আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন নিসা;(৪২তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৬৬-১৭০

সূরা নিসার ১৬৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَكِنِ اللَّهُ يَشْهَدُ بِمَا أَنْزَلَ إِلَيْكَ أَنْزَلَهُ بِعِلْمِهِ وَالْمَلَائِكَةُ يَشْهَدُونَ وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا ((১৬৬

"অধিকন্তু [হে মুহম্মদ] তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে [কোরআন] আল্লাহ্‌ তার সাক্ষী। তিনি তা অবতীর্ণ করেছেন নিজ জ্ঞানে এবং ফেরেশতাগণ সাক্ষী দেয়। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্‌-ই যথেষ্ট।" (৪:১৬৬)

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম যে আহলে কিতাব এবং কাফেররা তাদের গোঁড়ামির কারণে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করতে এবং ইসলামের নবীকে সত্য নবী হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তারি ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে নবীজীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে বলা হয়েছেঃ তোমার এই জনগোষ্ঠি যদি তোমার নবুয়্যতিকে অস্বীকার করে,কোনো সেমস্যা নেই,কেননা আল্লাহ কোরআন নাযিল করেছেন তাঁর অসীম জ্ঞানের সমুদ্রের ভিত্তিতে। আর এটাই সুস্পষ্ট একটি প্রমাণ যে, কোরআন কোনো মানুষের চিন্তাপ্রসূত রচনা নয়। আর এ বিষয়টাই তার ঐশী মাহাত্ম্যের সবোর্ত্তম প্রমাণ।

আসলেই,শিক্ষাদীক্ষাহীন একজন মানুষ যিনি মূর্খতা, শেরেকি আর বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারপূর্ণ একটি এলাকার জনগণকে এমন এক শিক্ষা ও জ্ঞান উপহার দিলেন,যা নিয়ে দেড় হাজার বছর পরে অর্থাৎ আজকের দিনের মানুষও সেই শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে গবেষণা করে কুল পাচ্ছে না। এটা এমন এক শিক্ষা যে শিক্ষার আলোকে মানুষ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তারা বিচ্ছিন্নতা থেকে ঐক্যের দিকে এসেছে, শেরেকি ছেড়ে তৌহিদে দীক্ষিত হয়েছে, মূর্খতা থেকে জ্ঞানের দিকে ফিরেছে, অপমান থেকে সম্মানের পর্যায়ে পৌছেঁছে এবং এভাবেই গঠন করেছে একটি ইসলামী সমাজ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ

১. ওহি এবং অসীম জ্ঞানের উৎস হলন আল্লাহ।তাই জ্ঞানের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে প্রতিদিনই আল্লাহ পরিচয় সম্পর্কে নতুন নতুন পাতার উন্মোচন ঘটে।

২. ধর্মীয় সকল বিষয় আশয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল একমাত্র আল্লাহ,কোনো মানুষ নয়।

সূরা নিসার ১৬৭, ১৬৮ এবং ১৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ قَدْ ضَلُّوا ضَلَالًا بَعِيدًا (১৬৭) إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَظَلَمُوا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ طَرِيقًا (১৬৮) إِلَّا طَرِيقَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا ((১৬৯

"যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং মানুষকে আল্লাহ্‌র রাস্তা থেকে ফিরিয়ে রাখে, তারা গোমরাহ হয়ে গেছে, সুপথ থেকে বহু-বহু দূরে তারা পথভ্রষ্ট।"(৪:১৬৭)

"যারা কাফের হয়েছে এবং পাপ কাজ করেছে, আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করবেন না এবং তাদের কোন হেদায়েতের পথও দেখাবেন না।"(৪:১৬৮)

"জাহান্নামের পথ ব্যতীত। সেখানে তারা চিরদিন বাস করবে এবং আল্লাহ্‌র জন্য এটা করা সহজ।"(৪:১৬৯)

আগের আয়াতে বেঈমান লোকদের সম্পর্কে এবং ইসলামের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ আয়াতে এমন একদল কাফেরের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা নিজেদের গোমরাহির পাশাপাশি অন্যদেরকেও গোমরাহ বানানোর কাজে লিপ্ত। এরা যুগ যুগ ধরে বহু মানুষকেও গোমরাহ বানিয়েছে। সেজন্যেই মনে করা হয় যে এরা তাদের বিচ্যুতির পথ ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসবে বলে আশা করা যায় না। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকেও ক্ষমা লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। অতএব জাহান্নামের আগুন থেকে তাদের মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই। অবশ্য কাফেররা আল্লাহর ভয়ভীতিকে সহজভাবে নেয়,গুরুত্বের সাথে নেয় না। অথচ পরিণতি তারা পরকালে যথার্থই প্রত্যক্ষ করবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

১. কুফরি নিজের প্রতি এবং অপরের প্রতি জুলুম করার উৎস। ব্যক্তি এবং সমাজের সাংস্কৃতিক এবং চিন্তাগত জুলুমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জুলুম আর কী হতে পারে।

২. সর্বপ্রকার জুলুম এবং অত্যাচার ঐশী হেদায়েত ও ক্ষমা লাভের অন্তরায় এবং জাহান্নামের পথ সুগমকারী।

এই সূরার ১৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الرَّسُولُ بِالْحَقِّ مِنْ رَبِّكُمْ فَآَمِنُوا خَيْرًا لَكُمْ وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ((১৭০

"হে মানব সম্প্রদায়! (বহুল প্রতীক্ষিত) রাসূল আল্লাহ্‌র নিকট থেকে সত্য সহকারে এসেছেন। সুতরাং তোমরা তাঁকে বিশ্বাস কর। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ। কিন্তু তোমরা যদি (অকৃতজ্ঞের মতো)ঈমানকে প্রত্যাখ্যান কর (তবে জেনে রাখো)আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্‌রই এবং আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাময়।" (৪:১৭০)

ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণ অনুযায়ী আহলে কিতাব বিশেষ করে ইহুদিরা তাদের কিতাবে দেয়া সুসংবাদ অনুযায়ী বিশ্বাস করতো যে আরব প্রজন্ম থেকে একজন নবী আসবেন। এ কারণে তাদের একটি দল মদিনায় হিজরত করেছিলেন। মুশরিকরাও এ সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তা শুনেছিলো তাই তারাও নবীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল। তাই পবিত্র কোরআন এ আয়াতে বলেছেঃ যে নবীর অপেক্ষায় ছিলে তিনি সত্য বাণী সহকারে তোমাদের মাঝে এসেছেন। জেনে রাখো! যদি তাঁর প্রতি ঈমান আনো এবং তাঁর কথা অনুযায়ী আমল করো,তাহলে সেটা হবে তোমাদেরই কল্যাণের কারণ। আর যদি কুফরি করো তাহলে ঐ রাসূল এবং তাঁর খোদার কোনো ক্ষতি নেই। কেননা আল্লাহ সকল আসমান-যমিনের মালিক। কারো ইবাদাত বন্দেগি বা নামাযের প্রয়োজনীয়তা তাঁর নেই।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখবোঃ

১. নবী রাসূলদের শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হলো তাদেঁর সততা ও সত্যনিষ্ঠা,যার কারণে তাঁদের দাওয়াত বিস্তৃতি লাভ করেছে।

২. মুমিনদের উচিত নয় ঈমান আনার কারণে এরকম ভাবা যে আল্লাহ আমাদের মুখাপেক্ষী বরং আমরাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী কেননা তিনি আমাদের হেদায়েত দান করেছেন।

৩. মানুষ কুফরি করলে আল্লাহর কিচ্ছু যায় আসে না।মানুষ ঈমান আনলেও আল্লাহর কোনো লাভ নেই। প্রকৃতপক্ষে মানুষের ঈমান আনার মধ্যে নিজেদেরই স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)