আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৪১তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৬২-১৬৫

সূরা নিসার ১৬২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَكِنِ الرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ مِنْهُمْ وَالْمُؤْمِنُونَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَالْمُقِيمِينَ الصَّلَاةَ وَالْمُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالْمُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ أُولَئِكَ سَنُؤْتِيهِمْ أَجْرًا عَظِيمًا ((১৬২

"কিন্তু ইহুদিদের ও বিশ্বাসী বা মুমিনদের মধ্যে যারা জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত তারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তোমার আগে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তার ওপর বিশ্বাস রাখে। এ ছাড়াও তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও কেয়ামতের প্রতি বিশ্বাস রাখে। তাদের আমি মহাপুরস্কার দেব।" (৪:১৬২)

গত কয়েক পর্বের আলোচনায় আমরা ইহুদি জাতির কিছু অন্যায় কাজ ও পাপাচারের বর্ণনা দিয়েছি। তবে এ জাতির মধ্যে প্রকৃত মুমিনদের মত অনেক সৎ মানুষও ছিলেন। তারা ছিলেন আল্লাহর নির্দেশের কাছে নতজানু। এভাবে কোরআন অতীতের জাতিগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে পরিপূর্ণভাবে ইনসাফ বজায় রেখেছে। অর্থাৎ ইহুদি জাতির অসৎ লোকদের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের মধ্যে অনেক সৎ ব্যক্তি থাকার কথাও উল্লেখ করেছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে

ঈমান যাদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে তারা ইহুদি হোক বা মুসলমান হোক আল্লাহর তরফ থেকে নাজেল হওয়া বিষয়ের প্রতি আস্থা রাখেন। এ ধরনের মানুষ নামাজ পড়েন, বিত্তহীন বা বঞ্চিতদের যাকাত দেন ও অন্যান্য এবাদতও পালন করেন। আর মহান আল্লাহও তাদের পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ পুরস্কার দেবেন। এটা করুণাময় আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।

সূরা নিসার ১৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَوْحَيْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَعِيسَى وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهَارُونَ وَسُلَيْمَانَ وَآَتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا ((১৬৩

"হে রাসুল! আমরা তোমার কাছে ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ নাজেল করেছি, যেমনিভাবে নূহ ও তাঁর পরবর্তী নবী-রাসূলের কাছে ওহী নাজেল করেছি। যেমনিভাবে আমরা নাজেল করেছিলাম ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব, ও তাঁর সন্তানদের কাছে এবং নাজেল করেছিলাম ঈসা, আইয়ুব, হারুন, ইউনূস, ও সোলায়মানের কাছে। আর আমরা দাউদকে দিয়েছিলাম আসমানি কেতাব যাবুর।" (৪:১৬৩)

এ আয়াতে অতীতে যুগে যুগে নবী-রাসূল নিয়োগের কথা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলছেন, কেন ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ঐশী ধর্মগ্রন্থ পাওয়া সত্ত্বেও মুহাম্মাদ (সা.)'র ওপর কোরআন নাজেল হওয়ায় বিস্মিত হচ্ছে? তারা কি এটা জানে না যে, মহান আল্লাহ যুগে যুগে হযরত ঈসা ও মূসা (আ.)সহ বহু ব্যক্তিকে নবী-রাসূল হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ তাঁদেরকে ধর্মগ্রন্থও দিয়েছিলেন। তাই তারা কেন মুহাম্মাদ (সা.)'র ওপর নাজেল হওয়া প্রত্যাদেশ বা ওহী এবং তাঁর রেসালাতের প্রতি ঈমান আনছে না?

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি দিক হল:

এক. খোদায়ী সব ধর্মের লক্ষ্য ও সামগ্রীক কর্মসূচি অভিন্ন বা এক। কারণ, এসবেরই উৎস হলেন মহান আল্লাহ।

দুই. যুগে যুগে আসা নবী-রাসূলের মিশনের দিকে লক্ষ্য করলে ইসলামের নবী (সা.)'র রেসালত মেনে নেয়া সহজ হয়ে পড়বে।

সূরা নিসার ১৬৪ ও১৬৫ নম্বর আয়াতে

وَرُسُلًا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا (১৬৪) رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا ((১৬৫

"অতীতে পাঠানো অনেক নবীর ঘটনা আমি তোমার কাছে বলেছি ইতিপূর্বে এবং অনেক নবীর ঘটনা তোমার কাছে বলিনি। আর আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন বিশেষভাবে।" (৪:১৬৪)

"আমি সুসংবাদদাতা ও ভয়-প্রদর্শনকারী হিসেবে নবী-রাসূল পাঠিয়েছি যাতে আল্লাহর প্রতি জনগণের কোনো অভিযোগ না থাকে। আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশীল, প্রাজ্ঞ।" (৪:১৬৫)

আগের আয়াতে কোনো কোনো নবী-রাসূলের নাম উল্লেখের পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন- এমনটা মনে করো না যে, যাঁদের নাম বলা হল কেবল তাঁরাই নবী-রাসূল ছিলেন। বরং অনেক নবীর নাম কোরআনে উল্লেখই করা হয়নি। কয়েকজন নবী-রাসূলের জীবনের কিছু ঘটনা বিভিন্ন উপলক্ষে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর নবী-রাসূলদের মিশন বা দায়িত্বের কথা তুলে ধরে আল্লাহ বলছেন: মানুষকে সুংবাদ ও উপদেশ দেয়া বা সতর্ক করা নবী-রাসূলদের মূল দায়িত্ব। মানুষকে বিভিন্ন বিপদ বা বিচ্যুতি সম্পর্কে ভয় দেখানো এবং ভালো কাজের উৎসাহ দেয়া ও পুরস্কারের আশা জাগানো- এই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহর এ ব্যবস্থার ফলে কিয়ামতের দিন কেউ এ কথা বলার সুযোগ পাবে না যে, আমি সঠিক ও ভুল পথ চিনতে পারিনি বলে সে অনুযায়ী কাজ করতে পারিনি। অবশ্য আল্লাহ মানুষকে আকল বা বিবেকও দিয়েছেন ভাল-মন্দ বোঝার জন্য বা যাচাইয়ের জন্য। কিন্তু মানবীয় আকল বা বিবেক মূলতঃ কেবল পার্থিব বা দুনিয়াবি বিষয় উপলব্ধি করতে পারে। তাই আল্লাহ পরকালে কেবল তাদেরকেই শাস্তি দেবেন যারা নবী-রাসূলের দাওয়াত পাওয়ার পরও তাতে সাড়া দেয়নি।

এ আয়াত থেকে যা মনে রাখা দরকার তা হল:

এক. ইতিহাসের সব ঘটনা শোনার মত দীর্ঘ জীবন বা আয়ু মানুষের নেই। আর সব ঘটনা জানার প্রয়োজনও নেই। যারা শিক্ষা নেয় তাদের জন্য একটি ঘটনার শিক্ষাই যথেষ্ট। আর এ জন্যই কোরআন কেবল কয়েকজন নবী-রাসূলের যুগে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার কেবল কিছু শিক্ষনীয় দিকই তুলে ধরেছে, সব নবী-রাসূলের জীবন-বৃত্তান্ত বা ইতিহাস তুলে ধরেনি।

দুই. প্রশিক্ষণ দেয়া বা জোর করে শিখিয়ে দেয়া নবী-রাসূলদের দায়িত্ব নয়, সুসংবাদ ও সতর্ক করে দেয়ার মাধ্যমে মানুষকে বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়াই ছিল তাঁদের দায়িত্ব। আর এ বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট সত্য।

তিন. সব নবী-রাসূলই আল্লাহর ওহী ও বক্তব্য শুনেছেন, কিন্তু হযরত মূসা (আ.) ফেরাউনের মত প্রবল পরাক্রমশালী খোদাদ্রোহী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মত কঠিন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন বলে আল্লাহর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি ও সরাসরি। আর এ জন্যই হযরত মূসা (আ.)কে কালিমুল্লাহ বলা হয়।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)