আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৩৮তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৪৭-১৫২

সূরা নিসার ১৪৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

مَا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآَمَنْتُمْ وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا ((১৪৭

"তোমাদেরকে শাস্তি দেয়ার কি প্রয়োজন রয়েছে আল্লাহর-তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও এবং ঈমান আন, আল্লাহ প্রতিদান দাতা বা কৃতজ্ঞ এবং তিনি সব কিছু জানেন।" (৪:১৪৭)

কাফের বা অবিশ্বাসীদের কঠোর শাস্তি দেয়ার ঘোষণা সংক্রান্ত আয়াতের পর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তোমরা এমনটি ভেব না যে, আল্লাহ প্রতিহিংসার বশে বা প্রতিশোধ হিসেবে অথবা ক্ষমতা দেখানোর জন্য অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকেন, বরং সব শাস্তিই তোমাদের নিজ কাজেরই প্রতিফল। মানুষকে শাস্তি দেয়ার কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। এরপরই আল্লাহ বলছেন, তিনি কৃতজ্ঞ এবং এ কারণেই তিনি মানুষকে তাদের ভাল কাজের পুরস্কার দিয়ে থাকেন। তাই মানুষেরও উচিত মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া এবং যে পথে চললে আল্লাহ খুশি হন সে পথে চলার মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতগুলোর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর যদি কেউ বিশ্বাস ও সৎকর্মশীলতা নিয়ে আল্লাহর নেয়ামতের শোকর করে তাহলে কখনও শাস্তি বা আজাব তাদের স্পর্শ করবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি বার্তা হল,

প্রথমত: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা ঈমান আনার জন্য তাঁর দেয়া নেয়ামতগুলোর জন্য শোকর করা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অপরিহার্য, কারণ, আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের অর্থ তাঁর নেয়ামতগুলোকে অস্বীকার করা।

দ্বিতীয়ত: কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আল্লাহর ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষার উপায় এবং এর ফলে বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ বেড়ে যায়।

সূরা নিসার ১৪৮ ও ১৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا (১৪৮) إِنْ تُبْدُوا خَيْرًا أَوْ تُخْفُوهُ أَوْ تَعْفُوا عَنْ سُوءٍ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا قَدِيرًا ((১৪৯

"কেউ মন্দ বিষয়গুলো প্রকাশ বা প্রচার করুক, আল্লাহ তা পছন্দ করেন না, অবশ্য যার ওপর জুলুম করা হয়েছে তার কথা আলাদা। আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও সব কিছু জানেন।" (৪:১৪৮)

"যদি তোমরা সৎকাজ প্রকাশ কর অথবা গোপন কর, কিংবা অন্যায় ক্ষমা কর, তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সর্বশক্তিমান।" (৪:১৪৯)

এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর তা হল, অন্যদের দোষ-ত্রুটি ও মন্দ কাজ সমাজে প্রকাশ করা উচিত নয়। অন্যদের খারাপ আচরণ বা ভুলগুলোকে ক্ষমা করা উচিত, বরং অন্যদের ভালকাজগুলো প্রকাশ করাই উত্তম। কারণ, মহান আল্লাহ নিজেও মানুষের দোষ-ত্রুটি ও মন্দ বিষয়গুলো ঢেকে রাখেন এবং সেগুলো ফাঁস করেন না। অবশ্য কেউ যদি জুলুমের শিকার হয়ে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে জুলুমের কথা উল্লেখ করার ও অভিযোগ তুলে ধরার অধিকার সবারই রয়েছে। কারণ, জুলুমের কথা উল্লেখ না করলে জালেমের কাছ থেকে কেউ নিজের অধিকার আদায় করতে পারবে না।

এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হল:

১. অন্যদের ভুল-ত্রুটি প্রচার করা বৈধ নয়, অবশ্য জুলুম প্রতিরোধের জন্য ও মজলুমকে সহায়তা দেয়ার জন্য এ ধরনের প্রচার বৈধ।

২. শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া খুবই কল্যাণকর কাজ এবং মহানুভবতার লক্ষণ। আল্লাহ সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও মানুষের অনেক পাপ বা গোনাহ ক্ষমা করে দেন।

সূরা নিসার ১৫০ ও ১৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا (১৫০) أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا ((১৫১

"নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহ ও তাঁর নবী-রাসূলে অবিশ্বাস করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলবর্গের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায়, আর বলে যে, আমরা কোনো কোনো রাসূলের প্রতি ঈমান আনব ও কোনো কোনো রাসূলকে অস্বীকার করব, (নিজেদের খেয়াল-খুশি মোতাবেক ) একটি মাঝামাঝি পথ বেছে নেয়।" (৪:১৫০)

"এরাই হল প্রকৃত বা খাঁটি কাফের। আমরা কাফেরদের জন্য অবমাননাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।" (৪:১৫১)

এখানে খোদায়ী ধর্মগুলোর অনুসারীদের একটি বড় বিপদের কথা বলা হয়েছে। এ বিপদটি হল, খোদার উপাসকদের কেউ কেউ শুধু নিজেদের নবীকেই সঠিক ও সত্য মনে করে, অন্য নবী-রাসূলকে অস্বীকার করে ও তাদের সত্য নবী মনে করে না। অথচ সব নবী-রাসূলই আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে এটা স্পষ্ট যে, নবী-রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ নবীর বিধানই অনুসরণ করতে হবে।

এ দুই আয়াত প্রথমত: ইহুদিদের ধর্মহীনতা তুলে ধরার জন্য নাজেল করা হয়েছে। হযরত ঈসা (আ.) ইহুদিদের কাছে নবী হিসেবে মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও তারা এ মহান নবীর প্রতি ঈমান আনেনি। এরপর ইহুদিদের মত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র প্রতি ঈমান আনেনি এবং সর্বশেষ নবীর রেসালাতকে অস্বীকার করেছে। আসলে ঈমানের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আল্লাহর এবাদত, আত্মপূজা নয়। যারা ধর্মের বিধানের মধ্যে কিছু অংশের অনুসরণ করে ও কিছু অংশের অনুসরণ করে না তারা আসলে নিজেদের খেয়াল-খুশিরই অনুসারী। তাদেরকে ধর্মীয় বিধানের অনুসারী বলা যায় না।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের যা মনে রাখা জরুরি তা হল:

এক. সব নবীকে সত্য নবী বলে বিশ্বাস করা ঈমানের অন্যতম শর্ত। তাই তাঁদের সবার প্রতি ও তাঁদের কাছে নাজেল হওয়া ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

দুই. ধর্ম হচ্ছে কিছু বিশ্বাস, নীতি ও বিধানের সামষ্টিক রূপ। এর কিছু অংশকে গ্রহণ ও কিছু অংশকে বর্জন করা যায় না। এমনকি ধর্মের একটি মাত্র অংশকেও অস্বীকার করা কুফরি বা ধর্মহীনতার সমতূল্য।

সূরা নিসার ১৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَالَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ أُولَئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا ((১৫২

"যারা আল্লাহ ও তাঁর নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে এবং তাঁদের কারো মধ্যে পার্থক্য করে না, আল্লাহ শিগগিরই তাদের পুরস্কার দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।" (৪:১৫২)

এখানে এ সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসীরা সব নবী-রাসূলকেই সত্য নবী-রাসূল বলে বিশ্বাস করেন। তারা এটা বলেন না, যে কেবল আমাদের নবীই সত্য নবী, অন্য নবীদের অস্বীকার করছি। এদের মধ্যে এ ধর্মান্ধতা বা অযৌক্তিক বিশ্বাস নেই যে কেবল নিজেদেরই মুমিন বা বিশ্বাসী বলে মনে করে ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের কাফের মনে করে। এটা স্পষ্ট, এ ধরনের মুমিনই আল্লাহর রহমত পাবেন এবং ইহকাল ও পরকালে আল্লাহর বিশেষ দয়ার পাত্র হবেন।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)