আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(১৮তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৬৪-৬৬

সূরা মায়েদার ৬৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنْفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا وَأَلْقَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ

"আর ইহুদিরা বললো : আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরই হাত বন্ধ হোক। এ কথা বলার জন্য তাদের প্রতি অভিশাপ। বরং আল্লাহর (কুদরতের) দু'টি হাতই খোলা এবং তিনি যে ভাবে ইচ্ছা দান করেন। অনেক ইহুদি (এত বেশি একরোখা যে) যখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার ওপর কোন কিছু নাযিল হয় ( তার প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে) তাদের অবিশ্বাস ও ঔদ্ধত্য বেড়ে যায়। এবং আমরা (এই অবিশ্বাসের কারণে) তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছি। যখনই তারা যুদ্ধের আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেছে, আল্লাহ তা নিভিয়ে দিয়েছেন। তারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় এবং মহান আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।" (৫:৬৪)

আগের পর্বে অর্থনৈতিক,পারিবারিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে ইহুদি সমাজের অনাচার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ সম্পর্কে তাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা ও ভুল বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ইহুদিরা বিশ্বাস করতো সৃষ্টির শুরুতে আল্লাহর হাত খোলা ছিল এবং তখন মহান আল্লাহ যাকে যা খুশি দান করতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তার হাতগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং মানুষের ইচ্ছে আল্লাহর সংকল্পের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এই ভ্রান্ত ধারণা ইহুদিদের মধ্যে এত বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল যে, যখন বঞ্চিতদের দান করা কিংবা করজুল হাসানাহ বা সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার আয়াত নাযিল হয় তখন তারা বলতে থাকে, এটি আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটি প্রমাণ। যদি আল্লাহর ক্ষমতা থাকতো তবে তিনি আমাদেরকে দান করতে না বলে নিজেই দান করতেন।

মহান আল্লাহ এ ধরনের অবিশ্বাসী কথাবার্তার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, আল্লাহ'র কুদরতি হাত কখনো বন্ধ ছিল না এবং তা ভবিষ্যতেও কোনদিন বন্ধ হবে না। তিনি যাকে যতখানি খুশি দান করবেন। করজুল হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণদানে তার নির্দেশের অর্থ তাঁর হাত বন্ধ থাকা বা আল্লাহর দরিদ্র হয়ে যাওয়ার প্রমাণ নয়।

এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে, এ ভ্রান্ত ধারণার কারণে ইহুদিদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ বেড়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং তাদের ওপর হামলা চালানোরও পরিকল্পনা করে। কিন্তু ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইহুদিরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যতগুলো যুদ্ধ বাঁধিয়েছে, তার সবগুলোতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের বিজয়ী করেছেন। খাইবার যুদ্ধে ইহুদিদের পরাজয় এ ঘটনার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রমাণ।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

প্রথমতঃ আল্লাহকে সব ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির উর্দ্ধে মনে করা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। ইহুদিরা আল্লাহকে বিশ্বাস করলেও তাকে কৃপণ এবং নিরুপায় মনে করতো। কিন্তু পবিত্র কোরআন এ ভ্রান্ত ধারণার তীব্র বিরোধিতা করেছে।

দ্বিতীয়তঃ অশান্তি সৃষ্টি ও যুদ্ধ বাধানো ছিল ইহুদিদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মহান আল্লাহর অনুগ্রহে তারা কখনো শক্তি অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের সাহায্য করবেন যতক্ষণ তারা পবিত্র কোরআন ও রাসূলের সুন্নতের অনুসরণ করবে।

সূরা মায়েদার ৬৫ ও ৬৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَكَفَّرْنَا عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأَدْخَلْنَاهُمْ جَنَّاتِ النَّعِيمِ (৬৫) وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِمْ مِنْ رَبِّهِمْ لَأَكَلُوا مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ أَرْجُلِهِمْ مِنْهُمْ أُمَّةٌ مُقْتَصِدَةٌ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُونَ(৬৬)

"আর যদি আহলে-কিতাবরা (তারা ইহুদি হোক কিংবা খ্রিস্টান) বিশ্বাস স্থাপন করতো এবং খোদাভীতি অবলম্ব করতো, তবে আমি তাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দিতাম এবং তাদেরকে নেয়ামতের উদ্যানগুলোতে প্রবেশ করতে দিতাম।" (৫:৬৫)

"আর যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল এবং যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, পুরোপুরি পালন করত, তবে তারা উপর থেকে এবং পায়ের নীচ থেকে (অর্থাৎ আসমানী বরকত এবং ভূ-গর্ভের নেয়ামত) ভক্ষণ করতো। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং অবশিষ্ট বেশিরভাগ লোকই মন্দ কাজ করে যাচ্ছে।" (৫:৬৬)

এ দুই আয়াতের শেষে মহান আল্লাহ আহলে কিতাবদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলছেন, আল্লাহর পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। যদি তারা তওবা করে এবং তাদের এ অন্যায় কথা ও কাজ বন্ধ করে, তাহলে আল্লাহ তাদের অতীতের কৃতকর্ম ক্ষমা করে দেবেন এবং তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবেন। এ পৃথিবীতে তারা আকাশ ও মাটি থেকে উৎসারিত খোদায়ী নেয়ামত পেয়ে সমৃদ্ধ হবে এবং কেয়ামতেও তাদের দেয়া হবে বেহেশতের মতো অতি উত্তম নেয়ামত। এ আয়াতের শেষাংশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলছেন, অবশ্য আহলে কিতাবদের মধ্যেও ঈমানদার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা চিন্তা ও কর্মে সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত এবং সঠিক পথে আছেন। কিন্তু এদের সংখ্যা কম। বেশিরভাগ মানুষ ভুলের মধ্যে অটল রয়েছে।

এ সব আয়াতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি ইঙ্গিত করা হলেও এটা স্পষ্ট যে, এ বিপদগুলো মুসলমানদের জন্যও প্রযোজ্য। তারাও যদি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের এ ভুল পথ অনুসরণ করে তবে তাদের পরিণতিও হবে ভয়াবহ। তবে তারা যদি আল্লাহর অনুসৃত পথ অবলম্বন করে তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

প্রথমতঃ তাকওয়া বা খোদাভীতি ছাড়া ঈমান অর্থহীন। তাকওয়া ঈমানকে সব ধরনের হুমকি থেকে রক্ষা করে।

দ্বিতীয়তঃ মহান আল্লাহ গোনাহ ক্ষমা করে দেয়ার পাশাপাশি পাপী ব্যক্তির জন্য নিজের রহমতের দরজা খুলে দেন।

তৃতীয়তঃ আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং সৎকাজ পার্থিব জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির পাশাপাশি পরকালের সমৃদ্ধিও নিশ্চিত করে। ধর্ম ও পার্থিব জীবন পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তবে শর্ত হলো, পার্থিব জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মনে চলতে হবে।

এবং চতুর্থতঃ আল্লাহর কালামে পাক তেলাওয়াতই যথেষ্ট নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে কোরআনের শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)