আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৩৬তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৩৭-১৪১

সূরা নিসার ১৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا ((১৩৭

"যারা একবার ঈমান এনে পরে পুনরায় কাফের হয়ে গেছে,আবার ঈমান এনেছে এবং আবারো কাফের হয়েছে এবং [অন্তরের] অবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছে,আল্লাহ্ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না,তাদের সৎ পথও দেখাবেন না।"(৪:১৩৭)

পূর্বের আয়াতে মুমিন এবং কাফিরদের পরিণতি সম্পর্কে বলার পর এ আয়াতে এমন এক দল মানুষের পরিণতি সম্পর্কে বলা হচ্ছে যারা প্রতিদিনই তাদের রং বদলাতো, প্রতি মুহূর্তেই একেক রূপ ধারণ করতো। একদিন মুমিনদের কাতারে এবং আরেকদিন কাফেরদের কাতারে অবস্থান করতো। তাদের এই রং বদলানো বা বিশ্বাসগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কিন্তু সত্য আবিষ্কার করা কিংবা সঠিক আদর্শে পৌঁছার পথ অনুসন্ধান করা নয়। বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়াবি বা বস্তুগত স্বার্থ হাসিল করা। যেখানেই এই স্বার্থের গন্ধ পায় সেদিকেই ছুটে যায় তারা। এই দ্বিমুখি আচরণ মোনাফেকির শামিল। এ অবস্থায় এদের কেউ যদি মারা যায় স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর রহমত কিংবা ক্ষমার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তাদের আচরণই ঐশী হেদায়েত প্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

১. ধর্মত্যাগের বিপদ প্রত্যেক মুমিনের জন্যেই ভীতিকর। অতএব আজকের ইমানের জন্যে অহংকারী না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

২. বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নড়বড়ে অবস্থা মানুষকে গোমরাহ করে ফেলে এবং আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত থেকে দূরে ঠেলে দেয়।

সূরা নিসা'র ১৩৮ এবং ১৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

بَشِّرِ الْمُنَافِقِينَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا (১৩৮) الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا ((১৩৯

"হে নবী! মুনাফিকদের শুভ সংবাদ দিন যে,তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" (৪:১৩৮)

"যারা মুমিনদের পরিবর্তে অবিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে,তারা কি ওদের কাছে সম্মান আশা করে? না,সকল সম্মানের মালিক আল্লাহ।"(৪:১৩৯)

মোনাফিকদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- কাফেরদের চেয়ে নিজেদেরকে মহান বলে মনে করে এবং তাদের কাছ থেকে সম্মান ও মর্যাদা কামনা করে। তারা ভাবে মুমিনদের সাথে চললে কিংবা তাদের অনুসরণ করলে তাদের মর্যাদা কমে যাবে এবং তারা ছোট হয়ে যাবে। এ কারণে তারা নিজেদেরকে মুমিন বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। অথচ প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা ঐশী জ্ঞান ও শক্তির ওপর নির্ভরশীল,ধনসম্পদ কিংবা জুলুমের ওপর নয়। আর একমাত্র আল্লাহই অসীম জ্ঞান এবং শক্তির অধিকারী। তাই সত্যিকারের সম্মান ও মর্যাদা পেতে হলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ

১. যেসব মুমিন কাফেরদের সাথে সম্পর্কের মাঝে নিজেদের সম্মান খোঁজে তারা আসলে মোনাফিক। কেননা একজন মুমিন কখনোই কাফেরদের আধিপত্যের অপমান সহ্য করতে পারে না।

২. পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অমুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বিস্তারের পরিবর্তে মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

সূরা নিসা'র ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعًا ( (১৪০

"এবং ইতোপূর্বে তিনি কোরআনে তোমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহ্‌র আয়াতকে অস্বীকার করা হচ্ছে কিংবা বিদ্রুপ করা হচ্ছে,তাদের সাথে তোমরা বসো না,যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মোনাফেক ও যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে সকলকে জাহান্নামে একত্রিত করবেন।"(৪:১৪০)

এ আয়াতে মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত বিরোধীদের অর্থাৎ যারা দ্বীনের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের বৈঠকে যোগ দেয়। দ্বিতীয়ত দ্বীনের পবিত্রতার অবমাননা করা হলে এরা নিরব থাকে। অথচ একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো এ ধরনের কথা বলার সুযোগ না দেয়া অন্যথায় এ ধরনের পাপের বৈঠক ত্যাগ করা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

১. অন্যায় বা পাপের বৈঠকে অংশ নেয়াটা পাপ কাজে অংশ নেয়ার শামিল। যদি অংশগ্রহণকারী চুপচাপ বসেও থাকে।

২. কাফেরদের সাথে উঠাবসা করা জায়েজ যদি তারা দ্বীনের অবমাননা না করে।

৩. বাক-স্বাধীনতার ধুয়া তুলে দ্বীনের পবিত্রতা ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে দেয়া যাবে না।

সূরা নিসা'র ১৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا ((১৪১

"তারাই মুনাফিক,যারা তোমাদের সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং অমঙ্গলের প্রতীক্ষা করে। যদি তোমরা,আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বিজয় লাভ কর তারা বলে : "আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?" কিন্তু যদি অবিশ্বাসীরা বিজয়ী হয়,তারা তাদের বলে,"আমরা কি তোমাদের জন্য সুবিধা অর্জন করি নাই? এবং আমরা কি তোমাদের মুমিনদের বিরুদ্ধে পাহারা দিই নাই?"কিন্তু শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্‌ আমাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করবেন। এবং আল্লাহ্‌ কখনই মুমিনদের উপরে কাফিরদের বিজয়ের পথ রাখবেন না।"(৪:১৪১)

মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সুযোগের সন্ধানে থাকা। তারা সকল পরিস্থিতিকেই নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর অপেক্ষায় থাকে। মুমিনরা যদি বিজয়ী হয় তাহলে বলেঃ আমরাও তোমাদের সাথে ছিলাম এবং তোমাদের সহযোগিতা করেছি,সুতরাং বিজয় এবং গণিমতে আমাদেরও অংশ আছে।

আর যদি শত্রুরা যদি জয়ী হয় তাহলে তাদেরকে বলেঃ আমরাই এই বিজয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি। তোমাদেরকে আন্দোলিত করেছি এবং মুসলমানদের আঘাত থেকে রক্ষা করেছি। এরা হলো দ্বিপাক্ষিক গোয়েন্দা। কখনো তারা কাফেলার বন্ধু,কখনো বা চোরের।

তবে আয়াতের শেষাংশে মুমিনদের আশাবাদ দেয়া হচ্ছে যে,ইতিহাসের কালপরিক্রমায় সত্য-মিথ্যার মধ্যকার যুদ্ধে যতো উত্থান-পতনই ঘটেছে,পরিণতি মুমিনদের পক্ষেই গেছে। আল্লাহ কখনোই মুমিনদের ওপর কাফেরদের বিজয় দেননি।

বর্তমানে যদিও দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাফেররাই হুকুমাত করছে, এর কারণ হলো মুমিনদের অনেকেরই প্রকৃত ঈমান নেই এবং তাদের ধর্মীয় দায়িত্বগুলো যথার্থভাবে পালন করছে না। তারা না ব্যক্তিগত আচার আচরণে আল্লাহর বিধি বিধান মেনে চলছে,না সামাজিক ক্ষেত্রে ঐক্য ও একাত্মতা বজায় রাখছে।

আল্লাহর প্রতিশ্রুতি যথার্থ। তবে শর্ত হলো মুমিনদেরকে ইমানের ক্ষেত্রে দৃঢ় হতে হবে। তা যদি হয় তবে তাদের ওপর কাফেরদের হুকুমাত করার সম্ভাবনা নেই।

এ আয়াতের শিক্ষা হলোঃ

১. সুযোগের সন্ধান মুনাফিকদের একটা বৈশিষ্ট্য। চেষ্টা করতে হবে সত্যের সন্ধান করার,সুযোগের নয়।

২. কাফেরদের আধিপত্য মেনে নেয়ার অধিকার মুসলিম দেশগুলোর নেই। অমুসলিম দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তখনি রাখা যাবে, যখন কাফেরদের আধিপত্যের কারণ কিংবা মুমিনদের অমর্যাদা না হয় এবং স্বাধীনতার ওপর আঘাত না আসে।

৩. এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কাফেররা মুমিনদের ওপর আধিপত্যের চিন্তা চিরদিনের জন্যে বাদ দেয় এবং প্রত্যেক দিন যেন নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের চিন্তা না করে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)