আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৩৭তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৪২-১৪৬

সূরা নিসার ১৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا ((১৪২

"মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চায়। অথচ আল্লাহ তাদের (কাজের শাস্তি হিসেবে) প্রতারিত করেন। তারা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন তারা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মত শিথিলচিত্তে দাঁড়ায়, তারা লোকদের দেখানোর জন্যই নামাজে দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে।" (৪:১৪২)

গত পর্বে আমরা মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছিলাম। এই আয়াতে মুনাফিকদের আরো একটি মানসিকতা তুলে ধরে বলা হয়েছে: ঈমান যাদের অন্তরকে স্পর্শ করেনি তারা নামাজ-রোজা ও এবাদত-বন্দেগীর সময় অত্যন্ত অলস, নির্জীব ও নিস্তেজ থাকে। তারা নামাজের সময় শুরু হওয়ার অনেক পরে বা শেষ সময়ে নামাজ পড়ে এবং তাও খুব তাড়াহুড়া করে আদায় করে। এরা আসলে অন্যদের দেখানোর জন্যই নামাজ পড়ে, আল্লাহর স্মরণ বা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কথা তাদের খুব কমই মনে পড়ে। মহান আল্লাহ বলছেন, এই জাতীয় লোকেরা মনে করে যে, তারা আল্লাহকেও ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা নিজেদেরকে আল্লাহর দরবারে মুমিনদের কাতারের সমকক্ষ বলে দেখাতে পেরেছে, অথচ আল্লাহ তাদের অন্তরের অবস্থা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরোপুরি জানেন। আল্লাহ তাদের বাহ্যিক কাজ-কর্মও দেখছেন এবং তিনি তাদের সাথে তাদের অনুরূপ আচরণই করছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে মুসলমান বলে ধরে নিচ্ছেন এবং তাদের সাথে মুসলমানদের মত আচরণ করারই নির্দেশ দিচ্ছেন, কিন্তু পরকালে তাদেরকে কাফের হিসেবেই শাস্তি দেবেন। কারণ, রিয়া বা লোক দেখানো সৎকর্ম ও এবাদত শির্ক এবং দুই প্রভুতে বিশ্বাসের লক্ষণ।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হল:

প্রথমত: নামাজের মধ্যে আনন্দ না পাওয়া, আল্লাহকে ভুলে থাকা ও লোক-দেখানো নামাজ বা সৎকাজ-এসবই নিফাক বা কপটতার লক্ষণ। তাই সবারই সাবধান হওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত: মহান আল্লাহ মানুষকে তাদের কাজ অনুযায়ী শাস্তি দেবেন। দুনিয়ার জীবনে হয়তো মানুষকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব, কিন্তু খোদায়ী শাস্তি এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

 

সূরা নিসার ১৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مُذَبْذَبِينَ بَيْنَ ذَلِكَ لَا إِلَى هَؤُلَاءِ وَلَا إِلَى هَؤُلَاءِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا ((১৪৩

"মুনাফিকরা কুফর ও ঈমানের দোটানায় দোদুল্যমান, তারা না এদিকে, না ওদিকে! আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তাদের জন্য মুক্তির পথ খুঁজে পাবে না।" (৪:১৪৩)

এখানে মুনাফিক বা কপটচারী ব্যক্তিদের চরিত্রের আরেকটি বড় দিক তুলে ধরা হয়েছে। এ দিকটি হল, অস্থির চিত্ততা তথা এদের চিন্তা, বিশ্বাস ও লক্ষ্য স্থির বা দৃঢ় নয়। তাই তারা বিশ্বাসের অভাবে একদিকে মুমিন বা বিশ্বাসীদের পথে এগুতে চায় না, আবার তাদের মনের অবিশ্বাসের কথা প্রকাশ করার ও প্রকাশ্যে কাফেরদের শিবিরে যোগ দেয়ার সাহসও পায় না। তারা প্রতি দিনই বা ঘন ঘন রং পাল্টায়। বাতাসে ভাসমান বস্তুর মত যেদিকে বাতাস বয় সেদিকেই ভেসে যায়। আর এটা স্পষ্ট ও স্বাভাবিক যে যারা এ ধরনের দুর্বল মনের অধিকারী ভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্ত ও চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের জন্য অন্য কোনো পথ খোলা নেই। আর ইহ-জীবনে এটাই তাদের প্রাপ্য শাস্তি বা খোদায়ী আজাব।

 

এ আয়াত থেকে যেসব শিক্ষণীয় দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল:

এক. কপট মানসিকতা মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে কেড়ে নেয় এবং এ ধরনের মানুষ অন্যদের চিন্তার দাসে পরিণত হয় ও ভ্রান্তির বেড়াজালে ঘুরপাক খেতেই থাকে।

দুই. মুনাফিকরা আল্লাহর ক্রোধের শিকার এবং তারা ঐশী হেদায়াত বা দিক-নির্দেশনায় উপকৃত হয় না, বরং সব সময়ই অচলাবস্থার মধ্যে থাকে।

 

সূরা নিসার ১৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا ((১৪৪

"হে মুমিনরা! তোমরা কাফের বা অবিশ্বাসীদেরকে কখনও বিশ্বাসী বা মুমিনদের পরিবর্তে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহর কাছে নিজেদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বা স্পষ্ট দলিল পেশ করতে চাও?" (৪:১৪৪)

 

মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ মুমিনদের সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, মুনাফিকদের মত তারা মুমিনরাও যেন কখনও কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ও তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা না করেন। কারণ, এটা ঈমান-বিরোধী কাজ এবং এমন কাজের জন্য মুমিনরা আল্লাহর কাছে কোনো যুক্তি দেখাতে পারবেন না। আর আল্লাহ মুমিনদের কাছেও কৈফিয়ত চাওয়ার অধিকার রাখেন। তাই মুমিনদের জন্য একমাত্র মুমিনরাই বন্ধু ও অভিভাবক হওয়ার যোগ্য।

এ আয়াত থেকে যেসব সত্য বেরিয়ে এসেছে তা হল:

এক. যেসব পদক্ষেপ ইসলামী সমাজের ওপর কুফরি শক্তির কর্তৃত্বের জন্য সহায়ক হয় সেসব পদক্ষেপই নিন্দনীয়। কোনো চুক্তি যদি কাফেরদের কর্তৃত্বের পথ সুগম করে তাহলে ওই চুক্তি কোনো ক্রমেই স্বাক্ষর করা উচিত নয়।

দুই. মুমিনদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কাফেরদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা ঈমানের শর্ত।

 

সূরা নিসার ১৪৫ ও ১৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا (১৪৫) إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ فَأُولَئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ أَجْرًا عَظِيمًا ((১৪৬

"নিশ্চয়ই মুনাফিকরা নরকের আগুনের সর্বনিকৃষ্ট স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোনো সাহায্যকারী পাবে না।" (৪:১৪৫)

"কিন্তু যারা তওবা করে, নিজেদের অতীত কৃতকর্মের সংশোধন করে ও আল্লাহর আশ্রয় নেয় এবং আল্লাহর জন্য ধর্মে বিশুদ্ধ হয়, তারা বিশ্বাসীদের সঙ্গে থাকবে। আল্লাহও শিগগিরই মুমিনদের মহাপুরস্কার দেবেন।" (৪:১৪৬)

 

এ দুই আয়াত থেকে স্পষ্ট হল, নিফাক বা কপটতা অবিশ্বাস বা কুফরির সবচেয়ে নিকৃষ্টতম স্তর এবং তারা আল্লাহর পথ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করছে। তাই তারা নরকাগ্নির সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও গভীর স্তরে থাকবে। আর তাদের শাস্তি এমনই হওয়া উচিত। কারণ, তারা মুমিনের ছদ্মবেশ নিয়ে শত্রুদের পক্ষে কাজ করে এবং সব সময় পেছন থেকে ছুরি মারে। বন্ধুবেশী শত্রুই সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু।

কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ দয়ার দুয়ার এ ধরনের লোকদের জন্যও বন্ধ নয়। মুনাফিকরা যদি নিজেদের অতীত কৃতকর্মের ধারা ত্যাগ করে এবং যতটা কাজ শুদ্ধ বা সংশোধন করা সম্ভব হয়, তত অংশকে শুদ্ধ করে। এর পাশাপাশি নিজ বিশ্বাস ও কাজকে কৃত্রিমতা বা প্রদর্শনের মাধ্যমে তুলে ধরা এবং দ্বিচারিতা থেকে মুক্ত করে তাহলে আল্লাহ তাদেরকে মুমিন হিসেবে বরণ করে নেবেন। শুধু তাই নয় তিনি তাদের মহাপুরস্কারও দেবেন।

এখান থেকে আমরা সংক্ষেপে যা শিখতে পারি তা হল:

এক. দুনিয়ার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিয়ামতে বা বিচার দিবসে মুক্তির কোনো পথ নেই। তাই পার্থিব জীবনেই তওবা করে ও সৎকর্ম করে মুক্তির চাবি অর্জন করতে হবে।

দুই. পার্থিব জীবনে তওবা বা ক্ষমার পথ সবার জন্য সব সময়ই খোলা। আল্লাহর দরবারে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)