আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৩৫তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৩৩-১৩৬

সূরা নিসার ১৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِآَخَرِينَ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَلِكَ قَدِيرًا ((১৩৩

"হে মানুষ ! তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের ধ্বংস করতে পারতেন এবং অন্য প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষে তা সম্পূর্ণ সম্ভব।" (৪:১৩৩)

এ আয়াতে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তোমরা এমনটি ভেবো না যে ব্যাপারে আল্লাহ আদেশ দেন সেটা তাঁর প্রয়োজন। বরং প্রকৃতপক্ষে তোমাদেরকেও আল্লাহর প্রয়োজন নেই। যখন তোমরা ছিলে না, তখন কি আল্লাহর কোনো সমস্যা ছিল, যে সমস্যা তোমাদের আগমনে সমাধান হয়ে গেছে? সুতরাং আল্লাহর সামনে বড়াই বা অহংকার করো না। কেননা আল্লাহ চাইলে সকল অহংকারী আর উদ্ধত মানুষকে ধ্বংস করে দিতে পারেন এবং অনুগত ও আদেশ মান্যকারী মানুষদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ

১. কাফেরদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবকাশ দেয়ার মানে এই নয় যে তিনি অক্ষম,বরং এই অবকাশ আল্লাহর কৌশল ও রহমত থেকে উৎসারিত।

২. আমাদের যা কিছু আছে সবই আল্লাহর।এমনটি ভাবা উচিত নয় আমাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো সবসময়ের জন্যে স্থায়ী এবং সুস্থিত। এরকম ভেবে মিথ্যা অহংকারের কোনো মানে নেই।

সূরা আন নিসার ১৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَنْ كَانَ يُرِيدُ ثَوَابَ الدُّنْيَا فَعِنْدَ اللَّهِ ثَوَابُ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا بَصِيرًا ((১৩৪

"যে কেউ এই পৃথিবীর জীবনে পুরস্কার চায়,তার জেনে রাখা উচিত,আল্লাহ্‌র নিকট ইহকাল ও পরকাল-উভয়কালের-পুরস্কার রয়েছে। আল্লাহ্‌ সর্বদাই সবকিছু শোনেন ও দেখেন।" (৪:১৩৪)

এ আয়াতে সেইসব সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মুমিনদের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হচ্ছে,আল্লাহর ওপর যাদের ঈমান রয়েছে কিন্তু দুনিয়াবি কল্যাণ আর স্বার্থ-চিন্তাতেই বুঁদ হয়ে থাকে,আবার যুদ্ধেও অংশ নেয়। তবে যুদ্ধে পাওয়া গনিমতের মালামাল অর্থাৎ বস্তুগত ফলাফল নিয়েই ব্যস্ত থাকে,আল্লাহ এই দলটিকে সম্বোধন করে বলেনঃ তোমরা তো আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছো,তাহলে কেন শুধুমাত্র দুনিয়ারই স্বার্থ চাও আল্লাহর কাছে,যদিও ইহকাল এবং পরকাল উভয় জগতেরই পুরস্কারদাতা তিনি। তোমরা কি মনে কর যে আখেরাতের চিন্তা করলে দুনিয়াবি কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে? অথচ আল্লাহ মুমিনদের জন্যে দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জগতেরই কল্যাণ চান। একটির জন্যে আরেকটিকে বাদ দিলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখবোঃ

১. মানুষ যদি দুনিয়াবি কল্যাণের স্বার্থেই সৎ কাজ করে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২. ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী সামগ্রিক জীবন বিধান। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জাহানেরই কল্যাণ লাভের আদেশ দেয়।

 

সূরা নিসা'র ১৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا ((১৩৫

"হে মুমিনগণ ! আল্লাহ্‌কে সাক্ষী রেখে তোমরা ন্যায়ের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাক। যদি তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা, কিংবা তোমাদের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতির কারণও হয়;(যদি পক্ষগুলোর একটি)বিত্তবান হয় অথবা বিত্তহীন, তবু আল্লাহই তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব,তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুবর্তী হয়ো না। যদি তোমরা ন্যায়কে বিকৃত কর এবং ন্যায় বিচারকে অস্বীকার কর,অবশ্যই তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন।"(৪:১৩৫)

ইয়াতিম এবং স্ত্রীদের ব্যাপারে ন্যায় ও সমতা রক্ষার জন্যে আগের আয়াতে যেসব আদেশ দেয়া হয়েছে, তারি ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে সমগ্র মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, সর্বাবস্থায় সকল মানুষের ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠ হতে; ন্যায়ের মাপকাঠি রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনজনেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবুও। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কিংবা সাক্ষ্য দেয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আল্লাহর মানদণ্ডকেই সামনে রাখতে হবে, স্বজনপ্রীতি কিংবা ধনিক প্রীতি নয়। এই আদেশ থেকে প্রমাণিত হয় ইসলাম মানবিক বিষয়গুলোর প্রতি কতোটা নজর রাখে এবং সকল ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে মুমিনদেরকে সতর্ক থাকতে কী পরিমাণ গুরুত্ব দেয়।

এ আয়াত থেকে শিক্ষণীয় হলোঃ

১. ন্যায় প্রতিষ্ঠা নবীদের লক্ষ্য। ন্যায় নবীর অনুসারীদের ঈমানের অপরিহার্য শর্ত। আর ন্যায়ের মানদণ্ড হলো খোদার আদেশ পালন করা।

২. জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ন্যায়ের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। সকল মানুষের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য এমনকি অমুসলিমও যদি হয়।

৩. ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মানুষ আইনের সামনে সমান। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে, চাই পক্ষে যাক কিংবা বিপক্ষে।

৪. ন্যায় বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে যে তিনি সবকিছুই জানেন সে ব্যাপারে সুদৃঢ় আস্থার ওপর নির্ভরশীল।

 

সূরা নিসার ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا آَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا ((১৩৬

"হে ঈমানদারগণ,আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর, বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর রাসূল ও তাঁর ওপর অবতীর্ণ কিতাবের উপর,এবং ইতোপূর্বে অবতীর্ণ সমস্ত কিতাবের ওপর। যে আল্লাহর ওপর,তাঁর ফেরেশতাদের ওপর,তাঁর কিতাব সমূহের ওপর এবং রাসূলগণের ওপর ও কিয়ামতদিনের ওপর বিশ্বাস করবে না,সে পথভ্রষ্ট হয়ে সুদূর ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হবে। " (৪:১৩৬)

এ আয়াতে মুমিনদেরকে তাদের ঈমানের দৃঢ়তা ও বিকাশ ঘটানোর আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছেঃ সামনের দিকে অগ্রসর হও,যতোদূর সম্ভব মর্যাদার উচ্চ পর্যায়ে নিজেকে স্থাপন করো। ঈমানকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তরো করো,বিন্দুমাত্রও ঈমান থেকে দূরে সরো না।

এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষার স্তর বিন্যাসের মতো ঈমানেরও বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় রয়েছে। একজন গণিতবিদ কিংবা একজন রসায়নবিদ যেমন স্কুলের একজন ছাত্রের চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভালো জানেন বা বোঝেন,ঈমানের স্তরভিত্তিক মুমিনগণও ঠিক তেমনি। এ কারণেই আল্লাহ সর্বাবস্থায় নিজেদের ঈমানকে পূর্ণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই পূর্ণতার শর্ত হলো- যতো বেশি সম্ভব আল্লাহর আদেশ পালনের চেষ্টা করা।

তবে এ আয়াতে একটি বিষয়ে মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছেঃ মুমিনের ঈমান যদি এতোটাই দুর্বল হয় যে নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপারেই নিজের ভেতর প্রশ্নের সৃষ্টি হয়,তাহলে কঠিন গোমরাহির পথে চলে যাবার আশঙ্কা থেকে যায়,যেখান থেকে ফিরে আসাটা খুবই কঠিন ব্যাপার।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. ঐশী ধর্মগুলো স্কুলের ক্লাসের মতোই। নবীগণ হলেন ঐ স্কুলের শিক্ষক। সকল শিক্ষকই একই লক্ষ্যে কাজ করেন।তাই আল্লাহর ওপর ঈমান আনার অন্যতম শর্ত হলো সকল ঐশী গ্রন্থ এবং সকল নবীর প্রতি ঈমান আনা।

দুই.ঈমান রক্ষার উপায় হলো তার বৃদ্ধি এবং বিস্তার ঘটানো। মুমিনের উচিত হলো সবসময় চেষ্টা করা-কী করে ঈমানের উচ্চতরো পর্যায়ে যাওয়া যায়।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)