আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(১৩তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৪৪-৪৭

সূরা মায়েদার ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

"আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে রয়েছে হেদায়াত ও আলো। (তাওরাত নাজেল হওয়ার পর হযরত ঈসার যুগ পর্যন্ত তাওরাতের বিধানের প্রতি আত্মসমর্পিত) আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বরগণ ইহুদীদেরকে ফয়সালা দিতেন। ইহুদি দরবেশ, পণ্ডিত ও আলেমরাও ফয়সালা দিতেন এর মাধ্যমে, তারা তাওরাতের সত্যতার বিষয়টি জানতেন বা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য ছিলেন এবং তাদেরকে এ খোদায়ী গ্রন্থ রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। অতএব, ( হে ধর্ম বিশেষজ্ঞরা!) তোমরা মানুষকে ভয় করো না ( খোদায়ি বিধানে কোনো সংযোজন-বিয়োজন করো না বা বিকৃতি সাধন কোরো না), বরং আমাকে (তথা আমার বিরোধিতাকে) ভয় কর এবং আমার আয়াতগুলো স্বল্পমূল্যে বিক্রি করো না, (জেনে রাখ) যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।" (৫:৪৪)

আগের পর্বে আলোচনা করা হয়েছিল একদল ইহুদি তাওরাতের কঠোর বিধান এড়ানোর জন্য বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র কাছে ধর্ণা দিয়েছিল। যে অপরাধ তারা করেছিল সে ব্যাপারে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সহজ কোনো শাস্তির বিধান দেবেন-এটাই ছিল তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু রাসূল (সা.) তাওরাতের বিধান অনুযায়ী কঠোর শাস্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর এই আয়াতে ও পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, কেবল হযরত মুসা (আ.)'র পরবর্তী যুগের নবীরাই নন, খোদায়ী বিধান রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইহুদি পুরোহিত ও পণ্ডিতদেরও তাই করা উচিত। তাই মানুষের বিরোধিতার কারণে বা নিজের স্বার্থের কারণে খোদায়ী বিধান গোপন করা বা বিকৃত করা বৈধ নয়। এ কাজ আল্লাহকে অস্বীকারের সমতুল্য।

এ আয়াতে আলেমদের সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেন ধর্মের বিধান রক্ষা করেন এবং যারা প্রবৃত্তির কাছে নতজানু হয়ে বা খেয়ালিপনার কারণে ধর্ম বা ধর্মের বিধানকে বিকৃত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. ধর্মীয় নেতাদের উচিত শাসকদের ওপর পূর্ণ নজরদারি রাখা যাতে তারা ধর্ম বিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারেন এবং এ ব্যাপারে কোনো হুমকির পরোয়া করা বা প্রলোভনে প্রলুব্ধ হওয়া ঠিক হবে না।

দুই. আসমানি বিধান থাকা সত্ত্বেও মানব-রচিত বিধানের দ্বারস্থ হওয়া মূল পথ থেকে বিচ্যুতির সমতুল্য।

সূরা মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

"আমি এ গ্রন্থে তথা তাওরাতে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখম সমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।" (৫:৪৫)

ইহুদি পণ্ডিত বা আলেমরা আরও যেসব ক্ষেত্রে খোদায়ী বিধানকে যথাযথভাবে বলতো না কিংবা বাস্তবায়ন করত না, তা হলো হত্যা বা অঙ্গহানির প্রতিশোধ বা কাসাসের বিধান। তারা কোনো কোনো গোত্রের ব্যাপারে এ বিধান বাস্তবায়ন করত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বিধান বাস্তবায়ন করত না। কোরআন ইসলামের এ সংক্রান্ত বিধান তুলে ধরে বলছে যে এ বিধান তাওরাতেও দেয়া হয়েছিল। ছোট বা বড় প্রত্যেক আঘাত বা ক্ষতের বিনিময়ে সমপর্যায়ের প্রতিশোধের বিধান রয়েছে এবং এ আইন বাস্তবায়নের ব্যাপারে এমনটি মনে করার কারণ নেই যে অমুকের রক্তের দাম কম বা অমুকের রক্তের মূল্য বেশি। যারা আল্লাহর এ বিধান বাদ দিয়ে অন্য কোনো বিধানের অনুসরণ করছে তারা নিজের ও সমাজের ক্ষতি করছে।

অবশ্য হত্যার মত অপরাধে জড়িত ব্যক্তির মত অপরাধীদেরও (সমাজের জন্য ক্ষতিকর না হলে) অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া একটি পছন্দনীয় কাজ। তাই কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, যারাই কাসাস বা প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অপরাধীকে ক্ষমা করবে, মহান আল্লাহও তাদের পাপ ক্ষমা করবেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. আইনের দৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জ্ঞানী, মূর্খ ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষ সব মানুষই সমান।

দুই. কাসাসের বিধান শুধু ইসলাম ধর্মেরই নিজস্ব বিধান নয়, হযরত মুসা (আ.)'র যুগ থেকে এ বিধান প্রচলিত হয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।

তিন. শুধু অর্থ-সম্পদ দান করাই সদকা নয়, অন্যদের ভুল ও অপরাধ ক্ষমা করাও এক ধরনের সদকা।

চার. ইসলাম অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও কঠোরতার পাশাপাশি দয়া ও অনুগ্রহও দেখায়।

পাঁচ. কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড বা জরিমানা অবৈধ হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণের মত অপরাধের চালিকাশক্তিগুলোকে প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই হত্যার বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জরুরি।

সূরা মায়েদার ৪৬ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَفَّيْنَا عَلَى آَثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَآَتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ (46) وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنْجِيلِ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

"আমি তাদের পেছনে মরিয়ম তনয় ঈসাকে পাঠিয়েছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববতী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়ন করে ও দেখায় পথের দিশা এবং এটি খোদাভীরুদের জন্যে উপদেশ ও সতর্কবাণী।" (৫:৪৬)

"ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী।" (৫:৪৭)

আগের আয়াতে আল্লাহর পাঠানো আসল তাওরাত অনুযায়ী জীবন-যাপন করতে ও এ গ্রন্থের বিধি-বিধান মেনে চলতে ইহুদিদের প্রতি উপদেশ দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ খ্রিস্টানদের প্রতি বলছেন, ইঞ্জিলও আল্লাহর পাঠানো গ্রন্থ। এ গ্রন্থও দেখায় সঠিক পথ ও মুক্তির পথ, যেসব বিধান তাওরাতে এসেছে, ইঞ্জিল সেসবই সত্যায়ন করে এবং স্বয়ং হযরত ঈসা (আ.)ও তাওরাতে উল্লেখিত নিদর্শনগুলোকে সত্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহই তাঁকে পাঠিয়েছেন তোমাদেরকে সুপথ দেখানোর জন্য। তাই ইঞ্জিলে যেসব বিধি-বিধান ও উপদেশ এসেছে তা মান্য কর। যদি এসব নির্দেশ অমান্য কর তাহলে তোমরা পাপীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এখানে মনে রাখতে হবে, আল্লাহ এসব আয়াতে যে ইঞ্জিল ও তাওরাতের কথা বলছেন, তা ছিল অবিকৃত বা আদি ইঞ্জিল ও তাওরাত। আর সেসব অবিকৃত ধর্মগ্রন্থের অনুসরণ করার জন্য শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র এবং কোরআনের অনুসরণ করা জরুরি। কারণ, সেসব গ্রন্থেই বিশ্বনবী (সা.)-কে শেষ নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য আদি ও অবিকৃত ইঞ্জিল এবং তাওরাতের সাথে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত বিকৃত ইঞ্জিল ও তাওরাতের কোনো মিল নেই, তাই সেগুলো অনুসরণের যোগ্য নয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. সবগুলো ঐশী ধর্মগ্রন্থ মানুষকে সততা, পবিত্রতা ও খোদাভীরুতার দিকে আহ্বান জানিয়েছে। কারণ, কেবল সৎ মানুষই উপদেশ ও সতর্কবাণী শুনে প্রভাবিত হয়।

দুই. সবগুলো ঐশী ধর্মগ্রন্থ এবং সব নবী-রাসূলের মিশন বা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। তাই তারা পরস্পরকে সত্যায়ন করেছেন এবং তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ছিল না।

তিন. মহান আল্লাহর পাঠানো কেতাব বা ধর্মগ্রন্থগুলো কেবল তেলাওয়াতের জন্য পাঠানো হয়নি, বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্যই ধর্মগ্রন্থ পাঠানো হয়েছে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)