আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(৭ম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১৮-২২

সূরা মায়েদার ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُمْ بِذُنُوبِكُمْ بَلْ أَنْتُمْ بَشَرٌ مِمَّنْ خَلَقَ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ

"ইহুদী ও খ্রিস্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়জন। আপনি বলুন, তবে তিনি তোমাদেরকে পাপের বিনিময়ে কেন শাস্তি দান করেন? বরং তোমরাও আল্লাহর সৃষ্ট অন্যান্য মানবের মতই সাধারণ মানুষ ( তোমাদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা বা মর্যাদা নেই)। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তাতে আল্লাহরই আধিপত্য রয়েছে এবং তাঁর কাছেই চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন বা তাঁর দিকেই ফিরে আসতে হবে সবাইকে।" (৫:১৮)

আগের আয়াতে আমরা জেনেছি, খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আ.) কে আল্লাহর সমতুল্য মনে করে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, খ্রিস্টানরা শুধু তাদের নবীকেই অন্য নবী-রাসূলদের চেয়ে বড় মনে করে তা নয়, এমনকি নিজেদেরকেও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের চেয়ে বড় বা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, তারা আল্লাহর সন্তান ও বন্ধু হওয়ার কারণে যত খুশি পাপ করা সত্ত্বেও সব শাস্তি বা আজাব থেকে মুক্ত থাকবে। মজার ব্যাপার হলো, ইহুদিরাও এ ধরনের ভুল ধারণা পোষণ করে এবং একমাত্র তারাই সৌভাগ্য ও মুক্তির অধিকারী হবে বলে মনে করে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাদের এসব অলীক স্বপ্ন-বিলাসের জবাবে বলছেন:

হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন অন্যান্য মানুষের মতই একজন মানুষ এবং যারা তাঁর অনুসারী হওয়ার দাবি করছে তারাও অন্যান্য মানুষের মতই সাধারণ মানুষ। মানুষের কারও ওপরই কারও প্রাধান্য নেই একমাত্র খোদাভীতি বা তাকওয়ার গুণ ছাড়া। একমাত্র খোদাভীতি ও সৎকাজই বিচার দিবসে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, বংশ বা কোনো পদ-মর্যাদা নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো:

এক. বর্ণবাদ ও বিশেষ সুবিধা পাওয়ার মানসিকতা ধর্ম বা বিশ্বাসের নামেও বৈধ নয়।

দুই. ধর্মীয় অহংকার এমন এক মারাত্মক বিপদ বা রোগ যা সব ধর্মের অনুসারীর জন্যই সর্বনাশের কারণ হতে পারে। তাই ধর্ম পালন যেন আমাদের মধ্যে বড়ত্বের বা শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার জাগিয়ে না তোলে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

তিন. কারা বেহেশতে ও কারা নরকে বা দোযখে যাবে তা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো বিষয় নয় যে অন্যদের জাহান্নামী মনে করব, বরং এসব বিষয় আল্লাহরই দেখার বিষয়। তিনি প্রজ্ঞা ও কল্যাণের আলোকে যে কোনো পাপীকে শাস্তি দেবেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করবেন।

সূরা মায়েদার ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ عَلَى فَتْرَةٍ مِنَ الرُّسُلِ أَنْ تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلَا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

"হে আহলে-কিতাব বা গ্রন্থপ্রাপ্তরা! রাসূল প্রেরণে বিরতির পর তোমাদের কাছে আমার রসূল আগমন করেছেন,যাতে তিনি তোমাদের কাছে (ধর্মের বাস্তবতা) স্পষ্ট বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন-যাতে তোমরা একথা বলতে না পার যে, আমাদের কাছে কোন সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শক আগমন করেনি। অতএব, নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শক এসে গেছেন। আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান।" (৫:১৯)

প্রামাণ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) খ্রিস্টিয় ৫৭০ সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি জন্ম লাভের পর ৪০ বছর বয়সে অর্থাৎ খ্রিস্টিয় ৬১০ সনে রেসালাতের দায়িত্ব বা ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অন্য কথায় হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র রেসালাতের ব্যবধান প্রায় ৬০০ বছর। এই সুদীর্ঘ ৬০০ বছরে কোনো মানব জাতির জন্য কোনো নবী পাঠানো হয়নি। কিন্তু মানুষের জন্য ঐশী নির্দেশনা ও ধর্ম প্রচারের কাজ বন্ধ ছিল না। একদল প্রচারক সব সময়ই মানুষের কাছে ধর্মের প্রকৃত বাণী তুলে ধরেছেন। এ আয়াতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বলা হচ্ছে: আল্লাহ ইসলামের নবী (সা.)-কে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। তোমরা যেহেতু অন্য নবীদের দেখার সৌভাগ্য পেয়েছ এবং তাদের প্রচারিত ধর্মের অনুসারী হওয়ার দাবিদার তাই তোমাদের তো উচিত অন্যদের আগেই মুহাম্মাদ (সা.)'র প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর ধর্ম গ্রহণ করা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো:

এক. নবী-রাসূলদের আগমন মানুষের এ অজুহাত তোলার পথ বন্ধ করে দেয় যে, আমরা সত্যকে জানতে ও বুঝতে পারিনি।

দুই. নবী-রাসূলদের দায়িত্ব হলো, মানুষকে পবিত্র ও সৎকাজের পুরস্কারের সুসংবাদ দেয়া এবং অন্যায়, অবিচার ও নোংরা কাজের কঠোর শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করা।

সূরা মায়েদার ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَعَلَ فِيكُمْ أَنْبِيَاءَ وَجَعَلَكُمْ مُلُوكًا وَآَتَاكُمْ مَا لَمْ يُؤْتِ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ

"যখন মুসা নিজ সম্প্রদায়কে বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে পয়গম্বর সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি করেছেন এবং তোমাদেরকে এমন জিনিস দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি।" (৫:২০)

এ আয়াত থেকে পরের আয়াতগুলোতে নিজ জাতি বা ইহুদিদের সাথে হযরত মুসা (আ.)'র সংলাপের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইহুদিদেরকে আল্লাহ অনেক নেয়ামত দিয়েছেন। যেমন, মহান আল্লাহ তাদের কাছে হযরত ইউসুফ (আ.) ও হযরত সোলায়মান (আ.)'র মত নবী পাঠিয়েছেন যারা ছিলেন নবী এবং তাঁরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতার অধিকারীও হয়েছিলেন। ফলে ইহুদি জাতির ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এসব নেয়ামতের শোকর আদায় না করার কারণে এবং এসব নেয়ামতকে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে তারা ফেরাউনের মত জালেম শাসকের নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। ফেরাউন তাদের পুরুষদেরকে দাস ও নারীদেরকে দাসীতে পরিণত করেছিল।

হযরত মুসা (আ.) নিজ জাতির সমৃদ্ধ অতীতের কথা তুলে ধরে তাদেরকে আবারও সুপথে ফিরে আসার, হিজরত করার এবং পুরনো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য পরিশ্রম করার বা কঠোর প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান যাতে ইহুদিরা স্থবিরতা, অলসতা ও নির্জীব অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি দিক হলো:

এক. নবুওয়্যত, রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা মহান আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় নেয়ামত। এসব নেয়ামতের গুরুত্ব বোঝা উচিত।

দুই. ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। ইহুদিরা আল্লাহর অনেক অনুগ্রহ ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও বিভ্রান্তি, অকর্মন্যতা, অলসতা ও পরাধীনতার শিকার হয়।

সূরা মায়েদার ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ (21) قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّ فِيهَا قَوْمًا جَبَّارِينَ وَإِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُونَ (22)

"(মুসা তাদের বললেন) হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং পেছন দিকে প্রত্যাবর্তন করো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।" (৫:২১)

"তারা বললঃ হে মুসা, সেখানে একটি অত্যাচারি ও বলদর্পী জাতি রয়েছে। আমরা কখনও সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। তারা যদি সেখান থেকে বের হয়ে যায় তবে নিশ্চিতই আমরা প্রবেশ করব।" (৫:২২)

হযরত মুসা (আ.) জিহাদ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সিরিয়া এবং বায়তুল মোকাদ্দাস অঞ্চলে প্রবেশ করতে ইহুদিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ইহুদি জাতি এর মাধ্যমে বলদর্পী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুক। কিন্তু ইহুদিরা দীর্ঘ দিন ধরে ফেরাউনের তাগুতি ও জুলুমপূর্ণ শাসনের আওতায় থেকে এতটাই ভীরু ও কাপুরুষ হয়ে পড়েছিল যে তারা বলে: এ ধরনের কাজ আমাদের দিয়ে সম্ভব নয়। যুদ্ধ করার মত ধৈর্য আমাদের নেই। তারা অর্থাৎ জালেমরা নিজেরাই যদি ওই অঞ্চল থেকে বের হয়ে যায় এবং ওই পবিত্র ভূখণ্ড আমাদের ফেরত দেয়, কেবল তখনই আমরা সেখানে প্রবেশ করব।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. ঐশী ধর্মের অনুসারীদের উচিত ধর্মীয় পবিত্র স্থান ও স্থাপনাগুলোকে জালেম বা নিপীড়কদের হাত থেকে উদ্ধার বা রক্ষা করা।

দুই. আত্মবিশ্বাসের অভাব ও নিজেদের দুর্বল ভাবা শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরাজয়ের চালিকা শক্তি। নবী-রাসূলরা এসব প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)