আল হাসানাইন (আ.)

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ‘আবির্ভাব-পূর্ব ফিতনা’

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

‘ফিতনা’ (فتنة) শব্দটি পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ্য় সাধারণ ও বিশেষ এ দু’অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে । ‘ফিতনা’-এর সাধারণ অর্থ হচ্ছে, যে কোন ধরনের পরীক্ষা মানুষ যার সম্মুখীন হয়ে থাকে- চাই তা মানুষের পক্ষ থেকেই হোক অথবা শয়তানের পক্ষ থেকে; চাই সে এ পরীক্ষায় সফল হোক এবং এ ফিতনা ও গোলযোগ থেকে মুক্তি পাক অথবা এর মধ্যে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হোক ।

‘ফিতনা’-এর বিশেষ অর্থ : ফিতনা হচ্ছে ঐ সব ঘটনা ও পরিস্থিতি যেগুলো মুসলমানদেরকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলবে এবং ধর্মের সীমানা থেকে বের করে দেবে ও বিচ্যুত করবে । আর যে সব অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন সেগুলোর অর্থও হচ্ছে ঠিক এটিই ।

তবে সাহাবী ও তাবেয়িগণ নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু রেওয়ায়েত ও হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে তাঁর ওফাতের পর যে সব ফিতনা, গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হবে সেগুলোর ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন ।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মাঝে হুযাইফাহ্ ইবনে ইয়ামান (রা.) ফিতনা সংক্রান্ত যে সব রেওয়ায়েত ও হাদীস আছে সেগুলো সম্পর্কে তাঁর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকার কারণে প্রসিদ্ধ ছিলেন । কারণ তিনি ফিতনা ও গোলযোগ সম্পর্কে মহানবী (সা.)- কে জিজ্ঞাসা এবং ঐ সব রেওয়ায়েত ও হাদীস মুখস্ত করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন ।

এ কারণেই বেশ কিছু হাদীস গ্রন্থে ফিতনা সংক্রান্ত রেওয়ায়েত হুযাইফাহ্ ইবনে ইয়ামানের সূত্রে মহানবী (সা.) অথবা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে । আর তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.)-এর বিশেষ শিষ্য ও সাথীদের অন্তর্ভুক্ত ।

যেমন তাঁর নিকট থেকে রেওয়ায়েত করা হয়েছে যে, তিনি বলতেন :

“কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল গোলযোগ সৃষ্টিকারী (ফিতনাবাজ) যাদের সংখ্যা ৩০০ পর্যন্ত পৌঁছবে আমি যদি তাদের নাম, তাদের পিতার নাম এবং তাদের বসবাস করার স্থান উল্লেখ করতে চাই তাহলে আমি তা করতে পারব । কারণ মহানবী (সা.) তাদের ব্যাপারে আমাকে জানিয়েছেন ।”

তিনি আরো বলতেন :

“আমি যা জানি তা সব কিছু যদি তোমাদের কাছে বলতাম তাহলে তোমরা আমাকে এক রাতেরও সুযোগ দিতে না, তৎক্ষণাৎ আমাকে হত্যা করতে ।”(ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, পৃ. ১-২)

ফিতনা সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি এতটাই ছিল যে, তাদের কারো কারো গ্রন্থে ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং তাঁর আবির্ভাব সংক্রান্ত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহ প্রাধান্য লাভ করেছিল । এ কারণেই হাদীস সংকলকগণ বেশ কিছু অধ্যায় ‘ফিতান’ (ফিতনাসমূহ) অথবা ‘মালাহিম ওয়া ফিতান’ (ঘটনা ও গোলযোগসমূহ)- এ শিরোনামে লিপিবদ্ধ করেছেন । ‘মালাহিম’ শব্দটি যুদ্ধ-বিগ্রহ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী অর্থে ব্যবহৃত হয়, তবে এখানে ভবিষ্যতে যেগুলো ঘটার সংবাদ মহানবী (সা.) দিয়েছেন তা বোঝানো হয়েছে ।

এ কারণেই কতিপয় রাবী (বর্ণনাকারী) ও আলিম (শাস্ত্রীয় পণ্ডিত) ‘আল ফিতান ওয়াল মালাহিম’ নামে বিশেষ গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এতৎসংক্রান্ত বর্ণিত হাদীস ও রেওয়ায়েত ঐ সব গ্রন্থে সংকলন করেছেন ।

এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা ফিতনা ও গোলযোগসমূহের সংখ্যা গণনা, এগুলোর সূত্রপাত এবং মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের সাথে এগুলোকে মিলিয়ে দেখার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সর্বশেষ ফিতনা পরিচিতি’- যে ব্যাপারে সবার ঐকমত্য আছে যে, তা হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে দূরীভূত হবে । আর এই ফিতনার বৈশিষ্ট্যগুলো পাশ্চাত্য ফিতনার সাথে পুরোপুরি মিলে যায় যার প্রভাব এ বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে মুসলিম জাতিসমূহের নিকট স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং অগণিত সমস্যার সৃষ্টি করেছে । কারণ পাশ্চাত্য আমাদের দেশ অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তারা আমাদের সম্পদ, ভাগ্য এবং যাবতীয় বিষয়ের ওপর কর্তৃত্বশীল হয়েছে । এ ব্যাপারে আমাদের প্রাচ্য দেশীয় শক্ররা তাদের সাথে সহযোগিতা করেছে । তারা মুসলিম বিশ্বের একাংশ দখল করে নিয়েছে এবং ইসলামের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে ঐ অঞ্চলকে নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে ।

এখানে আমরা কতিপয় রেওয়ায়েত নমুনাস্বরূপ উপস্থাপন করছি :

মহানবী (সা.) বলেছেন :

“আমার উম্মতের ওপর চারটি ফিতনা আপতিত হবে । প্রথম ফিতনায় রক্তপাত, দ্বিতীয় ফিতনায় রক্তপাত ও সম্পদ লুণ্ঠন এবং তৃতীয় ফিতনায় রক্তপাত, সম্পদ লুণ্ঠন ও নারীহরণ বৈধ মনে করা হবে । তবে চতুর্থ ফিতনাটি অন্ধ ও বধিরের ন্যায় সর্বগ্রাসী হবে এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রবক্ষে একটি চলমান জাহাজের গতির মতো হবে যাতে কোন লোকই আশ্রয়স্থল খুঁজে পাবে না । ঐ ফিতনার উত্থান হবে শাম থেকে এবং তা সমগ্র ইরাককে গ্রাস করবে এবং জাযীরাকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে । বিপদাপদ ও সংকট জনগণকে ট্যানারীর চামড়া পাকানোর মতো মলতে থাকবে এবং কোন ব্যক্তিই বলতে সাহস করবে না যে, ‘ফিতনা বন্ধ কর’ । যদি কোন এক দিকে এ ফিতনা বিলুপ্ত হয়, তাহলে তা অন্যদিকে পুনরায় প্রকাশ পাবে ।”(আল মালাহিম ওয়াল ফিতান, পৃ. ১৭)

আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে :

“যখন ফিলিস্তিনের ফিতনার আবির্ভাব হবে তখন মশকের পানি যেভাবে আন্দোলিত হয় শামের অবস্থা ঠিক তেমন হবে । আর এ ফিতনা বিদূরিত হওয়ার সময় যখন নিকটবর্তী হবে তখন তা শেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় লোকই অনুতপ্ত হবে ।”(ইবনে হাম্মাদ, পৃ. ৬৩।)

আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে :

“ঐ ফিতনা শামকে ঘিরে ফেলবে, ইরাককে ঢেকে ফেলবে এবং জাযীরাকে (ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তবর্তী একটি স্থান) লণ্ডভণ্ড করে দেবে ।”(ইবনে হাম্মাদ, পৃ. ৯)

অপর একটি রেওয়ায়েতে আছে :

“ঐ সময় এমন এক ফিতনার উদ্ভব হবে যার অবসানের কথা চিন্তাও করা যায় না । কারণ, তা এমনভাবে চলতে থাকবে যে, এমন কোন গৃহ থাকবে না যেখানে ঐ ফিতনা প্রবেশ করবে না এবং এমন কোন মুসলমানও থাকবে না যে ঐ ফিতনা কর্তৃক চপেটাঘাতপ্রাপ্ত হবে না । আমার বংশ থেকে এক ব্যক্তির (মাহ্দী) আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত এ ফিতনা চলতে থাকবে ।”(ইবনে হাম্মাদ, পৃ. ১০)

এ সব রেওয়ায়েত ও আরো অনেক রেওয়ায়েতে এ ফিতনার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে । উপরিউক্ত রেওয়ায়েতসমূহ এবং অন্য সকল রেওয়ায়েতের ভাষ্য অনুযায়ী এ চতুর্থ ফিতনাটি হবে সর্বশেষ ফিতনা ।

উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ :

১. ফিতনা সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ শিয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে ইজমালী তাওয়াতুরের (অর্থগতভাবে মুতাওয়াতির) পর্যায়ে বিদ্যমান । অর্থাৎ যদিও এ সব রেওয়ায়েতে শব্দগত পার্থক্য বিদ্যমান কিন্তু বিভিন্ন রাবী বর্ণিত এ সব রেওয়ায়েতে একটি সাধারণ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে । যে কেউ এগুলোর প্রতি একটু দৃষ্টি দিলেই নিশ্চিত হতে পারবে যে, এ সব রেওয়ায়েতের অন্তর্নিহিত অর্থ মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত থেকে উৎসারিত হয়েছে ।

২. এ ফিতনা হবে ব্যাপক এবং তা মুসলমানদের নিরাপত্তা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিসহ সার্বিক অবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করবে । যেমন : সকল হারাম (অবৈধ) বিষয়কে হালাল (বৈধ) গণ্য করা হবে । আরেকটি রেওয়ায়েতে এ ফিতনাকে বধির ও অন্ধ বলা হয়েছে যা কোন কথাই শুনবে না এবং কোন কিছুই দেখবে না । তাই আলোচনার মাধ্যমেও এর পরিসমাপ্তি ঘটানো যাবে না । এ ফিতনা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন পার্থক্য করবে না; বরং তা সবকিছুকেই গ্রাস করবে । এ ফিতনা সকল পরিবারে প্রবেশ করবে এবং সকল মুসলমানের ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত হেনে তাদের ক্ষতিসাধন করবে । আর মুসলিম সমাজ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে উত্তাল তরঙ্গমালার ওপর দোদুল্যমান জাহাজ যেমন প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকি খায় ও তীব্রভাবে নড়াচড়া করতে থাকে ঠিক তেমনি তীব্র গোলযোগ ও সংকটের মুখোমুখি হবে ।

এ ফিতনার বিপক্ষে কেউ তার ধর্ম ও পরিবার রক্ষা করার জন্য অত্যাচারী শাসকবর্গ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে তাদের চরদের অন্যায়-অত্যাচার থেকে কোন নিরাপদ আশ্রয়স্থলই খুঁজে পাবে না । আর তারা মুসলিম উম্মাহর যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে । যেমন রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে :

“তখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকে একদল লোক (ঔপনিবেশিক) এসে আমার উম্মতের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে শাসন করবে ।”

৩. অমঙ্গল ও গোলযোগের সূত্রপাত শাম থেকেই হবে । হাদীসে এসেছে تطير بالشّام অর্থাৎ তা শাম থেকে শুরু হবে । এ কারণেই আমাদের শত্রুরা ঐ দেশটিকে ‘সভ্যতার সূর্যের দেশ’ হিসাবে অভিহিত করে থাকে । বর্তমানে বৃহত্তর শামে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি যদি এর সাথে যোগ করি তাহলে এর অর্থ কী দাঁড়ায় ? আরেকটি রেওয়ায়েতে تطيف بالشّام বাক্যটি এসেছে যার অর্থ হচ্ছে ফিতনা ও গোলযোগ সমগ্র শামকে ঘিরে ফেলবে । আর তখন সেখান থেকে অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশে তা সম্প্রসারিত হবে । আবার ‘ফিলিস্তিনের ফিতনা’ নামক একটি রেওয়ায়েত যদি এর সাথে যোগ করি তাহলে বোঝা যায় এর সমস্যা ও সংকটসমূহ শামের অধিবাসীদের ওপর অন্য সকলের চেয়ে বেশি কেন্দ্রীভূত হবে ।

৪. সমাধানের পথ ও পদ্ধতিসমূহ কার্যকর হবে না এবং এ গোলযোগ দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকবে । কারণ সভ্যতার এ ফিতনা সংস্কার ও সংশোধনের মাধ্যমে পরিত্রাণের উপায় অন্বেষণ অপেক্ষা গভীরতর । অন্যদিকে উম্মতের প্রতিরোধ-ক্ষমতা এবং শত্রুদের শত্রুতা সমস্যা সমাধানের যাবতীয় উপায় অকার্যকর করে দেবে । যেমন : রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে :

“একদিক থেকে এ ফিতনা অবসানের উদ্যোগ নিতে না নিতেই আরেক দিক থেকে তা প্রকাশ পাবে ।”

কারণ এ ফিতনার অবসানের পথ কেবল উম্মতের মাঝে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের দ্বারা এবং এরপর তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে ।

ঠিক একইভাবে বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঐ ফিতনা হবে সর্বশেষ ফিতনা এবং তা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে । কতিপয় রেওয়ায়েতে যদিও শর্তহীনভাবে তা বর্ণিত হয়েছে এবং স্পষ্টভাবে ঐ ফিতনাকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ‘আবির্ভাব-পূর্ব ফিতনা’ বলে উল্লেখ করা হয়নি তবুও একে ‘সর্বশেষ ফিতনা’ বলেছে এবং অনুরূপ বৈশিষ্ট্যসহ উল্লেখ করেছে । আর যেহেতু হাদীসগুলোর সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে ঐ ফিতনা সেহেতু বাধ্য হয়েই শর্তহীন রেওয়ায়েতটি (روايت مطلق) শর্তযুক্ত রেওয়ায়েতের (روايت مقيّد) ওপর আরোপ (حمل) করতে হবে ।

তবে এ ফিতনার কতিপয় আসল বৈশিষ্ট্য এবং অন্য যে সব বৈশিষ্ট্য অন্যান্য হাদীসে এসেছে তা আমরা পরবর্তীতে বর্ণনা করব । উল্লেখ্য যে, ঐ বৈশিষ্ট্যগুলোর কিছু বিশেষত্ব রয়েছে । কারণ, শুরু থেকে এ পর্যন্ত কেবল পাশ্চাত্য ফিতনা ব্যতীত মুসলিম উম্মাহ্ যে সব অভ্যন্তরীণ ও বহিঃফিতনার শিকার হয়েছে সেগুলোর কোনটির সাথে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলো খাপ খায় না । তা ছাড়া এ ফিতনা ও গোলযোগ ইসলামের প্রথম যুগের অভ্যন্তরীণ এবং তৎপরবর্তী ফিতনাসমূহ, এমনকি মঙ্গোলদের ফিতনা ও ক্রুসেড যুদ্ধসমূহের সাথেও (যার ঐতিহাসিক পর্যায়গুলো ৯০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল) মোটেও খাপ খায় না । বরং অনেক দিক থেকেই এগুলো পরস্পর থেকে ভিন্ন ।

তবে ঐ (ক্রুসেড) যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায়ে পাশ্চাত্য মুসলিম উম্মাহর ওপর সম্মিলিত আক্রমণ চালায় । তাদের সৈন্যবাহিনী সকল মুসলিম দেশে প্রবেশ করে এবং তাদেরকে পর্যদুস্ত করার মাধ্যমে ইসলামী ভূখণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে তাদের ইহুদী মিত্রদের ঘাঁটি স্থাপনে সক্ষম হয় । এটি ঐ (আবির্ভাবকালীন) ফিতনার বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখে ।

মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে :

“ঐ সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার উম্মতের ওপর এমন এক গোষ্ঠী কর্তৃত্ব চালাবে যে, তারা (উম্মত) যদি শ্বাস নেয় তাহলে তারা তাদেরকে হত্যা করবে; আর তারা যদি চুপ করে বসেও থাকে তবুও তাদের সবকিছুকে তারা (শাসকরা নিজেদের জন্য) বৈধ মনে করবে, তাদের সম্পদগুলোকে তাদের নিজেদের সম্পদ বলে মনে করবে এবং তাদের মান-সম্ভ্রম পদদলিত করে তাদের রক্তপাত করবে এবং তাদের অন্তরসমূহকে ঘৃণা, ভয়-ভীতি ও ত্রাসে ভরে দেবে । তোমরা তাদেরকে সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত দেখতে পাবে । তখন প্রাচ্য থেকে একদল এবং পাশ্চাত্য থেকে আরেক দল এসে আমার উম্মতের ওপর শাসন করবে । তাই অত্যাচারীদের হাতে নির্যাতিত আমার উম্মতের দুর্বল ব্যক্তিবর্গের জন্য আফসোস; আর অত্যাচারীদের ওপর আক্ষেপ এজন্য যে, তাদের ওপর মহান আল্লাহর ঐশী আযাব আপতিত হবে । কারণ তারা না ছোটদের ওপর দয়া করবে, না বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্মান রক্ষা করবে । তারা অন্যায় কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না । তাদের দেহ হবে মনুষ্যসদৃশ তবে তাদের অন্তর হবে শয়তানদের অন্তরসদৃশ ।(বিশারাতুল ইসলাম, পৃ. ২৫, রওযাতুল ওয়ায়েযীন থেকে উদ্ধৃত)

গুরুত্বপূর্ণ এ রেওয়ায়েতটি অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের ওপর থেকে পর্দা উন্মোচন করেছে । মুসলিম উম্মাহর ওপর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কাফিরদের আধিপত্যের কারণ হচ্ছে মুসলিম জাতিসমূহের ওপর দেশীয় শাসনকর্তাদের অন্যায়-অত্যাচার । তারা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মুসলিম জাতিসমূহের স্বাধীনতা হরণ করেছিল ।

কারণ, এ ধরনের অন্যায় আচরণ জনতাকে স্বৈরাচারী শাসকবর্গের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাদেরকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে অক্ষম করে ফেলে; আর এর ফলশ্রুতিতে শত্রুরা তাদেরকে ব্যবহার করে অত্যাচারী শাসকবর্গের কবল থেকে তাদেরকে মুক্ত করার বাহানায় ইসলামী দেশসমূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে । ঠিক এভাবেই নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করেছিলেন; যখন তাঁর যুদ্ধ জাহাজগুলো মিশরের উপকূলের নিকটবর্তী হয়েছিল তখন তিনি মিশরবাসীদেরকে পত্র প্রেরণ করেছিলেন এবং ইসলামের ব্যাপারে তাঁর ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন । আর মিশরে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যকে তিনি মিশরবাসীদেরকে দাসদের (মামালিক বংশের) অত্যাচার থেকে উদ্ধার বলে অভিহিত করেছিলেন ।

তিনি এ ছলচাতুরীপূর্ণ রাজনীতি মিশর দেশ জবরদখল করার পরেও অব্যাহত রেখেছিলেন, এমনকি তিনি মিশরীয় পোশাক পরে নিজেকে মুসলিম বলে জাহির এবং মহানবী (সা.)-এর জন্মদিবসও পালন করেছিলেন ।

এখন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও অনুরূপ পদ্ধতি ব্যবহার করে দাবি করেছে যে, তারা মুসলিম জাতিসমূহকে মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্যই তাদের দেশসমূহে প্রবেশ করেছে।

তারা সর্বদা মুসলিম দেশসমূহে তাদের কর্তৃত্ব স্থায়ীকরণ এবং মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখার জন্যই এ পন্থা ব্যবহার করেছিল ।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, পবিত্র এ হাদীসে যে সব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে সেগুলো সূক্ষ্মভাবে এমন সব শাসকবর্গের ওপর বর্তায় যারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে । তেমনিভাবে সেগুলো আজকের ঐ সব মুসলিম শাসকের ওপরও বর্তায় যারা এ ধরনের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ।

আর এ সব বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :

১. চিন্তাগত স্বাধীনতা দানের পরিবর্তে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি এবং প্রতিবাদ ও কথা বলার কারণে হত্যাযজ্ঞ চালানো ।

২. যদি মুসলিম জাতিসমূহ তাদের শাসকদের কাজের প্রতিবাদ না করে চুপচাপ বসে থাকে, তাহলে তারা তাদের যাবতীয় বিষয়কে নিজেদের জন্য মুবাহ (বৈধ) বলে মনে করে । কারণ এ সব শাসকের নীতি হচ্ছে এটাই যে, জনগণ যদি তাদের ব্যাপারে কিছু না বলে চুপচাপ থাকে তাহলেও তারা জনগণের ওপর অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকে না ।

৩. ইসলামী দেশসমূহের সম্পদ লুণ্ঠন এ সব সীমা লঙ্ঘনকারী অত্যাচারী শাসকের রাজনীতির মূলমন্ত্রস্বরূপ । আর তারা এটা এমনভাবে করছে যে, মুসলমানদের ধন-সম্পদ যেন তাদের পরিবারবর্গ ও তাদের শাসনের অংশীদার চাটুকার মুনাফিকদের উত্তরাধিকারীসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ।

৪. মুসলমানদের মান-মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা । যেমন : তাদের দৈহিক সত্তা, ব্যক্তিত্ব, সম্মান, স্বাধীনতা ও ধন-সম্পদের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ ও সীমা লঙ্ঘন ।

৫. যারা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং যারা বলে যে, ‘আমাদের প্রভু মহান আল্লাহ্’ অর্থাৎ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এ স্লোগানের বাস্তবায়ন চায় তাদেরকে হত্যা ।

৬. মুসলমানদের অন্তরসমূহকে ঘৃণা ও ভীতিতে ভরে দেয়া অর্থাৎ এই জুলুম ও অত্যাচারের কারণেই তাদের অন্তরে অত্যাচারী শাসকবর্গের প্রতি অথবা মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি এমন শত্রুতা ও বিদ্বেষ লালিত হয় ।

কিন্তু মহানবী (সা.) যে সব প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসী সম্পর্কে বলেছেন, ‘তখন প্রাচ্য থেকে একটি গোষ্ঠী এবং পাশ্চাত্য থেকে আরেকটি গোষ্ঠী এসে আমার উম্মতের ওপর শাসনকর্তৃত্ব চালাবে’- এ বিষয়টি রুশ ও পাশ্চাত্য জাতিসমূহ ব্যতীত আর কারো সাথে খাপ খায় না । রুশ ও পাশ্চাত্যের জাতিসমূহ মুসলিম দেশসমূহের অত্যাচারী শাসকবর্গের অত্যাচারের সুযোগ নিয়ে সে সব দেশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের সকল বিষয় নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়েছে বা নিচ্ছে (যেমন : অতি সাম্প্রতিককালে আফগানিস্তান ও ইরাকে একই পদ্ধতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য কায়েম করেছে) ।

কখনো কখনো বলা হয় যে, প্রাচ্য থেকে একদল ও পশ্চিম থেকে একদল আসবে তা সম্ভবত আব্বাসীয়দের আন্দোলন যারা ইসলামী রাষ্ট্রের পূর্ব দিক থেকে এবং ফাতেমীয়দের আন্দোলন যারা ইসলামী রাষ্ট্রের পশ্চিম দিক থেকে আগমন করেছিল এবং এটি ছিল উমাইয়্যা শাসকবর্গের অন্যায়-অত্যাচারের পরপরই ।

অথবা বলা হয় যে, একদল প্রাচ্যবাসী এবং একদল পাশ্চাত্যবাসী বলতে মঙ্গোলদের আক্রমণও হতে পারে যা পূর্ব দিক থেকে সংঘটিত হয়েছিল অথবা ক্রুসেড যুদ্ধসমূহ যা আব্বাসীয়দের অন্যায়-অত্যাচারের ফলশ্রুতিতে পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয়েছিল ।

তবে রেওয়ায়েতটির বাহ্য অর্থ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা হবে অমুসলিম যারা মুসলমানদের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে । এ কারণেই রেওয়ায়েতটি আব্বাসীয় ও ফাতেমীয়দের ওপর প্রযোজ্য হয় না । কারণ মুসলমানদের ওপর পাশ্চাত্যবাসী ক্রুসেডারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এ সব আক্রমণের দ্বারা হয় নি; বরং তারা শামে উপকূলীয় এলাকাসমূহে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সরকার ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং তারা সেখানেই বসবাস করেছিল । মঙ্গোলিয়রা খুব অল্প সময়ের জন্য মুসলমানদের ওপর রাজত্ব করেছে । পরবর্তীতে ইসলামী দেশসমূহে অবস্থানকারী তাদের অবশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মিশে যায় ।

এর চাইতেও আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই যে, মুসলিম বিশ্বের ওপর মঙ্গোলিয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং ঐতিহাসিক ক্রুসেড যুদ্ধগুলোর পরপরই ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হন নি । অথচ হাদীসে উল্লিখিত পাশ্চাত্যবাসীদের বিজয় ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং তাদের ফিতনা ও গোলযোগসমূহ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটবে বলা হয়েছে ।

অতএব, বলা যায় হাদীসে উল্লিখিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দু’টি দলের বিষয়টি বর্তমান কালের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জাতিগুলোর ওপরই কেবল প্রযোজ্য- যারা হচ্ছে রুশ, ইউরোপীয় এবং মার্কিনীরা । বিশেষ করে আমরা যদি হাদীসটির শেষে তাদের ব্যক্তিত্ব ও গৃহীত নীতি সংক্রান্ত যে সব বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দিই তাহলে পুরো ব্যাপারটি আমাদের জন্য পরিষ্কার হয়ে যাবে ।

যা হোক তারা যেমন মঙ্গোলদের প্রাচ্যদেশীয় উত্তরসূরি ঠিক তেমনি পাশ্চাত্যের ক্রুসেডারদেরও উত্তরসুরী । কারণ অধিকতর পছন্দনীয় অভিমত অনুসারে রেওয়ায়েতসমূহে রুশদের ‘তুর্ক’ এবং পাশ্চাত্যের জাতিগুলোকে ‘রোমান’ বলে অভিহিত করা হয়েছে- যাদের সাথে শীঘ্রই আমরা পরিচিত হব ।

মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে :

“তোমাদের অবস্থা এমনই চলতে থাকবে ঐ সময় পর্যন্ত যখন এমন সব সন্তান ভূমিষ্ট হবে যারা গোলযোগ ও ফিতনা ব্যতীত আর অন্য কিছুর সাথে পরিচিত হবে না । পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে এতটা ভরে যাবে যে, কোন ব্যক্তিই তখন মহান আল্লাহকে ডাকার সাহস করবে না । ঠিক তখনই আমার বংশধরদের মধ্য থেকে মহান আল্লাহ্ এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যে পৃথিবীকে ন্যায় ও সাম্য দিয়ে ভরে দেবে যেমনভাবে তা অন্যায় ও অত্যাচার দিয়ে ভরে গিয়েছিল ।”(বিহারুল আনওয়ার, ৫১তম খণ্ড, পৃ. ৬৮)

এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সর্বশেষ ফিতনা ও গোলযোগ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে । অবস্থা এমনই দাঁড়াবে যে, মুসলমানদের মধ্যে এমন এক প্রজন্মের উদ্ভব হবে যারা বিচ্যুত চিন্তা ব্যতীত আর কোন চিন্তা এবং অন্যায়-অত্যাচারের রাজনীতি ব্যতীত আর কোন রাজনীতির সাথে পরিচিত থাকবে না । আর এটি হচ্ছে আমাদের মুসলিম দেশসমূহে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার এবং পাশ্চাত্যের আধিপত্য বিস্তারকারী সরকার ও রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতির একটি সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা । বর্তমানে মুসলিম শিশুরা এই কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অশুভ ছায়াতলে প্রতিপালিত হচ্ছে এবং তারা ইসলামী পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে মোটেও পরিচিত নয় । তবে ঐ সব ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম মহান আল্লাহ্ যাদের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন ।

‘পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে এতটা পূর্ণ হয়ে যাবে যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারবে না’- মহানবী (সা.)-এর এ উক্তিটির অর্থ এটিই যে, জালিমদের কার্যক্রম মানব জীবনের সকল দিককে শামিল করবে । আর এ হচ্ছে এমন এক পরিবেশ যা পাশ্চাত্যের আক্রমণ ও আধিপত্য স্থাপনের পর সৃষ্টি হবে । কারণ তাদের আধিপত্য বিস্তারের পূর্বে কোন কোন সময় কিছু কিছু এলাকায় মুসলমানদের জীবনে অন্যায় ও অত্যাচার বিদ্যমান ছিল না । কিন্তু পাশ্চাত্যের আগ্রাসন, তাদের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার বিস্তৃতি এবং নব্য অত্যাচারী শাসকবর্গের আধিপত্য বিস্তারের পরই ধীরে ধীরে তাদের অন্যায়মূলক রাজনীতি সকল মুসলিম দেশ ও সেগুলোর কেন্দ্রীয় এলাকাসমূহে বিস্তৃতি লাভ করবে । আর তা এমনভাবে ঘটবে যে, মুসলমানদের কণ্ঠস্বর তাদের বক্ষেই চাপা পড়ে যাবে । এর ফলে কোন ব্যক্তি তখন নিজেকে মুসলমান বলে জাহির করতে ও বলতে পারবে না যে, ‘আমাদের প্রভু মহান আল্লাহ্’ অথবা ‘আমরা ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা করতে চাই, মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে অন্যায়-অত্যাচার বর্জন করে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন’ অথবা ‘এই শাসনকর্তার ব্যাপারে মহান আল্লাহর বিধান হচ্ছে যে, তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে অথবা শাসনকর্তৃত্ব থেকে অপসারিত করতে হবে’ অথবা ‘এ ধরনের আইন-কানুন সম্পর্কে মহান আল্লাহর বিধান হচ্ছে এর বিরুদ্ধে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে এবং এর পরিবর্তন সাধন করতে হবে’ ।

এর অর্থ এ নয় যে, কোন ব্যক্তিই সার্বিকভাবে মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারবে না । তবে হয়তো কেউ কেউ এ ধরনের চিন্তা করে থাকতেও পারে । কারণ যে বিষয় কাফির, জালিম ও স্বৈরাচারী, এমনকি ধর্মহীনদেরকে ক্রুদ্ধ করে তা হচ্ছে মহান আল্লাহর নাম ও তাঁর স্মরণ, বিশেষ করে যখন কুফর, জুলুম এবং জালিমদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হয় ।

আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে : “কোন ব্যক্তিই ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই’

 (لا إله إلّا الله) বলতে পারবে না ।”

খুব স্পষ্ট যে, এ বাণীটির অর্থ হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তিই মহান আল্লাহর একত্ব ও কর্তৃত্বের ঘোষণা দিতে এবং সেই কাফির ও অত্যাচারীদের কর্তৃত্বকেও প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না যারা মহান আল্লাহর আইন-কানুন মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনা করে না ।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত :

“তোমাদের নবীর আহলে বাইতের প্রশাসনের কতগুলো নিদর্শন আছে যা আখেরী যামানায় প্রকাশিত হবে... । ঐ সব নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ঐ যুগটাও যখন রোমান ও তুর্করা অন্যদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে ও বিদ্রোহ করাবে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীসমূহ মোতায়েন করবে ।... আর তুর্কীরা রোমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাবে ।”(বিহার, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ২০৮)

স্পষ্ট যে, রোমান ও তুর্কীদের ফিতনা ও গোলযোগ এবং ইসলামী দেশসমূহের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ ও তৎপরতা সংক্রান্ত হযরত আলীর বাণী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের নিদর্শনাদির অন্তর্ভুক্ত ।

রেওয়ায়েতটিতে ব্যবহৃত إستأثرت শব্দটি সূক্ষ্ম অর্থ বহন করে । অর্থাৎ তারা ইসলামী দেশসমূহের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং শোষণ করার জন্য এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যা তাদের প্রকৃত চরিত্রের পরিচয় বাহক । আর ঠিক এভাবেই ‘তুর্কী ও রোমানরা পরস্পর মতরিরোধ করবে’ (يتخالف الترك و الروم)- এ বাক্যাংশ থেকে বোঝা যায় যে, তুর্কী ও রোমানরা পরস্পর মিত্র হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রভাবাধীন এলাকাসমূহের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও সেগুলো ভাগাভাগি করার বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত হবে ।

কিন্তু ঐ অবস্থায়ই মুসলিম উম্মাহর সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য তারা পরস্পর একতাবদ্ধ হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিদ্রোহ করানো এবং সেনাশক্তি প্রস্তুত করার ব্যাপারে পরস্পর সহযোগিতা করবে । আর প্রকৃত চিত্রও হচ্ছে ঠিক এমনই ।

পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত বৃদ্ধি পাবে । কোন মহাদেশই যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে মুক্ত থাকবে না । আর কোন একটি যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই আরেকটি যুদ্ধের উদ্ভব হবে । এ সব কিছু রোমান ও তুর্কীদের প্রতিশোধ মনোবৃত্তি এবং নিজেদের অন্তর্বিরোধের কারণেই সৃষ্টি হবে । আর তাদের ইহুদী পৃষ্ঠপোষকরা সুযোগ পেলেই যে কোন সময় এবং যে কোন স্থানে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে ।

হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত আছে : “হে লোকসকল! আমাকে হারানোর আগেই তোমরা যা কিছু জানতে চাও তা আমার কাছ থেকে জেনে নাও । কারণ আমার বক্ষে অনেক জ্ঞান আছে । ঐ উষ্ট্র যাকে বশীভূত করার ফলে খুরের নিচে লাগাম আটকে যায়, ফলে তার ভীতি ও অস্থিরতা চরমভাবে বৃদ্ধি পায় সেরূপ ফিতনা তোমাদের দেশ ও জনপদ ধ্বংস করা এবং তোমাদের দেশ ও ভূখণ্ডের ওপর এর অশুভ ছায়া বিস্তার করার আগেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও । অথবা পাশ্চাত্য হতে যে আগুনটি শুষ্ক ও প্রচুর জ্বালানি কাঠের ওপর পতিত হবে তার সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখা গর্জে ওঠার আগেই (তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে যা জানা প্রয়োজন তা জেনে নাও) । ঐ প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষী ও রক্তের বদলা গ্রহণকারীদের জন্য দুর্ভোগ!

যখন কালের চাকার আবর্তন দীর্ঘ হবে (ইমাম মাহ্দীর আগমন বিড়ম্বিত হবে), তখন তোমরা বলবে যে, সে মারা গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে (আর যদি জীবিতও থাকে) তাহলে সে যে কোথায় চলে গেছে । আর ঠিক তখনই নিম্নোক্ত আয়াতটি বাস্তব রূপ লাভ করবে । আয়াতটি হলো :

ثمّ رددنا لكم الكرة عليهم و امددنا كم بأموال و بنين و جعلناكم أكثر نفيرا

“অতঃপর আমরা তাদের ওপর বিজয়কে তোমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করব এবং তাদের চেয়ে তোমাদের সংখ্যাকে অধিক করে দেব ।”

আর এরও বেশ কিছু নিদর্শন আছে ।(বিহার, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ২৭২-২৭৩) হযরত আলী (আ.) পাশ্চাত্যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হওয়ার বিষয়টি ‘শুষ্ক প্রচুর জ্বালানি কাঠে আগুন পতিত হবে’- এ উক্তির দ্বারা ব্যক্ত করেছেন । এ যুদ্ধের কারণ হচ্ছে ঐ ফিতনা যা পূর্বাঞ্চলে প্রকাশ পাবে অথবা যা রোমানদের বিরুদ্ধে প্রাচ্যদেশীয় তুর্কী অর্থাৎ রুশদের দ্বারা সৃষ্ট যুদ্ধের কারণেও হতে পারে ।

আমরা শীঘ্রই হাদীসসমূহের ভাষ্য অনুযায়ী এবং আমাদের অভিমত অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে যে বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে তার বর্ণনা সেই বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের অধ্যায়ে দান করব ।

মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকেও বর্ণিত হয়েছে : “আখেরী যামানায় আমার উম্মতের ওপর তাদের শাসকের পক্ষ থেকে এমন এক কঠিন বিপদ আপতিত হবে যার চেয়ে কঠিন কোন বিপদের কথা এর আগে কখনই শোনা যায় নি ।”

ঐ বিপদ এমনই হবে যে, তাদের জন্য বিস্তৃত এ পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং পৃথিবী শোষণ ও উৎপীড়ন দ্বারা এতটা পূর্ণ হয়ে যাবে যে, অন্যায় থেকে বাঁচার জন্য কোন মুমিনই নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে পাবে না । আর এটি মহান আল্লাহ্ কর্তৃক আমার বংশ থেকে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করা পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে । সে পৃথিবীকে ন্যায়বিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবে ঠিক সেভাবে যেভাবে তা অন্যায় ও অত্যাচার দিয়ে ভরে যাবে । আসমান ও যমীনের অধিবাসীরা তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে এবং যমীন তার প্রোথিত সম্পদরাজি বের করে দেবে; ঐ সময় আসমান রহমতের বৃষ্টিবর্ষণ করা থেকে বিরত থাকবে না ।”(সুলামীর ইকদুদ দুরার থেকে বিশারাতুল ইসলাম, পৃ. ২৮)

হুযাইফা বিন ইয়ামান মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন : “আমার ঐ উম্মতের জন্য আফসোস যারা অত্যাচারী শাসকদের হাতে নিহত হবে এবং ঐ অত্যাচারী শাসকরা তাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি ও মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করবে । তবে যারা তাদের আনুগত্য করবে কেবল তারা ব্যতীত । ঐ সময় পরহেজগার মুমিনগণ মুখে মুখে তাদের সাথে আছে বলে জাহির করবে অথচ অন্তরে তারা তাদের থেকে পৃথক থাকবে । আর যখন মহান আল্লাহ্ চাইবেন ইসলামের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে তখন তিনি প্রত্যেক যুদ্ধবাজ অত্যাচারীর পৃষ্ঠদেশ চূর্ণ করে দেবেন । তিনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান । তিনি ধ্বংসের পর মুসলিম উম্মাহর অবস্থা পুনরায় বিন্যস্ত এবং সংশোধন করে দেবেন । হে হুযাইফাহ্! পৃথিবীর বয়স যদি এক দিনের বেশি নাও থাকে তবু মহান আল্লাহ্ ঐ দিবসকে এতটা দীর্ঘ করবেন যে, আমার আহলে বাইত থেকে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হয়ে সমগ্র বিশ্বকে শাসন করবে এবং ইসলামকে প্রকাশ্যে বিজয়ী করবে । আর মহান আল্লাহ্ তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না এবং তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান ।”(ইয়া নাবীউল মাওয়াদ্দাহ্ থেকে উদ্ধৃত, বিশারাতুল ইসলাম, পৃ. ২৯)

মহানবী (সা.) বলেছেন : “শীঘ্রই বিভিন্ন জাতি তোমাদের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহবান করবে, দস্তরখানের দিকে যেভাবে নিমন্ত্রণের আহবান করা হয় ঠিক সেভাবে । যদিও তোমরা সংখ্যার দিক থেকে অনেক হবে তবুও প্রবল স্রোতের সামনে খড়কুটার মতো হবে তোমাদের অবস্থা । মহান আল্লাহ্ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের ব্যাপারে তাদের ভয়-ভীতি দূর করে দেবেন এবং দুনিয়ার প্রতি তোমাদের আগ্রহ এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করার কারণে তোমাদের অন্তরকে তিনি দুর্বল করে দেবেন ।”(আল মালাহিম ওয়াল ফিতান, পৃ. ১২১)

এ সব রেওয়ায়েত অত্যন্ত স্পষ্ট যেগুলোর ওপর নবুওয়াতের নূর বিচ্ছুরিত হয়েছে । এ হাদীসগুলো অত্যাচারী শাসকবর্গ ও আধিপত্য বিস্তারকারী শত্রুদের সাথে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক এবং তৎকালীন অবস্থা ব্যক্ত করে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ প্রদান করেছে ।

মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে :

“আরবদের জন্য আফসোস ঐ অমঙ্গলের কারণে যা তাদের নিকটবর্তী । সেই ডানাগুলোই বা কি? ঐ বাতাস যার প্রবাহ ধ্বংস সাধনকারী; ঐ বাতাস যার প্রবাহ সবকিছু উচ্ছেদকারী এবং ঐ বাতাস যার প্রবাহ শৈথিল্য আরোপকারী সেটা কি? তাদের জন্য আক্ষেপ এজন্য যে, তাদের ওপর তাৎক্ষণিক মৃত্যু, কষ্টকর ক্ষুধা এবং বিপদাপদ আপতিত হবে ।”(ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, পৃ. ৫৩)

ডানাগুলোর অর্থ বোমারু বিমান হতে পারে যা দ্রুত ও মৃদুমন্দ বাতাসের মতো আসে এবং অগণিত হত্যাকাণ্ড ঘটায় অথবা এমন বাতাস যা শক্তিশালী ও দুর্বল বোমাসমূহের উপর্যুপরি বিস্ফোরণে সৃষ্ট হয় । এ ডানাগুলো ঐ সব ডানাও হতে পারে যেগুলোর বর্ণনা পবিত্র কুদ্স মুক্ত করার জন্য সুফিয়ানী এবং ইহুদী ও রোমানদের সমর্থক আরবদের বিরুদ্ধে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুদ্ধ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে । কারণ ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে বর্ণিত হয়েছে :

“তখন মহান আল্লাহ্ বাতাস ও পাখিসমূহকে রোমানদের ওপর কর্তৃত্বশীল করে দেবেন যারা নিজেদের ডানা দিয়ে তাদের মুখমণ্ডলে এমনভাবে আঘাত হানতে থাকবে যে, এর ফলে তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যাবে এবং মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে এবং তাদেরকে গ্রাস করবে ।”(ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, পৃ. ১২৪)

আবার সেগুলো আবাবীলের মতো সত্যিকার পাখির ডানাও হতে পারে অথবা উড়োজাহাজের মতো যুদ্ধাস্ত্রও হতে পারে যা ইমাম মাহ্দী (আ.) ব্যবহার করবেন ।

আর এতৎসংক্রান্ত আলোচনা আমরা আল কুদ্স মুক্ত করার বৃহৎ যুদ্ধ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আন্দোলন সংক্রান্ত অধ্যায়ে অবতারণা করব ।

মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে : “মুশরিকগণ মুসলমানদেরকে নিজেদের কাজে নিয়োজিত করবে- তাদেরকে বিভিন্ন শহরে কেনা-বেচা করবে এবং ভাল-মন্দ কোন ব্যক্তিই এ কাজ করতে ভয় পাবে না । এই বিপদ সে সময়ের জনগণকে এতটা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে যে, তারা সবাই নিরাশ হয়ে যাবে এবং ভাবতে থাকবে তাদের মুক্তির আর কোন উপায়ই নেই । ঠিক তখন মহান আল্লাহ্ আমার পবিত্র বংশধরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে আবির্ভূত করবেন যে হবে ন্যায়পরায়ণ, পুণ্যময় এবং পবিত্র । সে ইসলামের কোন বিধানই উপেক্ষা করবে না । মহান আল্লাহ্ তার মাধ্যমে ধর্ম, কোরআন, ইসলাম ও মুসলমানদেরকে মান-সম্মান প্রদান করবেন এবং মুশরিকদেরকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করবেন । সে সবসময় মহান আল্লাহকে ভয় করবে এবং মহান আল্লাহর বিধি-বিধান প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নিজ আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা প্রতারিত হবে না । সে (তার নিজের জন্য) পাথরের ওপর পাথর সাজাবে না এবং ইমারতও নির্মাণ করবে না । একমাত্র শারয়ী দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্য ব্যতীত সে কোন ব্যক্তিকে চাবুক মারবে না । তার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ সকল বিদআতের মূলোৎপাটন করাবেন এবং সকল ফিতনার অবসান ঘটাবেন । তার মাধ্যমে প্রতিটি সত্য ও ন্যায়সংগত অধিকারের দরজা উন্মুক্ত হবে এবং বাতিলের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে । আর যেখানেই মুসলমানরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা থাকুক না কেন আল্লাহ্ তার মাধ্যমে তাদেরকে মুক্ত করে তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করাবেন ।”(আল মালাহিম ওয়াল ফিতান, পৃ. ১০৮)

এ রেওয়ায়েতটি মুসলমানদের দুর্বল করার প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য দেশে তাদের (দাসদের মতো) বেচাকেনা ও বন্দিত্বের বেদনাময় অবস্থা চিত্রিত করেছে । আর এ অবস্থা কেবল আমাদের যুগ এবং যে সব মুসলমান লাঞ্ছনা সহকারে মুশরিকদের কর্মচারী ও সেবকে পরিণত হয়েছে বা হচ্ছে তাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট নয়; বরং মুসলিম জাতিসমূহকে নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন এবং মুশরিকগণ কর্তৃক তাদের বন্দীদশা সংক্রান্ত যে সব লেন-দেন সাধিত হচ্ছে সেগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে ।

অতঃপর এ রেওয়ায়েত স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঐ নিরাশার মধ্যেই হঠাৎ মানব জাতির মুক্তিদাতা প্রতিশ্রুত মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন যাঁর জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গীকৃত হোক!

টীকা :

১. مطلق (শর্তহীন) রেওয়ায়েতের অর্থ : আবির্ভাবের আগে ঘটার” শর্তটি যে রেওয়ায়েতে নেই সেটিই শর্তহীন রেওয়ায়েত; আর ঐ রেওয়ায়েতটি শর্তযুক্ত যার মাঝে ঐ শর্তটি বিদ্যমান। এ কারণেই মুতলাক (مطلق) রেওয়ায়েতকে মুকাইয়াদ (مقيد) রেওয়ায়েতের ওপর আরোপ করে অর্থাৎ উক্ত শর্তের অধীন হিসেবে আমরা এ ফিতনাকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ‘আবির্ভাব-পূর্ব ফিতনা’ বলে অভিহিত করতে পারব।

২. যেমন : সাদ্দাম, তালিবান শাসকবর্গ ও ওসামা বিন লাদেন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও আফ্রিকীয় মুসলিম দেশসমূহ ও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, সৌদী আরব, জর্ডান, মরক্কো, ব্রুনেই, ওমান, আরব-আমীরাত, কুয়েত-কাতারের শাসকবর্গ ও আমীরগণ ।

অনুবাদ : মোহাম্মাদ মুনীর হোসেইন খান

[লেবাননের বিশিষ্ট আলেম আল্লামা আলী আল কুরানী প্রণীত ‘আসরে যুহুর’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ ‘ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ’ থেকে সংকলিত।]

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)