উত্তরসূরী নির্বাচন করেন নি ইত্যাদি।

যাহোক প্রাগুক্ত সমস্যাদ্বয়ের সত্যতার কোন ভিত্তি নেই। ‘রাজআত অসম্ভব’এর জবাবে আমরা বলব- ইতিপূর্বে আমরা বলেছিলাম যে,রাজআত হলো দৈহিক পনুরুত্থানের প্রকরণ। পার্থক্য শুধু এটুকু যে তা ইহকালেই হবে। সুতরাং সেই কিয়ামতের সম্ভাবনার দলিলই রাজআতকে প্রমাণিত করে। এখানে আশ্চার্যন্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কেবলমাত্র ব্যতিক্রম এটুকু যে,পার্থিব জীবনে আমরা এতে অভ্যস্ত নই। আমরা এর সংঘটিত হওয়ার কোন কারণ বা অন্তরায় সম্পর্কে জানিনা যে তা আমাদের একে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার কাছাকাছি পৌঁছে দিবে। অপরদিকে মানুষের প্রকৃতি এরকম যে,সে যাতে অভ্যস্ত নয় বা যার সাথে পরিচিত নয় তা গ্রহণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। এটা সে রকম যে একদল কিয়ামত সম্পর্কে আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলেছিল-

“কে এ নষ্ট হাড়গুলোকে জীবন দিবে?” (সুরা ইয়াসিন-৭৮)

জবাবে বলা হয়েছিল -

“যিনি প্রথমবার একে সৃষ্টি করেছিলেন তিনিই একে জীবন দিবেন এবং তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।”(সুরা ইয়াসিন -৭৯)

এমন এক পরিস্থিতিতে যেখানে রাজআতকে বিশ্বাস করার বা অগ্রাহ্য করার কোন বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল না থাকে কিংবা শুধু খেয়ালের বশবর্তী হয়ে আমরা বলে থাকি এর কোন দলিল নেই,সেখানে আমাদেরকে ওহীর উৎস থেকে প্রাপ্ত দলিলসমূহের শরণাপন্ন হতে হবে। পবিত্র কোরআনে কোন কোন মৃতব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথিবীতে রাজাআত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ মেলে। যেমন- হযরত ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবিত কারণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এসেছে-

“আমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে অন্ধকে আলো দেই,কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান করি আর মৃতকে জীবিত করি।”(সুরা আল এমরান -৪৯)

অনুরূপ,মহান আল্লাহর বাণী-

“কিরূপে আল্লাহ একে জীবন দিবেন মৃত্যুর পর? সুতরাং আল্লাহ তাকে একশত বছরের জন্য মৃত্যু দিলেন। অতঃপর তাকে জীবিত করলেন।”(সুরা বাকারা -২৫৯)

এছাড়া ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম-

“হে প্রভু ! আমাদেরকে দু’বার মৃত্যু দিয়েছেন।”(সুরা মুমিন - ১১)

অতএব মৃত্যুর পর পৃথিবীতে ফিরে আসা ব্যতীত এ আয়াতের কোন অর্থ করা যায় না। যদিও কোন কোন তাফসীরকারক এর অন্য ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন যা কোন বিশ্বস্ত রাবী থেকে বর্ণিত হয়নি এবং আয়াতের সাথে এর সামঞ্জস্য রক্ষা করে না।

যাহোক দ্বিতীয় সমস্যা যেখানে বলা হয়েছে যে এর স্বপক্ষে বর্ণিত হাদীসগুলো সঠিক নয় সে সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে,এ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ,রাজআত আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত বহুলালোচিত মোতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিষয় যার উপর বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন। তদুপরি এটা আশ্চর্যের বিষয় যে,আহাম্মদ আমীনের মত একজন প্রখ্যাত লেখক যিনি বিজ্ঞ বলে দাবী করে থাকেন তিনি ফাজরুল ইসলাম নামক পুস্তকে লিখেছেন-

“রাজআতের কথায় শীয়াদের অবয়বে ইহুদীবাদের প্রকাশ ঘটে।”

আমরা তাকে বলব,তাহলে পবিত্র কোরআনেও ইহুদীবাদ রাজাআতের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। কারণ পূর্বে যে সকল আয়াত উল্লেখ করেছি তাতে রাজআতের কথাই বর্ণিত হয়েছে।

আমরা তাকে আরো বলব যে,প্রকৃতপক্ষে ইসলামের অনেক বিশ্বাস ও আহকামে ইহুদীবাদ ও খ্রীষ্টবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কারণ,মহানবী (সা.) ঐশী বিধানের যে দৃষ্টান্ত এনেছিলেন এখন তার অনেক বিধানকেই পরিত্যাগ করা হয়েছে বা অকার্যকর করা হয়েছে। সুতরাং ইসলামের বিশ্বাসে ইহুদীবাদ ও খ্রীষ্টবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তবে তা ইসলামের কোন ঘাটতি বা দোষ নয় যদি ধরেও নেয়া হয় যে,রাজআত হলো ইহুদীবাদের বক্তব্য যা উক্ত লেখক দাবী করেছেন।

যাহোক রাজআত দ্বীনের এমন কোন মৌলিক বিষয় নয় যার উপর বিশ্বাস ও বিবেচনা আবশ্যক,যদিও আমরা এতে বিশ্বাস করি সঙ্গত কারণেই। কারণ,তা আহলে বাইতগণের (আ.) বর্ণনা থেকে সঠিকভাবে এসেছে। যাদেরকে আমরা মিথ্যাচার থেকে পবিত্র মনে করি। আর তা অদৃশ্যালোকের বিষয় যার সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং তা সংঘটিত হতে কোন বাধা নেই।

তাকিয়্যা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

“তাকিয়্যা হলো আমার দ্বীন ও আমার পূর্ব পূরুষের দ্বীন এবং যার তাকিয়্যা নেই তার দ্বীনও নেই।”

এটা ছিল আহলে বাইত (আ.) ও তাদের অনুসারীদের জান-মাল হেফাজত করার জন্য তাদের শ্লোগান। এ শ্লোগানের মাধ্যমে তারা মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়ন ও পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা করার এবং আনুগত্যের ছায়াতলে রাখার প্রয়াস পেয়েছিলেন।

এ তাকিয়্যা আজও শীয়াদের প্রতীক বলে চিহ্নিত হয়ে আসছে এবং তাদেরকে মুসলমানদের অন্যান্য দল থেকে পৃথক করে। যে কেউ তার বিশ্বাস প্রকাশিত হলে তার জান-মাল বিপদাপন্ন হবে বলে অনুভব করবে তাকে বাধ্য হয়েই গোপনীয়তা ও তাকিয়্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। এটা হলো আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তির দাবী। এটা সকলেরই জানা আছে ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় শীয়া ও তাদের ইমামগণ (আ.) সর্বদা নিষ্পেষিত ও স্বাধীনতা বঞ্চিত ছিলেন। কোন গোষ্ঠী ও কোন জাতিই তাদের মত এতটা নিপীড়নের স্বীকার হয়নি। সুতরাং তারা অধিকাংশ সময়ই তাকিয়্যা করতে এবং স্বীয় বিশ্বাসের ও আমলের গোপনীয়তা রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে তারা দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। আর এ কারণে তাকিয়্যার পরিচিতিতে তাদেরকে অন্যদের থেকে পৃথক করা হয়।

তাকিয়্যার জন্য আহকাম রয়েছে যা ক্ষতির আশংকা ভেদে নির্দেশ করে কখন তা আবশ্যক এবং কখন অনাবশ্যক। আর এ আহকাম সন্নিবেশিত আছে ফেকহের বিভিন্ন পুস্তকে। তাকিয়্যা সর্বদা ওয়াজীব বা আবশ্যক নয়। বরং অবস্থানুসারে কখনো তা আবশ্যক। আবার কখনো বা ইচ্ছাধীন। যদি সত্য প্রকাশ করা দ্বীনের জন্য সহায়ক ও দ্বীনের খেদমত হয় কিংবা দ্বীনের পথে জিহাদ বলে পরিগণিত হয়,তবে জান-মাল সেখানে কোন বিশেষ গুরুত্ব পায় না। আবার যখন তাকিয়্যার কারণে কোন মহাত্মা মৃত্যুমুখে পতিত হয়,মিথ্যা বিস্তৃতি লাভ করে,দ্বীনের ফেসাদ সৃষ্টি হয় কিংবা অজ্ঞতার কারণে দ্বীনের মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে অথবা জুলুম ও অত্যাচার বৃদ্ধি পায়,তবে সেখানে তাকিয়্যা করা হারাম। মোটকথা শীয়াদের নিকট এ দৃষ্টিকোণ থেকে নয় যে,তারা এর মাধ্যমে গোপন কোন সংগঠন করে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাবে,যেমনটি তাদের শত্রুরা যারা প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা বলে থাকে। এ ধরনের লোকেরা আমাদের কথা বুঝার জন্য কোন চেষ্টাই করে না। অনুরূপ তাকিয়্যার অর্থ এই নয় যে,দ্বীন ও দ্বীনের আহকাম তাদের নিকট গোপন ও লুক্কায়িত রাখা,যারা এতে বিশ্বাস করে না। অথচ শীয়াদের ইমামগণ (আ.) ও লেখকগণ ফিকাহ্,আহকাম,কালামশাস্ত্র ও অন্যান্য বিশ্বাসের উপর বিপুল সংখ্যক বই লিখেছেন যা অন্য যে কোন সম্প্রদায়ের নিকট তাদের দ্বীন ও বিশ্বাসকে বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট। নিঃসন্দেহে আমাদের বিশ্বাস তাকিয়্যাকে তারাই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে চায় যারা শীয়াদেরকে কলংকিত করতে চায়। তারা একে শীয়াদের দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছে। এ কারণেই শীয়াদের কন্ঠের উপর উমাইয়্যা,আব্বাসীয় এবং ওসমানীয়দের মত শত্রুদের উন্মুক্ত তরবারী ঝুলে থাকলেও এবং একজন আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীদের মৃত্যুর জন্য যখন শুধুমাত্র এটুকুই যথেষ্ট যে,‘সে একজন শীয়া’এমন এক পরিস্থিতিতেও তারা তুষ্ট হতে পারেনি।

যদি আমাদের শত্রুরা এ বলে আমাদের অপবাদ দেয় যে,দ্বীনের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকিয়্যার কোন ভিত্তি নেই,তবে আমরা তাদেরকে বলব-

প্রথমত : আমরা আমাদের ইমামগণের (আ.) অনুগত এবং আমরা তাদের পথনির্দেশনায় পথ চলি। তারা (আ.) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রয়োজনে তাকিয়্যা করতে। তাদের কাছে এটা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত বিষয়। বিশেষ করে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে আমরা জানতে পারি-

“যার তাকিয়্যা নেই,তার দ্বীন ও নেই।”

দ্বিতীয়ত : তাকিয়্যার বৈধতার ব্যাপারটি পবিত্র কোরআনেও এসেছে। যেমন,সূরা নাহালের ১০৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

“সে নয় যে বাধ্য হয় অথচ তার হৃদয়ে রয়েছে দৃঢ় ঈমান।”

এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল আম্মার ইয়াসীর সম্পর্কে যিনি কাফেরদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বাহ্যিকভাবে কাফের পরিচয় দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ আরও বলেন-

“তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। আর যে ব্যক্তি এরূপ করবে আল্লাহর কাছে তার জন্য কিছু্ই নেই। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশংকা কর,তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে।”(সূরা আল ইমান -২৮)

মহান আল্লাহ আরও বলেন-

“আর একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি যিনি তার ঈমানকে ফেরাউনের লোকদের নিকট গোপন করেছিল।” (সুরা মুমিন - ২৮)

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)