আল হাসানাইন (আ.)

রমযান ও প্রতিবেশীর অধিকার

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

রমযান পৃথিবীর বুকে ইসলামী হুকুমাতের চিত্র নিয়ে আসে। ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় প্রতিটি মুসলমানকেই কোনো কোনো বিষয়ে দায়িত্ববান হতে হয়। বিশেষ করে আপনার প্রতিবেশী যারা রয়েছেন তাদের ব্যাপারে আপনার কিন্তু বড়ো ধরনের দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়িত্ব পালন করা আজকাল সামাজিক রূপ নিলেও এর ধর্মীয় গুরুত্ব অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। প্রতিবেশীর অধিকার এবং তাঁদের ব্যাপারে আপনার আমার করণীয় সম্পর্কে আজকের আসরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো। কারণ এইসব দায়িত্ব পালন না করার কারণে রমযানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়ে পড়ে।

পবিত্র কোরআনের সূরা নিসায় বলা হয়েছে আর আল্লাহর ইবাদাত করো,তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না,পিতা-মাতার প্রতি সদয় আচরণ করো। নিকটাত্মীয়,এতিম-মিসকিন,নিকট সম্পর্কের প্রতিবেশী, দূরের প্রতিবেশী,পার্শ্ববর্তী সাথী,পথচারী এবং তোমাদের ডান হাত যাকে ধরে রেখেছে তাদের সাথেও সদয় আচরণ করো।কিন্তু প্রতিবেশীর সংজ্ঞা কী ? হাদিসে পাকে এসেছে চারপাশের চল্লিশটি ঘর প্রতিবেশী। সামনের ৪০ টি, পেছনের ৪০টি, ডানের ৪০টি এবং বামদিকের ৪০টি ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসেবে পরিগণিত। রাসূলে খোদার এই বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে,৪১তম বাসাটি প্রতিবেশিত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়,কেননা দূরের প্রতিবেশীর কথাও কোরআনে বলা হয়েছে। রাসূলে খোদার বক্তব্যের মানে হলো কোনো একটি এলাকায় সাধারনত যাদেরকে প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাদের সবাই প্রতিবেশী। যেমন কোনো একটি এলাকায় হয়তো নদী পড়েছে, কিংবা বড়ো একটা খাল পড়েছে। সেক্ষেত্রে খালের এপাড়ে যারা রয়েছেন তাদেরকে হয়তো স্থানীয় অধিবাসীরা নিজেদের প্রতিবেশী হিসেবে ধরেন। রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে তারা তো প্রতিবেশীই এমনকি যারা দূরে রয়েছে অর্থাৎ খালের ওপারে রয়েছে তারাও দূরের প্রতিবেশী হিসেবে পরিগণিত। এখানে যেমন সীমারেখা টানা হয় নি তেমনি মুসলমান-অমুসলমানের মাঝেও বিভেদ রেখা টানা হয় নি। কেননা আপনার প্রতিবেশী হতেই পারে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ফলে তাদের ব্যাপারেও আপনার দায়িত্ব রয়েছে। তাছাড়া এমন বহু শহর আছে যেখানে ৪০ টি ঘর চারদিকে গুণতে গেলে দেখবেন পুরো শহরটাই আপনার প্রতিবেশী। আল্লাহর রাসূল সামাজিক একটা সুসম্পর্কের লক্ষ্যেই আনুমানিক একটা বিস্তৃতির কথা বলেছেন,সেইসাথে আবার দূরের প্রতিবেশী বলে অন্য সবাইকেই শামিল করে মোটামুটি সকল মানুষের ব্যাপারেই আপনার একটা দায়িত্বশীল ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

প্রতিবেশির এই সংজ্ঞা দেওয়ার পর রাসূলে খোদা (দঃ) বলেছেন, যারাই আল্লাহ এবং কিয়ামতের দিনের ওপর ঈমান এনেছে,তাদের উচিত হলো তার প্রতিবেশীদের ব্যাপারে সদয় হওয়া। তিনি আরো বলেছেন,যারাই নিজেদের প্রতিবেশীদেরকে জ্বালাতন করবে, আল্লাহ তাদের জন্যে বেহেশতের সুগন্ধিকে হারাম করে দেবেন এবং এ ধরনের ব্যক্তিদের স্থান হবে জাহান্নামের মতো বাজে জায়গা। আর যারা প্রতিবেশীর অধিকার নষ্ট করবে তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। রাসূল (সা) আরো বলেছেন, জিব্রাঈল (আ) প্রতিবেশীদের ব্যাপারে আমাকে এতো বেশি বেশি তাকিদ করেছেন যে, মনে করেছিলাম প্রতিবেশীকেও হয়তো ওয়ারিশ হিসেবে পরিগণিত করতে হতে পারে।

একদিন রাসূলে খোদা (সা) তাঁর সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো প্রতিবেশীর অধিকার কী ? উপস্থিত সবাই নেতিবাচক জবাব দিলো। তখন রাসূল (সা) বললেন-প্রতিবেশীর সর্বনিম্ন অধিকার হলো, প্রতিবেশী যদি ঋণ চায়, তাকে ঋণ দিতে হবে। যদি সাহায্য চায় সাহায্য করতে হবে। যদি কোনো জিনিসপত্র ধার চায় ধার দিতে হবে। যদি তাকে দান করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে তাদেরকে দান করতে হবে। প্রতিবেশী যদি দাওয়াত দেয়, দাওয়াত গ্রহণ করতে হবে। প্রতিবেশী অসুস্থ হলে তার সেবায় এগিয়ে যেতে হবে। কেউ মারা গেলে তার জানাযায় হাজির হতে হবে। প্রতিবেশীর সুসংবাদে অভিনন্দন জানাতে হবে আবার কোনো বিপদের সম্মুখীন হলে তার সমব্যথী হতে হবে।

একই হাদিসের ধারাবাহিকতায় তিনি আরো বলেন, নিজের বাড়িটাকে বেশি উঁচু অর্থাৎ বহুতল বিশিষ্টও করা ঠিক নয়,কেননা তাতে প্রতিবেশী আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত হতে পারে কিংবা বহির্দৃশ্য অবলোকনের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। যদি ফল-পাকড়া কিনে বাসায় ফেরেন, তাহলে ঐ ফল-পাকড়া থেকে প্রতিবেশীদের দিতে হবে। তবে হ্যাঁ,যদি প্রতিবেশী জানতে না পারে যে আপনি ফল-ফলাদি কিনেছেন,তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে আপনার শিশু সন্তানটি যেন ঐ ফল হাতে নিয়ে বাইরে গিয়ে প্রতিবেশীর সন্তানকে না দেখিয়ে বেড়ায়। এমনটি হলে প্রতিবেশীর সন্তানটি তার অভিভাবককে ঐ ফল কিনে দিতে জ্বালাতন করবে। এভাবে প্রতিবেশীকে জ্বালাতন করার কোনো অধিকার কারো নেই। অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে-প্রতিবেশীকে শ্রদ্ধা-সম্মান করা মাকে সম্মান করার মতোই অবশ্য কর্তব্য।

ইসলাম কতো বেশি গুরুত্ব দিয়েছে প্রতিবেশীর ব্যাপারে তা নিশ্চয়ই খানিকটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। আমাদের রোযা কোনো কাজেই আসবে না যদি প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে সচেতন না হই। একটি হাদিসে আছে, রাসূলে খোদার কাছে এমন একজন মহিলার কথা বলা হলো,যে সবসময় রোযা রাখে কেবলমাত্র হারাম দিনগুলো ছাড়া এবং সারারাত জেগে নামায আর মুনাজাতে কাটায়,কিন্তু তার মুখের ভাষা দিয়ে প্রতিবেশীকে জ্বালাতন করে। রাসূল ( সা ) বললেন-তার এই রোযা,তার এই ইবাদাত কিংবা রাতজাগার কোনো মূল্য নেই,সে জাহান্নামের অধিবাসী।

অপর এক মহিলার বর্ণনা দেওয়া হলো, যিনি কেবল ফরয নামাযগুলো আর রমযান মাসের রোযাই রাখেন কিন্তু প্রতিবেশীকে জ্বালাতন করেন না। রাসূলে খোদা বললেন,হিয়া মিন আহলিল জান্নাহ অর্থাৎ তিনি বেহেশতের অধিবাসী। এই হাদিস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কেবল রোযা রাখলেই চলবে না,প্রতিবেশীর ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে হবে। একটি হাদিসে এসেছে,যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে ভরপেটে ঘুমালো,সে মুমিন নয়। ছোট্ট একটি হাদিস কিন্তু এর দাবি অনেক। আমার বাসার রান্নার ঘ্রাণে প্রতিবেশীদের ঘর পর্যন্ত মৌ মৌ করে,অথচ সেই প্রতিবেশী না খেয়ে ঘুমাচ্ছে,এটা ইসলামের দৃষ্টিতে অনৈতিক কাজ। আমরা তো আজকাল পাশের বাসায় কে আছে,তাদের কী হাল-অবস্থা,কী সমস্যা-ইত্যাদি কোনো খবরই রাখি না। এমতাবস্থায় আমাদের রোযা হাদিস অনুযায়ী কতোটা যথার্থ হবে-তা নিশ্চয়ই প্রশ্নসাপেক্ষ একটি বিষয়। অতএব পারস্পরিক খোজখবর নিয়ে,সহাবস্থান করে রমযানের রহমতের দ্বার উন্মুক্ত রাখবো-এই হোক আমাদের সক্রিয় প্রচেষ্টা।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)