আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(১৬তম পর্ব)

1 বিভিন্ন মতামত 04.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৫৫-৫৯ (পর্ব ১৬)

সূরা মায়েদার ৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বলেছেন-

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ (৫৫) وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ ((৫৬

"(হে মুমিনগণ!) তোমাদের পৃষ্ঠপোষক বা নেতাতো আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ-যারা নামায কায়েম করে ও রুকু অবস্থায় যাকাত দেয়। (৫:৫৫)

আর যারা আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং এমন বিশ্বাসীদের নেতৃত্বকে গ্রহণ করে,তারাই (বিজয়ী হবে, কারণ) আল্লাহর দলই বিজয়ী।" (৫:৫৬)

 

বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, একবার একজন দরিদ্র ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সেখানকার মানুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। কেউ তাকে কিছু দেয়নি। সে সময় নামাজের রুকু অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ওই দরিদ্র ব্যক্তিকে নিজের হাতের আংটি খুলে দেন। তাঁর এই দানের প্রশংসা করার জন্যই এ আয়াত নাজেল হয়। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আম্মার ইয়াসির (রা.) বলেছেন: এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ আয়াত নাজেল হওয়ার পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, "মান কুনতু মাওলাহু ফাআলী মাওলাহু" অর্থাৎ "আমি যাদের অভিভাবক (মাওলা) বা নেতা আলীও তাদের নেতা"। এটা স্পষ্ট এ আয়াতে ওয়ালি বলতে বেলায়াত বা নেতৃত্বকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, শুধু বন্ধুত্ব বা ভালবাসা বোঝানো হলে তা তো সব মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত, কেবল তাদের জন্যই কেন প্রযোজ্য হবে যারা নামাজ কায়েম করে ও রুকু অবস্থায় দান করে? অনেকে বলেন, এখানে আল্লাজিনা আমানু বলতে একদল মানুষকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু আসলে সম্মানার্থে আরবী ভাষায় বহু বচন ব্যবহারের রীতি রয়েছে। কোরআনের অন্যত্রও দেখা যায় কোনো শব্দের বাহ্যিক রূপ বহু বচনে আসা সত্ত্বেও বাস্তবে কেবল এক ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য ওই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. ইসলাম একদিকে যেমন কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক না রাখার বা তাদের থেকে দূরে থাকার কথা বলে তেমনি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও বিশেষ শ্রেণীর মুমিনদের নেতৃত্ব মেনে নেয়ার কথাও বলেছে।

দুই. যারা ঈমানদার নয় এবং নামাজ আদায় করে না ও যাকাত দেয় না, অন্য বিশ্বাসীদের ওপর কর্তৃত্ব করার বা নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার তাদের নেই।

তিন. দরিদ্রদের সহায়তার জন্য নামাজও কোনো বাধা হয় না। নামাজ ও যাকাত বা দান এ আয়াতে পরস্পরের সাথে মিশে গেছে।

চার. যারা সমাজের বঞ্চিত ও ছিন্নমূলদের ব্যাপারে উদাসীন, তারা ইসলামী সমাজের নেতা হতে পারে না।

পাঁচ. মুমিনগণ যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং পবিত্র ইমামদের নেতৃত্ব বা বেলায়াত মেনে নেয়, তবে তারা অবশ্যই কাফেরদের ওপর বিজয়ী হবে।

 

সূরা মায়েদার ৫৭ ও ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (৫৭) وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ اتَّخَذُوهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْقِلُونَ ((৫৮

"হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে ও কাফেরদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও।" (৫:৫৭)

"আর যখন তোমরা নামাযের জন্যে আহবান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলা বলে মনে করে। কারণ, তারা নির্বোধ।" (৫:৫৮)

এ আয়াতে মুমিন হওয়ার দাবিদার ও দুর্বল ঈমানদারদের আবারও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব না করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের লোকরা খুবই সহজেই কাফের ও ইহুদি-খ্রিস্টানদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। তাদের বলা হচ্ছে, তোমরা কেন কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করছ? কারণ, তারা তো তোমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেয় না এবং তোমাদের ধর্মের মূল স্তম্ভ তথা নামাজকে উপহাস করে ও এ মহান এবাদতকে ক্রীড়া-কৌতুক বলে মনে করে। তারা তো তোমাদের কাছে যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরে কথা বলে না বা যুক্তি-ভিত্তিক আচরণ করে না তোমাদের সাথে। বরং অজ্ঞতার কারণেই তোমাদের এবাদত-বন্দেগীকে উপহাস করে।

এ আয়াত থেকে মনে রাখতে হবে:

এক. ঈমান বজায় রাখার শর্ত হলো, ধর্ম রক্ষার জন্য ও ধর্মের প্রেমে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকা এবং ধর্মহীন ও ধর্মকে উপহাসকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে দূরে থাকা।

দুই. ভয় ও লোভের শিকার হয়ে অনেক মানুষ কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। আমাদের উচিত কেবল আল্লাহকে ও তাঁর শাস্তিকেই ভয় করা।

তিন. কাফেররা মুসলমানদের সম্মিলিত প্রার্থনা বা নামাজের জামায়াতকে ভয় পায় এবং এ ধরনের সমাবেশকে উপহাস করে। তাই নামাজের জামায়াতকে জোরদার করতে হবে।

চার. ঠাট্টা-বিদ্রুপ জ্ঞানের বা জ্ঞানীর নিদর্শন নয়। জ্ঞানী ব্যক্তিরা যুক্তি তুলে ধরে কথা বলে।

সূরা মায়েদার ৫৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ هَلْ تَنْقِمُونَ مِنَّا إِلَّا أَنْ آَمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلُ وَأَنَّ أَكْثَرَكُمْ فَاسِقُونَ ((৫৯

"বলুনঃ হে আহলে কিতাবগণ! আমাদের সঙ্গে তোমাদের এছাড়া কি অন্য কোনো কারণে শত্রুতা যে, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের উপর অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থের প্রতি এবং পূর্বে অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থের প্রতি। আর তোমাদের বেশির ভাগই আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী নাফরমান ও ফাসেক।" (৫:৫৯)

এখানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও মুমিনদেরকে মহান আল্লাহ বলছেন: কাফেরদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মোকাবেলায় তাদেরকে বলুন যে, এ ধরনের বিশ্বাসের কারণেই কি তোমরা আমাদের সাথে ও আমাদের ধর্মের সাথে এমন অন্যায় আচরণ করছ? অথচ আমরা কেবল কোরআনই নয়, তোমাদের (অবিকৃত তাওরাত ও ইঞ্জিল) ধর্মগ্রন্থগুলোকেও বিশ্বাস করি, অন্যদিকে তোমরা নিজ ধর্মগ্রন্থও মান্য করছ না।

এ আয়াত থেকে মনে রাখতে হবে:

এক. বিরোধীদের সাথেও সৌজন্যতা বজায় রেখে ও ভদ্রভাবে সংলাপে বসতে বলে ইসলাম। এমনকি বিরোধীদের অপরাধকে সরাসরি বা উস্কানিমূলক ভাষায় উল্লেখ না করে প্রশ্নবোধকভাবে বা পরোক্ষভাবে তুলে ধরতে বলে এ ধর্ম। বিরোধীদের সাথেও সব ধরনের আচরণে ন্যায়বিচার বজায় রাখতে হবে মুসলমানদেরকে।

দুই. ইসলাম ধর্মের সত্যতার ব্যাপারে মুসলমানদের সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কাফেরদের শত্রুতার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)