আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(১১তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৩৬-৪০

সূরা মায়েদার ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ أَنَّ لَهُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (৩৬) يُرِيدُونَ أَنْ يَخْرُجُوا مِنَ النَّارِ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنْهَا وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ

"যারা কাফের, যদি তাদের কাছে পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ এবং তৎসহ আরও তদনুরূপ সম্পদ থাকে আর এগুলো বিনিময়ে দিয়ে কিয়ামতের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়, তবুও তাদের কাছ থেকে তা কবুল করা হবে না। তাদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।" (৫:৩৬)

"তারা দোযখের আগুন থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে কিন্তু তা থেকে বের হতে পারবে না। তারা চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ করবে।" (৫:৩৭)

আগের আয়াতে সৎ কাজ করতে, খোদাভীরু বা সংযমী হতে এবং আল্লাহর পথে সক্রিয় বা পরিশ্রমী হতে ও জিহাদে নিয়োজিত হতে বিশ্বাসীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ এই বলে মুমিনদের সতর্ক করছেন যে, কাফেরদের সম্পদ ও ক্ষমতা যেন তোমাদের চোখ ও মনে বড় বা চাকচিক্যময় হয়ে দেখা না দেয় এবং এসব বিষয় যেন তোমাদেরকে হতাশ না করে। কারণ, এসব চাকচিক্য দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী বিষয়, এসব ক্ষমতা ও সম্পদ পরকালে কোনোই কাজে আসবে না। এমনকি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ও তার দ্বিগুণ সম্পদ দিয়েও কোনো কাফের বা অবিশ্বাসী পরকালের শাস্তি থেকে মুক্ত হতে পারবে না।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

এক. মহান আল্লাহর বিচারালয়ে দোযখ থেকে মুক্তির জন্য কোনো বিনিময়ই গ্রহণ করা হবে না।

দুই. মানুষের মুক্তির চালিকা শক্তিগুলো নিয়্যাত বা মনের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, সৌভাগ্য বা মুক্তি বাহ্যিক ঈমান ও কাজকর্ম, কিংবা অর্থ-সম্পদ বা ক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে না ।

তিন. যারা পৃথিবীতে কুফরির ওপর অবিচল বা অটল থেকেছে, তাদের শাস্তিও হবে চিরস্থায়ী।

সূরা মায়েদার ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

"যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের হাত কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসেবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি। আল্লাহ পরাক্রান্ত, জ্ঞানময়।" (৫:৩৮)

যারা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন ও সম্পদের জন্য হুমকি বা নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে তাদের ব্যাপারে খোদায়ী বিধান বর্ণনার পর এ আয়াতে (বিশেষ অবস্থার ক্ষেত্রে) চুরি করার শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। চোর গোপনে মানুষের সম্পদ চুরি করে এবং এ কাজে হাত ব্যবহার করে। যে হাত বিশ্বাসঘাতকতায় ব্যবহৃত হয়, তা মূল্যহীন। তাই আল্লাহ বলছেন, চোরের হাত কেটে দাও, তা সে পুরুষ বা নারী যে-ই হোক না কেন, এটা তাদেরই কাজের শাস্তি, আল্লাহর পক্ষ থেকে জুলুম নয়। প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই এ ধরনের কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন।

অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে যে কোনো চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কাটা যায় না। চুরি করা জিনিসের মূল্য এক চতুর্থাংশ মেসকাল ওজনের সোনার মূল্যের সমপরিমাণ হলে বা প্রায় এক গ্রাম (প্রায় ৫ গ্রাম সমান এক মেসকাল) হলে এবং চোর যদি তা জরুরি প্রয়োজন থাকা না সত্ত্বেও চুরি করে থাকে বা এ ধরনের আরও কিছু বিশেষ অবস্থায় যদি চুরি করে (যার বিস্তারিত বিবরণ ইসলামী আইন শাস্ত্র বা ফেক্বাহ'র গ্রন্থে রয়েছে) তবেই তার হাত কাটা যাবে। অবশ্য হাত কাটা বলতে হাতের কেবল চারটি আঙ্গুল কাটার বিধান রয়েছে ইসলামী শাস্ত্রে।

কোনো কোনো কথিত বুদ্ধিজীবী চোরের হাত কাটার বিধানকে নির্দয় ও অমানবিক জঙ্গলি আইন বলে মনে করেন। অথচ গোটা সমাজের নিরাপত্তার জন্য কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকের হাত কেটে দেয়া পুরোপুরি মানবিক বিষয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যেসব সমাজে এই খোদায়ী বিধান বাস্তবায়িত হয়েছে সেসব সমাজে চুরির ঘটনা খুবই কম এবং পশ্চিমা সমাজে চুরির হার খুবই বেশি।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. ইসলামে অপরাধের শাস্তি বিষয়ক আইনে অপরাধী ছাড়াও অন্যদের সতর্ক করা বা শিক্ষা নেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই জনগণের সামনেই প্রকাশ্যে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হয় যাতে কেউ এ ধরনের অপরাধে জড়িত হতে সাহসী না হয়।

দুই. সমাজের নিরাপত্তা ও ব্যক্তির মালিকানাকে ইসলাম এত বেশি গুরুত্ব দেয় যে এ দুই ক্ষেত্রে আগ্রাসী ব্যক্তিকে ইসলাম কঠোরতম শাস্তি দেয়।

তিন. ইসলাম ব্যক্তিকেন্দ্রীক ধর্ম নয়, বরং সমাজ সংস্কারের জন্য ইসলামের রয়েছে যথেষ্ট কর্মসূচি। ইসলামের বিধান কেবলই পরকালকেন্দ্রীক নয়, ইহকালেও মানুষের জীবনের সব দিকের জন্য বিধান দিয়েছে এ মহান ধর্ম।

সূরা মায়েদার ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৩৯) أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَيَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

"অতঃপর যে (অন্যদের ওপর) নিজের অত্যাচারের পর তওবা করে এবং সংশোধিত হয় (বা ক্ষতিপূরণ করে), নিশ্চয় আল্লাহ (কেবল) তার তওবাই কবুল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।" (৫:৩৯)

"তুমি কি জান না যে আল্লাহর নিমিত্তেই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য। তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।" (৫:৪০)

আগের আয়াতে চুরির শাস্তি সংক্রান্ত বিধান বর্ণনার পর এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর রহমতের দরজা সব সময়ই খোলা রয়েছে। মহান আল্লাহর তাঁর দয়াকে ক্রোধের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই এ আয়াতে তিনি বলে দিচ্ছেন কেউ যদি চুরি করার পর নিজের এ হীন কাজের জন্য অনুতপ্ত হয় ও তওবা করে এবং অতীতকে সংশোধন করে বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা যে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করে, তাহলে আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন। এটা স্পষ্ট যে চুরির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার আগেই আন্তরিকভাবে তওবা করতে হবে ও চুরি করা সম্পদ মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে ও অন্য সব ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে মালিকের সন্তুষ্টি আদায় করতে হবে, আর কেবল এ অবস্থায়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু এর বিপরীতে চুরি ধরা পড়ার পর শাস্তির ভয়ে তওবার কথা ঘোষণা করার কোনো মূল্য নেই।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. তওবার জন্য কেবল মনে মনে অনুতপ্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়, অতীতে যাদের ক্ষতি করা হয়েছে সেসবের ক্ষতিপূরণও দিতে হবে।

দুই. কেউ যদি প্রকৃত তওবায় নিয়োজিত হয় তথা আল্লাহর আশ্রয়ে ফিরে আসতে চায়, আল্লাহর রহমতও তার কাছে ফিরে আসবে।

তিন. শাস্তি ও ক্ষমা দুই-ই তোমার হাতে। বান্দাদের জন্য আল্লাহর শাস্তি বা ক্ষমার হাত বাঁধা নয়। আল্লাহ ন্যায়বিচারের আলোকে অপরাধীকে শাস্তি দেন ও প্রকৃত তওবাকারীকে ক্ষমা করেন।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)