আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৩৩তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১২৫-১২৮

সূরা নিসার ১২৫ এবং ১২৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا (১২৫) وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطًا ((১২৬

"যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে, সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহীমের ধর্ম অনুসরণ করে-যিনি ছিলেন একনিষ্ঠ-তার চেয়ে উত্তম ধর্ম কার? আল্লাহ্ ইবরাহীমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন।" (৪:১২৫)

"যা কিছু নভোমণ্ডলে আছে এবং যা কিছু ভূমণ্ডলে আছে,সব আল্লাহরই। সকল বস্তু সবসময়ই আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে।" (৪:১২৬)

গত পর্বে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভের শর্ত হিসেবে ঈমান এবং নেক আমলের কথা বলেছিলাম। এ আয়াতে নেক এবং মুমিন ব্যক্তির মানসিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছে। বলা হচ্ছে-সেই ঈমানই পূর্ণ এবং মূল্যবান,যে ঈমান নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর দরবারে নিজেকে অনুগত বান্দা হিসেবে সপেঁ দেয়।যে ঈমান কেবল মুখে মুখে আল্লাহর আনুগত্যের ঘোষণা দেয় কিন্তু অন্তরে একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং বিনয়ের প্রকাশ নেই,সে ঈমান পূর্ণ নয়।আর পূণ্য কাজ তখনই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে যখন পূণ্যবান ব্যক্তি খালেস নিয়্যতে এবং সৎ উদ্দেশ্যে নেক কাজ করে। প্রতারণা,অহমিকা কিংবা বস্তুগত স্বার্থ হাসিল করার জন্যে নেক কাজ করলে তা গৃহীত হবে না। কোরআন খালেস ইমানের উদাহরণ দিতে গিয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ)কে যথার্থ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করেছে।

ঐশী আদর্শ অনুসরণের কারণে কোরআনের ভাষায় তাঁকে আল্লাহর বন্ধু নির্বাচন করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে তাঁর মর্যাদা এবং অবস্থান এতোই ঘনিষ্ঠ যে, ইসলামের নবীকেও তাঁর দ্বীন অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম ইব্রাহীমী ধর্মেরই অনুসারী বলে মনে করা হয়,কোরআনের এ আয়াতগুলোতে যাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

১.ঐশী ধর্মের স্বাভাবিক প্রকৃতি হলো আল্লাহর সামনে সদা নত থাকা এবং জনগণের প্রতি সদয় হওয়া।

২.ঈমান এবং আমল পরস্পরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অপরটি অপূর্ণ এবং নিষ্ফল।

৩.আল্লাহ যদিও মানুষকে ঈমান এবং আমলের দাওয়াত দিয়েছেন,কিন্তু আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা সকল আসমান,জমিন এবং পারিপার্শ্বিক সবকিছুর ওপরই আল্লাহ কর্তৃত্বশীল।

সূরা নিসার ১২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَيَسْتَفْتُونَكَ فِي النِّسَاءِ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِيهِنَّ وَمَا يُتْلَى عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ فِي يَتَامَى النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا تُؤْتُونَهُنَّ مَا كُتِبَ لَهُنَّ وَتَرْغَبُونَ أَنْ تَنْكِحُوهُنَّ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الْوِلْدَانِ وَأَنْ تَقُومُوا لِلْيَتَامَى بِالْقِسْطِ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِهِ عَلِيمًا ((১২৭

 

"তারা আপনার কাছে নারীদের অধিকার সম্পর্কে জানতে চায়। বলে দিন: (আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে কিছুই জানি না এবং কিছু বলবোও না, বরং) আল্লাহ্ তোমাদেরকে এ সম্পর্কে বলেন: ইয়াতিম নারীদের ব্যাপারে (বিধবা কিংবা পিতৃহীন মেয়েরা) তোমরা নির্ধারিত অধিকার প্রদান কর না অথচ তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার বাসনা রাখ। আর অক্ষম শিশু এবং ছোট্ট ছেলেদের ব্যাপারে কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর আদেশসমূহ তোমাদের পড়ে শোনানো হয়েছে (তিনি সবসময় আদেশ করেন) এতিমদের সাথে ন্যায় আচরণ করো। জেনে রেখো, তোমরা যেসব ভাল কাজ করবে,আল্লাহ্ সেসব সম্পর্কে জানেন।"(৪:১২৭)

 

সূরা নিসার প্রথম আয়াত অনুসরণে এই আয়াতেও বিয়ের বিধান এবং নারীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে বলা হচ্ছেঃ পুরুষদেরকে বলো,নারীদের অধিকার সম্পর্কে যেসব বিধানের কথা বর্ণিত হয়েছে,সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। নবী হবার পরও তাতে আমার কোনোরকম ভূমিকা ছিল না। মোহরানা,উত্তরাধিকারের দিক থেকে নারীদের সাধারণ আদেশ-নিষেধই কেবল নয় বরং বিধবা নারী,অসহায় ও ইয়াতিম ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারেও সকল বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। সেসব বিধান কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াত থেকে বোঝা যায় সকল বিষয়ে বিশেষ করে ইয়াতিম এবং অসহায়দের ব্যাপারে সাধারণ মানদণ্ড হলো ন্যায়পরায়ণতা। তাই শিশু এবং নারীদের পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায় করাই কেবল ওয়াজিব নয় বরং তাদের সাথে সৎ ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করারও আদেশ দেয়া হয়েছে।

 

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ

প্রথমতঃ সমাজ কিংবা পরিবারে যে সময় নারীদের কোনো অধিকারই ছিল না, ইসলাম তখন নারীদের পাশাপাশি শিশু এবং ইয়াতিমের অধিকারও রক্ষা করেছিলো।

দ্বিতীয়তঃ ইসলামের বিধিবিধানগুলো মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে।নবীজী কেবল সেগুলো ব্যাখ্যা ও বর্ণনার দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

সূরা নিসার ১২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا ((১২৮

"যদি কোন নারী স্বীয় স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে,তবে পরস্পর মীমাংসা করে নিলে তাদের উভয়ের কোন গোনাহ্ নেই। মীমাংসাই উত্তম। তবে মানুষের মনে সংকীর্ণতা,কৃপণতা বিদ্যমান আছে। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং খোদাভীরু হও, (যাই কর না কেন) আল্লাহ্ তোমাদের সব কাজের খবর রাখেন।"(৪:১২৮)

 

আগের আয়াতে পুরুষদেরকে নারীদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আদেশ দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে নারীদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ যদিও পারিবারিক অধিকার বিষয়ক বিধি বিধানগুলো পালিত হওয়া উচিত,তবে পারিবারিক বিধানগুলো সংরক্ষণ করাটা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কখনো এমন হয় যে অধিকারের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান পারিবারিক ব্যবস্থায় বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়,সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষই সমঝোতার পথ বেছে নেয়াটাই উত্তম। তাহলে পারিবারিক মূলনীতিটা বজায় থাকবে।

এখানে মূলত স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে পারিবারিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি তালাক বা বিচ্ছিন্নতার দিকে গড়ানোর আগেই সমঝোতার ভিত্তিতে মতপার্থক্য দূর করার চেষ্টা করতে হবে। (নারী-পুরুষের)নিজেদের মধ্যকার প্রবৃত্তিগত কামনা বাসনা যেন বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। বরং পারস্পরিক সৌহার্দ ও সহমর্মিতা যেন আগের সম্পর্ককে আরো দৃঢ়তরো করে তোলে-সেই চেষ্টা চালাতে হবে।

এ আয়াতের শিক্ষা হলোঃ

এক. পারিবারিক মূল ভিত্তি রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজন নারী-পুরুষ উভয়ের মনোবল শক্তিশালী করা।

দুই.পারিবারিক সমস্যাগুলো যতোটা সম্ভব অন্যদের হস্তক্ষেপ ছাড়া নারী-পুরুষ নিজেদের কল্যাণে নিজেরাই সমাধান করে নেয়ার ওপর ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে।

তিন. ইসলামের বিধি বিধানগুলো মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি এবং নীতি-নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলামের নীতিমালাগুলো মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটায়।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)