আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(১৫তম পর্ব)

2 বিভিন্ন মতামত 04.5 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৫১-৫৪

সূরা মায়েদার ৫১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ(৫১)

"হে মুমিনরা! তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু এবং অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু, (তোমাদের বন্ধু নয়)। তোমাদের মধ্যে যে তাদেরকে বন্ধু বা অভিভাবক বানাবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।" (৫:৫১)

কোরআন ইহকাল ও পরকালসহ মানব জীবনের সব দিকের জন্য বিধান দিয়েছে। এ মহাগ্রন্থ যে পরিপূর্ণ ওপূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ আয়াতে মহান আল্লাহ মানব সমাজের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রীতি বা সূত্র উল্লেখ করে বলছেন, মুমিনদের উচিত নয় কাফেরদের ওপর ভরসা করা বা তাদেরকে অভিভাবক বানানো, কারণ তোমরা তাদের প্রতি বন্ধুত্বের আগ্রহ দেখালেও তারা কখনও তোমাদের পছন্দ করে না, তারা কেবল সমমনা কাফেরদেরকেই ভালবাসে। আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে, কাফেরদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করার অর্থ হলো, তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হওয়া বা তাদের দলে যোগ দেয়া এবং মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস বা কুফর ও কপটতা বা নেফাকের ক্ষেত্র তৈরি করা। আর এটা নিজের ও সমাজের ওপর সবচেয়ে বড় জুলুম।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. ইসলামী দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এমন কোনো সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ নেই যা মুসলমানদের ওপর কুফরি শক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

দুই. যারা কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তারা আল্লাহর বন্ধুত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়ে এবং খোদায়ী হেদায়াত বা পথ-নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়।

তিন. আহলে কিতাব বা ইহুদি-খ্রিস্টানদের মত সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয়, যা নিষিদ্ধ তা হলো তাদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া।

 

সূরা মায়েদার ৫২ ও ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ فَعَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَى مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ (৫২) وَيَقُولُ الَّذِينَ آَمَنُوا أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ ((৫৩

"(হে নবী!) বস্তুতঃ যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে অর্থাৎ কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে তারা একে-অপরের চেয়ে বেশি অগ্রসর হয়। তারা (এ কাজের সাফাই দিতে গিয়ে) বলেঃ আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই (ফলে কাফেরদের সাহায্য আমাদের দরকার হতে পারে)। অতএব, সেদিন দূরে নয়, যেদিন আল্লাহ তা'আলা বিজয় প্রকাশ করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে মুসলমানদের অনুকূলে কোন নির্দেশ দেবেন-ফলে এইসব মোনাফেকরা তাদের গোপন মনোভাবের জন্যে অনুতপ্ত হবে।" (৫:৫২)

"মুসলমানরা বলবেঃ এরাই কি সেসব লোক, যারা আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করত যে, আমরা তোমাদের সাথে আছি? (তাদের অবস্থা কেন এ পর্যন্ত গড়াল?) তাদের কৃতকর্মগুলো বিফল হয়ে গেছে, ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে।" (৫:৫৩)

মহান আল্লাহ কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করতে বা এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে নিষেধ করেছেন যা মুসলমানদের ওপর কাফেরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও একদল দুর্বল ঈমানদার ও মোনাফেকরা কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল।

আল্লাহ বলছেন, যেদিন মুসলমানরা বিজয়ী হবে ও আল্লাহ মুমিনদেরকে অদৃশ্য সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে তাদের সম্মানিত করবেন, সেদিন তারা অনুতপ্ত হবে যারা আসলে ভয়ের কারণে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। সেদিন তারা যা গোপন রেখেছিল তা প্রকাশ হয়ে পড়বে ও তারা কলঙ্কিত হবে। মুসলমানদের বিজয় ও শক্তি প্রকাশিত হওয়ার সেই দিনে প্রকৃত মুমিনরা সবিস্ময়ে বলবেন: এই যে লোকেরা যারা মুখে মুখে ঈমানদার বলে দাবি করত এবং এ জন্য বড় বড় কসম খেত-কিভাবে তারা আজ সর্বস্বান্ত হলো? তাদের সব কাজই আজ মূল্যহীন হয়ে গেছে।

এ দুই আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার :

এক. কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার এবং তাদের নজরে পড়ার ও সাহায্য পাওয়ার ইচ্ছা নেফাক বা কপটতার ও দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।

দুই. ঈমান দুর্বল হওয়ার কারণেই অনেক মুসলমান পরাশক্তিগুলোকে ভয় পায় এবং তাদের কাছে মাথা নত করে।

তিন. রাজনৈতিক সম্মান, অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক বিজয়- এসবই আল্লাহর হাতে রয়েছে, শর্ত হলো, মুমিনদেরকে দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হতে হবে।

চার. মোনাফেকির পরিণাম হলো, সব কিছু হারিয়ে কলঙ্কিত ও লজ্জিত হওয়া।

সূরা মায়েদার ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (৫৪)

"হে মুমিনরা, তোমাদের মধ্যে যে নিজ ধর্ম থেকে ফিরে যাবে,(সে আল্লাহর কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না) অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।" (৫:৫৪)

আগের আয়াতে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে মুমিনদেরকে সতর্ক করে দেয়ার পর এ আয়াতে আল্লাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন- সাবধান, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করলে তোমরা ধর্ম থেকে বের হয়ে যাওয়া লোকদের অর্ন্তভুক্ত হবে। কিন্তু এটা ভেব না যে, নিরাপত্তার আশায় ও সাহায্য পাওয়ার আশায় তোমরা কাফেরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চললে আল্লাহর ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা এ ধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, এমন অনেকেই রয়েছেন যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানে ও ভালবাসায় এবং তাঁর ধর্ম রক্ষায় এত নিবেদিত-প্রাণ যে তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করতে ও জীবন দিতে সদা-প্রস্তুত। তারা কোনো ধরনের চোখরাঙানি ও তিরস্কারকে ভয় পায় না। আল্লাহ তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে গিয়ে বলছেন, তারা শত্রুদের মোকাবেলায় খুবই কঠোর এবং নিজেদের প্রতি দয়াদ্র ও পরস্পরের প্রতি বিনম্র। অনেক বর্ণনায় বা হাদিসে এটা এসেছে যে, এই আয়াত নাজেল হওয়ার সময় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সালমান ফারসি (রা.)'র দিকে ইশারা করে বলেছিলেন: আল্লাহ কোরআনে যে দলটির এসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন তারা তোমার স্বদেশী তথা ইরানি বা ফার্স জাতি।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার-

এক. কোনো মুমিনই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়ার ও পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়ার বিপদ থেকে মুক্ত নয়, তাই আমাদের পরিণতি যেন মঙ্গলময় হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

দুই. আল্লাহ ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এবং ভালবাসার অভাবে মানুষ সত্য ধর্মকেও পরিত্যাগ করে। ধর্ম সম্পর্কে যাদের জ্ঞান গভীর ও যথাযথ নয় তারা সব সময়ই অধঃপতন ও বিচ্যুতির মুখে থাকে।

তিন. মহান আল্লাহ কোনো ব্যাপারেই আমাদের মুখাপেক্ষি নন, আল্লাহর ধর্মকে সহায়তা দেয়া ও রক্ষার জন্য একটি দল সুদৃঢ় অবস্থায় রয়েছে।

চার. প্রকৃত মুসলমানরা অন্য মুসলমানের সঙ্গে ভদ্রতাপূর্ণ ও নম্র আচরণ করে এবং তারা পরস্পকে ভালবাসে গভীরভাবে, অন্যদিকে তারা মুসলমানদের শত্রুর ব্যাপারে খুবই কঠোর। অন্য কথায় মুসলমানদের ভালবাসা ও শত্রুতার মাত্রা আপেক্ষিক, চূড়ান্ত নয়।

পাঁচ. আল্লাহর দয়া শুধু অর্থ ও পদের মধ্যে সীমিত নয়। আল্লাহর পথে জিহাদ করা ও ধর্মের ওপর অবিচল থাকার সুযোগ পাওয়াও আল্লাহর অন্যতম মহা-অনুগ্রহ।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)