আল হাসানাইন (আ.)

বিদায় হজ্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

ইসলামের সামষ্টিক ইবাদতসমূহের মধ্যে হজ্ব বৃহত্তম এবং সবচেয়ে মহতী ও আড়ম্বরপূর্ণ ইবাদত, যা (প্রতি বছর) মুসলমানরা পালন করে থাকেন। কারণ মহতী এ অনুষ্ঠান, যা বছরে একবার পালন করা হয়, আসলে মুসলিম উম্মাহর জন্য ঐক্যের সর্ববৃহৎ বহিঃপ্রকাশ, ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদার মোহ থেকে মুক্ত হবার পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন, মানব জাতির সাম্যের বাস্তব নমুনা এবং মুসলমানদের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক দৃঢ়ীকরণের মাধ্যম...। এখন আমরা মুসলমানরা যদি বিস্তৃত এ ইলাহী দস্তরখান অর্থাৎ হজ্ব অনুষ্ঠান থেকে স্বল্প লাভ গ্রহণ করি এবং বার্ষিক এই ইসলামী মহাসমাবেশ- যা আসলেই আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনার উৎস হতে পারে,- যদি পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা ছাড়া উদযাপিত হয়, তা হলে তা ইসলামী আইন ও শরীয়তের অপূর্ণাঙ্গতার নির্দেশক তো হবেই না, বরং তা মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের দোষ-ত্রুটি নির্দেশক বলেই গণ্য হবে, যারা এ ধরনের মহতী অনুষ্ঠানের সদ্ব্যবহার করতে অক্ষম।

যেদিন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্ (আ.) পবিত্র কাবার ভিত্তি পুনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে মহান আল্লাহর বান্দাদেরকে এ ঘর যিয়ারত করার আহবান জানিয়েছিলেন, সেদিন থেকে এ অঞ্চল সকল আস্তিক জাতির অন্তরসমূহের কাবা ও তাওয়াফের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে যায়। প্রতি বছর পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এ ঘর যিয়ারত করার জন্য ছুটে আসে এবং যে আচার-অনুষ্ঠান হযরত ইবরাহীম (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা সম্পন্ন করে।

কিন্তু কালক্রমে মহান নবীগণের নেতৃত্ব-ধারা থেকে হিজাযবাসী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কুরাইশদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং সমগ্র আরব বিশ্বের চিন্তাজগতের ওপর প্রতিমাগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে হজ্বের আচার-অনুষ্ঠানও স্থান-কালের দৃষ্টিকোণ থেকে বিকৃত হয়ে যায় এবং সত্যিকার খোদায়ী রূপ হারিয়ে ফেলে।

এ সব কারণেই মহানবী (সা.) হিজরতের দশম বর্ষে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হন যে, তিনি নিজে ঐ বছর হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মুসলিম উম্মাহকে ব্যবহারিকভাবে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে পরিচিত করাবেন এবং উপরিউক্ত কারণসমূহের জন্য এ হজ্বকে কেন্দ্র করে যে সব বিকৃতির উদ্ভব ঘটেছিল, সেগুলোর মূলোৎপাটন করবেন এবং জনগণকে আরাফাত ও মিনার সীমানা এবং ঐসব স্থান থেকে বের হবার সঠিক সময়ও শিখিয়ে দেবেন।

মহানবী (সা.) ইসলামী বর্ষপঞ্জীর একাদশ মাস অর্থাৎ যিলক্বদ মাসে নির্দেশ জারী করেন, তিনি ঐ বছর মহান আল্লাহর ঘর (কাবা শরীফ) যিয়ারত করতে যাবেন। এ ঘোষণা মুসলমানদের এক বিরাট অংশের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মদীনার চারপাশে তাঁবু স্থাপন করে মহানবীর হজ্ব যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

মহানবী (সা.) ২৬ যিলক্বদে আবু দুজানাকে মদীনায় নিজের স্থলবর্তী নিযুক্ত করে ৬০টি কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। তিনি যূল হুলাইফায় পৌঁছে দু’টি সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে ‘মসজিদে শাজারাহ্’ থেকে ইহরাম বাধেন এবং ইহরাম বাধার সময় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আহবানে সাড়া দানস্বরূপ প্রসিদ্ধ দুআ, ‘লাব্বাইকা’ (لبّيك) আবৃত্তি করেন। আর যখনই তিনি কোন বহনকারী পশু (সওয়ারী) দেখতে পেয়েছেন বা উঁচু বা নীচু স্থানে উপনীত হয়েছেন, তখনই তিনি ‘লাব্বাইকা’ বলেছেন। তিনি পবিত্র মক্কার নিকটবর্তী হয়ে ‘লাব্বাইকা’ উচ্চারণ বন্ধ করে দেন। ৪ যিলহজ্ব তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন এবং সরাসরি মসজিদুল হারামের পথ ধরে এগিয়ে যান। তিনি বনী শাইবার ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। ঐ অবস্থায় তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করছিলেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ওপর দরূদ পাঠাচ্ছিলেন।

তাওয়াফের সময় তিনি হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) মুখোমুখি হলে প্রথমে একে স্পর্শ করেন এবং এর উপর হাত বুলান এবং পবিত্র কাবা সাত বার প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করেন। এরপর তিনি তাওয়াফের নামায আদায়ের জন্য মাকাম-ই ইবরাহীমের পশ্চাতে গিয়ে দু’ রাকাআত নামায আদায় করেন। তিনি নামায সমাপ্ত করে সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সাঈ শুরু করেন। অতঃপর তিনি হাজীদের উদ্দেশে বলেন :

“যারা নিজেদের সাথে কুরবানীর পশু আনে নি, তারা ইহরাম ত্যাগ করবে এবং তাকসীর (অর্থাৎ চুল ছাটা বা নখ কাটা) করার মাধ্যমে তাদের জন্য ইহরামকালীন হারাম হয়ে যাওয়া বিষয়গুলো হালাল হয়ে যাবে। তবে আমি এবং যারা নিজেদের সাথে কুরবানীর পশু এনেছে, তারা অবশ্যই ইহরামের অবস্থায় থাকবে ঐ সময় পর্যন্ত, যখন তাদের কুরবানীর পশুগুলোকে তারা কুরবানী করবে।”

মহানবী (সা.)-এর এ কথা একদল লোকের কাছে খুব অসহনীয় বলে মনে হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল : মহানবী (সা.) ইহরামের অবস্থায় থাকবেন, আর আমরা ইহরামমুক্ত থাকব- এ অবস্থাটা আমাদের কাছে কখনই প্রীতিকর লাগবে না।

কখনো কখনো তারা বলছিল : “এটা ঠিক নয় যে, আমরা বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারীদের অন্তর্ভুক্ত হব, অথচ আমাদের মাথা ও ঘাড় থেকে গোসলের পানি ঝরতে থাকবে।”

মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি তখনও ইহরামের অবস্থায় থাকা হযরত উমরের উপর পড়ে। তিনি হযরত উমরকে বললেন : “তুমি কি তোমার সাথে কুরবানীর পশু এনেছ?” তিনি জবাবে বললেন : “না।” মহানবী তাঁকে বললেন : “তা হলে কেন তুমি ইহরামমুক্ত হও নি?” তখন হযরত উমর বললেন : “আমার কাছে এটা প্রীতিকর বোধ হচ্ছে না যে, আমি ইহরামমুক্ত থাকব, আর আপনি ইহরাম অবস্থায় থাকবেন।” মহানবী তাঁকে বললেন : “তুমি কেবল বর্তমানে নয়, বরং সব সময় এ বিশ্বাসের ওপরই থাকবে।”

মহানবী (সা.) জনগণের সন্দেহ ও দ্বিধা দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন :

لو كنت استقبلت من أمرى ما استدبرت لفعلت كما أمرتكم

“ভবিষ্যৎ যদি আমার কাছে অতীতের মতো স্পষ্ট হতো এবং তোমাদের দ্বিধা সম্পর্কে আমি জানতাম, তা হলে আমিও তোমাদের মতো কুরবানীর পশু নিজের সাথে না এনে মহান আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে আসতাম। তবে কী করব? কুরবানীর পশু নিজের সাথে নিয়ে এসেছি। কুরবানীর পশু তার স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত (حتى يبلغ الهدى محلّه) -মহান আল্লাহর এ বিধান অনুসারে মিনার দিবসে (১০ যিলহজ্ব) কুরবানী দেয়ার স্থানে আমার কুরবানীর পশু যবেহ করা পর্যন্ত আমাকে অবশ্যই ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে। তবে যে ব্যক্তি নিজের সাথে কুরবানীর পশু আনে নি, তাকে অবশ্যই ইহরামমুক্ত হতে হবে এবং সে যা আঞ্জাম দিয়েছে, তা ‘উমরাহ্’ বলে গণ্য হবে এবং পরে হজ্বের জন্য তাকে ইহরাম করতে হবে।”

হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু

উমরার আমলসমূহ সমাপ্ত হয়। উমরা ও হজ্বের আমলসমূহ শুরু হওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সময় কারো কাবায় (মসজিদুল হারাম ও মক্কা নগরীতে) অবস্থান করার ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্মত ছিলেন না। তাই তিনি মক্কার বাইরে তাঁর তাঁবু স্থাপন করার নির্দেশ দিলেন।

৮ যিলহজ্ব বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারীগণ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করেন, যাতে তাঁরা ৯ যিলহজ্ব দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (উকূফ) করতে পারেন। মহানবী (সা.) তারবীয়ার দিবসে (৮ যিলহজ্ব) মিনার পথে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা করেন এবং ৯ যিলহজ্বের সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি মিনায় অবস্থান করেন। এরপর তিনি নিজ উটের উপর সওয়ার হয়ে আরাফাতের পথে অগ্রসর হন এবং ‘নামিরাহ্’-এ অবতরণ করেন। উল্লেখ্য, এ স্থানেই মহানবী (সা.)-এর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়েছিল। ঐ মহতী মহাসমাবেশে মহানবী (সা.) উটের পিঠে আসীন অবস্থায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। আর এ ঐতিহাসিক ভাষণই ‘বিদায় হজ্বের ভাষণ’ নামে খ্যাতি লাভ করে।

 

বিদায় হজ্বে মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ

 

ঐদিন আরাফাতের ময়দানে এক মহতী মর্যাদপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হিজাযের অধিবাসীরা সে দিন পর্যন্ত এমন সমাবেশ কখনো প্রত্যক্ষ করে নি। একত্ববাদের ধ্বনি ও আহবান আরাফাতের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এই আরাফাতের ময়দানে মাত্র ক’দিন আগেও মুশরিক ও পৌত্তলিকদের অবস্থানস্থল ও ঘাঁটি ছিল। এখন চিরতরে তা তাওহীদপন্থী ও মহান এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতকারীদের মজবুত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। মহানবী (সা.) আরাফাতের ময়দানে এক লক্ষ মানুষের সাথে জোহর ও আসরের নামায আদায় করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে ঐ দিন (৯ যিলহজ্ব ১০ হি.) তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও উচ্চকণ্ঠের অধিকারী তাঁর এক সাহাবী তাঁর ভাষণ পুনরাবৃত্তি করে দূরবর্তী লোকদের কর্ণগোচর করেছিলেন।

মহানবী (সা.) এভাবে তাঁর ভাষণ শুরু করেন :

“হে লোকসকল! তোমরা আমার কথা শ্রবণ কর। সম্ভবত এরপর তোমাদের সাথে এ স্থানে আমার আর সাক্ষাৎ হবে না। হে লোকসকল! তোমাদের ধন-সম্পদসমূহ, যেদিন তোমরা মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ করবে, সেদিন পর্যন্ত আজকের এ দিন এবং এ মাসের ন্যায় সম্মানিত এবং এগুলোর ওপর যে কোন ধরনের আগ্রাসন ও সীমা লঙ্ঘন হারাম হবে।”

মহানবী (সা.) মুসলমানদের জান-মালের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ব্যাপারে তাঁর বাণী (জনগণের অন্তরে) বদ্ধমূল হওয়া এবং এর গভীর প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য রবীয়াহ্ ইবনে উমাইয়্যাকে বললেন : “তাদের কাছে এ কয়েকটি বিষয় জিজ্ঞেস কর এবং বল, “এটি কোন মাস?” তখন সবাই বলেছিলেন : “এটি হারাম মাস। এ মাসে যুদ্ধ ও রক্তপাত নিষিদ্ধ।” মহানবী (সা.) রবীয়াহকে বললেন : “তাদেরকে বল : যেদিন তোমরা এ জগৎ থেকে বিদায় নেবে, সেদিন পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ তোমাদের ধন-সম্পদ তোমাদের একে অপরের জন্য হারাম এবং (তোমাদের পরস্পরের নিকট) সম্মানিত করে দিয়েছেন।”

তিনি পুনরায় নির্দেশ দিলেন : “তাদেরকে আবার জিজ্ঞেস কর : এ স্থান কেমন?” তখন সবাই বলেছিলেন : “এ হচ্ছে সম্মানিত স্থান এবং এখানে রক্তপাত ও সীমা লঙ্ঘন নিষিদ্ধ।” মহানবী (সা.) (রবীয়াহকে) বললেন : “তাদেরকে জানিয়ে দাও, তোমাদের রক্ত (প্রাণ) ও ধন-সম্পদ এ স্থান ও অঞ্চলের মতো সম্মানিত এবং এগুলোর ওপর যে কোন ধরনের আগ্রাসন ও সীমা লঙ্ঘন নিষিদ্ধ।” মহানবী (সা.) পুনরায় আদেশ দিলেন : “তাদেরকে প্রশ্ন কর : আজ কোন্ দিবস?” তাঁরা বললেন : “আজ হজ্ব-ই-আকবার (বড় হজ্জ্বের) দিবস।” তিনি নির্দেশ দিলেন : “তাদেরকে জানিয়ে দাও, আজকের মতো অর্থাৎ এ দিবসের ন্যায় তোমাদের রক্ত এবং ধন-সম্পদ সম্মানিত।”

“হে জনতা! তোমরা জেনে রাখ, জাহিলীয়াতের যুগে যে সব রক্ত ঝরানো হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই ভুলে যেতে হবে এবং সেগুলোর ব্যাপারে প্রতিশোধ গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি ইবনে রবীয়ার (মহানবীর এক আত্মীয়) রক্তও (রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি) ভুলে যেতে হবে।

তোমরা শীঘ্রই মহান আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে। ঐ জগতে তোমাদের ভাল ও মন্দ কাজগুলোর বিচার করা হবে। আমি তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি, যার কাছে কোন আমানত থাকে, তার উচিত অবশ্যই তা প্রকৃত মালিকের কাছে ফেরত দেয়া।

হে জনতা! তোমরা জেনে রাখ, ইসলাম ধর্মে সুদ হারাম। যারা নিজেদের ধন-সম্পদ সুদ অর্জন করার পথে ব্যবহার করে, তারা কেবল তাদের মূলধন ফেরত নিতে পারবে। না তারা অত্যাচার করবে, না তারা অত্যাচারিত হবে। যে লাভ (সুদ) আব্বাস ইসলামের আগে ঋণীদের কাছে তলব করত, তা এখন বাতিল এবং তা তলব করার অধিকার তার নেই।

হে লোকসকল! যেহেতু শয়তান তোমাদের ভূ-খণ্ডে আর পূজিত হবে না, সেহেতু সে এখন নিরাশ হয়ে গেছে। তবে তোমরা যদি ছোট ছোট বিষয়ে শয়তানের অনুসরণ কর, তা হলে সে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। তাই তোমরা সে শয়তানের অনুসরণ করো না। হারাম মাসসমূহে পরিবর্তন আনয়ন চরম পর্যায়ের কুফর, খোদাদ্রোহিতা ও অবিশ্বাস থেকে উৎসারিত। আর যে সব কাফির ব্যক্তি হারাম মাসসমূহের সাথে অপরিচিত, তারা এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে পথভ্রষ্ট হয়। আর এ ধরনের পরিবর্তন আনার ফলে হারাম মাস এক বছর হালাল মাসে এবং অন্য এক বছর তা হারাম মাস হয়ে যাবে। তাদের জানা উচিত, এ ধরনের কাজের দ্বারা তারা মহান আল্লাহর হারাম বিষয়কে হালাল এবং মহান আল্লাহর হালাল বিষয়কে হারাম করে দেয়।

অবশ্যই হালাল ও হারাম মাসসমূহ ঐ দিনের মতো হওয়া বাঞ্ছনীয়, যে দিন মহান আল্লাহ্ আকাশ, পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য সৃষ্টি করেছিলেন। মহান আল্লাহর কাছে মাসসমূহের সংখ্যা বারো। এ বারো মাসের মধ্যে চার মাসকে মহান আল্লাহ্ হারাম করেছেন। এ চার মাস হচ্ছে যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মুহররম এবং রজব। যিলক্বদ, যিলহজ্ব ও মুহররম- এ তিন মাস একের পর এক আগমন করে।

হে লোকসকল! তোমাদের ওপর তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার আছে। আর তাদের ওপরও তোমাদের অধিকার আছে। তোমাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তোমাদের অনুমতি ও সম্মতি ব্যতীত তারা (তোমাদের) ঘরে কাউকে বরণ ও আপ্যায়ন করবে না এবং কোন পাপ করবে না। এর অন্যথা হলে মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাদের সাথে এক শয্যায় শয়ন ত্যাগ এবং তাদের শাসন করার অনুমতি দিয়েছেন। আর যদি তারা সঠিক পথে প্রত্যাবর্তন করে, তা হলে তাদের ওপর তোমাদের স্নেহ ও ভালোবাসার ছায়া প্রসারিত করবে এবং প্রাচুর্য সহকারে তাদের জীবন-যাপনের যাবতীয় উপকরণের আয়োজন করবে।

আমি এ স্থানে তোমাদের নিজ স্ত্রীদের প্রতি কল্যাণ ও সদাচরণের উপদেশ দিচ্ছি। কারণ তারা তোমাদের হাতে মহান আল্লাহর আমানতস্বরূপ এবং মহান আল্লাহর বিধানসমূহের দ্বারা তারা তোমাদের ওপর হালাল হয়েছে।

হে লোকসকল! তোমরা আমার কথাগুলোয় মনোযোগ দাও এবং এগুলোর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা কর। আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা এ উভয়কে আঁকড়ে ধর, তা হলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না : একটি মহান আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কুরআন) এবং অন্যটি আমার সুন্নাহ্ (আমার বাণী)।”

১০ যিলহজ্ব মহানবী (মাশআর থেকে) মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন এবং কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী এবং তাকসীর ইত্যাদি সম্পন্ন করে হজ্বের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান ও কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য পবিত্র মক্কা গমন করেন। আর এভাবে তিনি জনগণকে হজ্বের আচার-অনুষ্ঠান এবং বিধানসমূহ শিক্ষা দেন। কখনো কখনো হাদীসবিদ্যা ও ইতিহাসে মহানবী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক সফরকে ‘বিদায় হজ্ব’, কখনো কখনো ‘হজ্বে বালাগ’ (মহান আল্লাহর শাশ্বত বাণী পৌঁছে দেয়ার হজ্ব বা প্রচারের হজ্ব) এবং ‘হজ্বে ইসলাম’ (ইসলামের হজ্ব) নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং এ সব নামের প্রতিটি এমন সব উপলক্ষের ভিত্তিতে রাখা হয়েছে, যেসবের অন্তর্নিহিত কারণ সূক্ষ্মদর্শী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের কাছে কোন গোপনীয় বিষয় নয়।

শেষে আমরা এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, হাদীসবিদগণের (মুহাদ্দিস) মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মহানবী (সা.) আরাফাতের দিবসে (৯ যিলহজ্ব) তাঁর এ ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তবে কতিপয় মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, মহানবী (সা.) ১০ যিলহজ্ব এ ভাষণ দিয়েছিলেন।

পাদটীকা :

১. এ কথাটি আসলে স্ত্রী সহবাস ও জানাবাতের গোসলকে বুঝিয়েছে। কারণ ইহরামের হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে স্ত্রী সহবাস। আর তাকসীর করার মাধ্যমে স্ত্রী সহবাস হালাল হয়ে যায়।

২. বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খণ্ড, পৃ. ৩১৯; এ ঘটনা মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট নির্দেশসমূহের বিপক্ষে একদল সাহাবীর একগুঁয়েমিপূর্ণ অবস্থান গ্রহণের বিষয়টি ব্যক্ত করে। ইসলামের ইতিহাসে এ ব্যাপারে অনেক প্রমাণ রয়েছে এবং মরহুম শারাফুদ্দীন আমিলী এ ব্যাপারে ‘আন নাস ওয়াল ইজতিহাদ’ অর্থাৎ ‘পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিধানসমূহের বিপরীতে ইজতিহাদ’ নামক একখানা স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন।

৩.  সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৫

৪. পবিত্র কাবার মুতাওয়াল্লীরা, যে সব গোত্র হারাম মাসগুলোয় যুদ্ধ ও রক্তপাত করার অভিপ্রায় পোষণ করত, তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে হারাম মাসগুলো পরিবর্তন করে ফেলত এবং এ সব মাসের স্থলে বছরের অন্যান্য মাসকে হারাম মাস হিসেবে ঘোষণা করত।

৫. মহানবী (সা.) এ ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণকে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্ আঁকড়ে ধরার উপদেশ দিয়েছেন। আর তিনি গাদীরে খুমের ভাষণে এবং তাঁর ওফাতের পূর্ববর্তী দিনগুলোয় মহান আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর বংশধর অর্থাৎ ইতরাতের (আহলে বাইত) ওসিয়ত করেছেন। এ হাদীসদ্বয় দু’টি ভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে বর্ণিত হয়েছে এবং উভয়ের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ মহানবী (সা.) একটি ক্ষেত্রে সুন্নাহকে পবিত্র কুরআনের সমকক্ষ বলেছেন এবং আরেক ক্ষেত্রে তাঁর পবিত্র আহলে বাইত ও স্থলবর্তীদের ব্যাপারে ওসিয়ত করেছেন এবং তাঁদেরকে অনুসরণ করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন-এতে কোন অসুবিধা নেই। আহলে বাইতকে অনুসরণের অর্থই হচ্ছে তাঁর ও তাঁর পবিত্র সুন্নাহরই অনুসরণ। আহলে সুন্নাতের কতিপয় আলেম, যেমন শেখ শালতুত তাঁর তাফসীর গ্রন্থে ধারণা করেছেন, মহানবী (সা.) কেবল একটি ঘটনার ক্ষেত্রেই সাকালাইন (দু’টি ভারী ও মূল্যবান জিনিস) সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন; তাই তিনি পাদটীকায় ইতরাত (অর্থাৎ রক্তজ বংশধর) শব্দটি نسخه بدل হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ এ ধরনের সংশোধনের আসলে কোন প্রয়োজনই নেই। কারণ মূলনীতিগতভাবে এ দুই রেওয়ায়েতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, যার ফলে আমাদের এ পথে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে।

৬. তাকসীর : গোঁফ, চুল-দাঁড়ি ছাটা (ছোট করা) এবং হাত ও পায়ের আঙুলের নখ কাটা।

৭. আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৪

[সূত্র:  আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানির লেখা ‘চিরভাস্বর মহানবী-(সা)’, দ্বিতীয় খণ্ড]

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)