আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(১৯তম পর্ব)

1 বিভিন্ন মতামত 05.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৬৭-৬৮

সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ

"হে রাসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ দেখান না।" (৫:৬৭)

এ আয়াত এমন একটি বিশেষ আয়াত যার কিছু বৈশিষ্টের কারণে আগের ও পরের আয়াতের সাথে এ আয়াতের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ এ আয়াত একটি স্বতন্ত্র আয়াত। এর অন্যতম প্রমাণ হলো পবিত্র এ আয়াতে ‘ইয়া আইয়ুহার রাসূল' বলে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে সম্বোধন করা হয়েছে। সমগ্র কোরআনে মাত্র দুই বার এভাবে তাঁকে সম্বোধন করেছেন মহান আল্লাহ। আর এ দুই সম্বোধনই করা হয়েছে সূরা মায়েদায়। এ আয়াতের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহর বিশেষ কোনো নির্দেশ প্রচারের জন্য রাসূল (সা.)-কে বড় ধরনের দায়িত্ব দেয়া এবং বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে তা রাসূলের (সা.) সমগ্র রেসালাতের দায়িত্বের সমান। আর এ গুরু-দায়িত্বের বিষয়টি এমনই যে বিশ্বনবী (সা.) যদি এই নির্দেশ জনগণের কাছে প্রকাশ না করেন তাহলে তিনি যেন তাঁর পরিপূর্ণ রেসালাতের কোনো দায়িত্বই পালন করলেন না। এ আয়াতের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, আয়াতটিতে এটাও বলা হয়েছে, ওই বিশেষ দায়িত্ব পালন করা বা আল্লাহর বিশেষ নির্দেশটি উম্মতের কাছে জানিয়ে দেয়ার ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) এ ভয় করছিলেন যে জনগণ এ নির্দেশটি অমান্য করতে পারে। এ ছাড়াও এই আয়াতের মধ্যে আল্লাহ রাসূল (সা.) কে অভয় দিয়ে বলেছেন, আমিই তোমাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করব।

যারা গোঁড়ামীর কারণে মহান আল্লাহর ওই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ অমান্য করতে পারে এ আয়াতের শেষাংশে তাদের প্রতি হুমকি দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন: এ ধরনের লোকেরা আল্লাহর বিশেষ হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। এখন কথা হলো, কি ছিল সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ যা জনগণের কাছে প্রচার করতে মহান আল্লাহ শেষ নবী (সা.)কে বিশেষভাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন? তিনি যেন জনগণের, বিশেষ করে মুনাফিকদের বিরোধিতাকে ভয় না পান সে ব্যাপারে আল্লাহ তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছেন এ আয়াতে। এ আয়াতটি নাজেল হয়েছিল রাসূল (সা.)'র জীবনের শেষের দিকে। তাই এটা স্পষ্ট যে আয়াতটি নামাজ, রোজা, হজ্ব বা জিহাদ কিংবা এ জাতীয় অন্য কোনো ধর্মীয় দায়িত্বের নির্দেশ সম্পর্কিত ছিল না। কারণ, এসব নির্দেশই আগের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে প্রচার ও বাস্তবায়ন করেছেন বিশ্বনবী (সা.)। একমাত্র যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা দায়িত্বটি অবশিষ্ট ছিল তা হলো, রাসূল (সা.)'র জীবন-অবসানের পর তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নির্ধারণ করা। আয়াতটি যে রাসূল (সা.)'র স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ঘোষণা দেয়া সংক্রান্ত হতে পারে তা বিখ্যাত মুফাসসির ফাখরে রাজিও মেনে নিয়েছেন। তিনি এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো তার তাফসিরে তুলে ধরেছেন।

রাসূল (সা.)'র স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল বলেই আল্লাহ এর ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছিলেন এবং রাসূল (সা.) ইসলাম-বিরোধী ও মুনাফিকদের পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্র বা বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টির আশঙ্কা করছিলেন। বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী শিয়া আলেম ও অন্য মুসলিম চিন্তাবিদরা কোরআনের আয়াতের ব্যাপারে রাসূল (সা.)'র আহলে বাইত (আ.)-এর মাধ্যমে বর্ণিত ব্যাখ্যাকে নির্ভুল মনে করেন। এসব ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ আয়াতটি আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-কে রাসূল (সা.)'র স্থলাভিষিক্ত বা খলিফা নির্ধারণের ঘোষণা সম্পর্কিত। তিনি যখন সাহাবিদের নিয়ে জীবনের শেষ হজ্ব শেষ করে ফিরে আসছিলেন তখন ‘গাদিরে খুম' নামক স্থানে হাজীদেরকে সমবেত হতে বলেন। সেখানে তিনি এক ভাষণে জানান যে, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না এবং ২৩ বছরের রেসালাতের জীবনে সবচেয়ে অনুগত সাহাবী হিসেবে আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ করেন। এ সময় শেষ নবী (সা.) বলেন যে, আমি যাদের মাওলা বা নেতা আমার পর আলীও তাদের মাওলা বা নেতা। এরপর রাসূল (সা.) বলেন, যারা এখানে উপস্থিত নেই তারা অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ খবর পৌঁছে দেবে।

তাঁর ভাষণ শেষ হওয়ার পর পরই উপস্থিত বিশিষ্ট সাহাবী ও অন্য মুমিনরা আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-কে এ মহান দায়িত্ব লাভ উপলক্ষে মোবারকবাদ বা অভিনন্দন জানান এবং তাঁকে রাসূল (সা.)'র পর নিজেদের পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করেন।

অনেকে এ ঘটনা ঘটার কথা স্বীকার করলেও রাসূল (সা.)'র উক্ত ঘোষণায় উচ্চারিত ‘মাওলা' শব্দের মাধ্যমে আলী (আ.)'র প্রতি সাধারণ ভালবাসা বা বন্ধুত্বকে বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেন। তাদের মতে, ‘মাওলা' বলতে এখানে নেতা বা অভিভাবককে বোঝানো হয়নি। অথচ এটা স্পষ্ট যে, হযরত আলী (আ.)'র প্রতি রাসূল (সা.)'র ভালবাসা ও বন্ধুত্বের ব্যাপারে কোন মুসলমানের মধ্যেই সন্দেহ ছিল না। তাই জীবন সায়াহ্নের দিকে বিশাল জনসমাবেশ ঘটিয়ে এ ধরনের বন্ধুত্বের ঘোষণা দেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। আর এ ধরনের ঘোষণাকে সাহাবীরা আলী (আ.)'র জন্য কোনো সাফল্য বলেও মনে করতে পারেন না।

এ আয়াতের অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, রাসূল (সা.) বন্ধুত্ব ও ভালবাসার চেয়েও বড় কোনো দায়িত্বের ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। আর সেটা ছিল এমন কোনো বিষয়ের বা দায়িত্বের ঘোষণা যা ছিল ভালবাসা জাতীয় আবেগ-অনুভুতির অনেক উর্ধ্বের বিষয় তথা রাসূলের (সা.) পর উম্মতের হেদায়াত ও পরিচালনার মত মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

এ আয়াত থেকে আমাদের যা মনে রাখা দরকার:

এক. ইসলামী উম্মাহর নেতৃত্বের দায়িত্ব যদি মহান আল্লাহর মাধ্যমে মনোনীত সৎ ব্যক্তিদের ওপর অর্পিত না হয় তাহলে ধর্মের মূল ভিত্তিই বিপদাপন্ন হয়।

দুই. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইসলামের চিহ্নিত শত্রু বা কাফেরদের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন না, বরং তিনি ভয় পেতেন মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রকে।

সূরা মায়েদার ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

"হে নবী! আপনি আহলে কিতাব বা ইহুদি-খ্রিস্টানদের বলে দিনঃ আল্লাহর কাছে তোমাদের কোন মর্যাদাই থাকবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা তওরাত, ইঞ্জিল এবং যে গ্রন্থ তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তাও পুরোপুরি পালন না কর। আপনার পালনকর্তার কাছ থেকে আপনার প্রতি যে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণে তাদের অনেকের অবাধ্যতা ও কুফর বৃদ্ধি পাবে। অতএব, এ কাফের সম্প্রদায়ের জন্যে দুঃখ করবেন না।" (৫:৬৮)

এ আয়াতের বিষয়বস্তুর সঙ্গে ৬৬ নম্বর আয়াতের বিষয়বস্তুর মিল রয়েছে। গত আলোচনায় আমরা ইসলাম ও ইসলামের নবী (সা.) সম্পর্কে ইহুদি-খ্রিস্টানদের অবস্থান তুলে ধরেছিলাম। এ আয়াতে আবারও একই প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে এটা জানিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্বনবী (সা.)-কে দায়িত্ব দিয়েছেন যে, হযরত ঈসা ও মুসা (আ.)'র মত নবীদের অনুসারী হওয়ার দাবিই যথেষ্ট নয়, বরং প্রকৃত ঈমানের লক্ষণ হলো, ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনে মহান আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলা।

মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানুষকে হেদায়াত বা সুপথ দেখানোর জন্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেছে একজন নবী বা রাসূল বিগত হওয়ার পর পরবর্তী নবী বা রাসূলকে অনেক মানুষ মেনে নেয়নি। এটা এক ধরনের ধর্মীয় গোড়ামি বা বর্ণবাদী মানসিকতা। তাই মহান আল্লাহ এ আয়াতে সব আসমানি কিতাব বা ঐশী ধর্মগ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস আনার ওপর জোর দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বিশ্বনবী (সা.)-কে বলছেন, আহলে কিতাব বা ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগুলোর মত ধর্মের বহু অনুসারী পবিত্র কোরআনকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এ ধরনের চিন্তা ও ধর্ম বিরোধিতা তাদেরকে কাফের বা অবিশ্বাসীতে পরিণত করছে। কারণ, তারা জেনে-শুনেই এ ধরনের পথ বেছে নিয়েছে। তাই হে নবী (সা.)! আপনি তাদের কুফরির ব্যাপারে দুঃখিত হবেন না। আল্লাহই তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের যা মনে রাখতে হবে:

এক. ঈমানদার হওয়ার দাবিই ঈমানের যথেষ্ট প্রমাণ নয়। ধর্মের বিধান অনুযায়ী অপরিহার্য কাজ বা দায়িত্বগুলোও পালন করতে হবে। আর যারা এসব কাজ ও দায়িত্ব পালন করে না প্রকৃতপক্ষে তাদের কোনো ধর্ম নেই।

দুই. আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি বা বান্দাই তত বেশি প্রিয় যে ধর্মীয় অঙ্গীকার ও বিধি-বিধান পালনে বেশি সক্রিয়। তাই সমাজেও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মানদণ্ড এটাই হওয়া উচিত।

তিন. কারও অধিকার এবং কোনো ধর্ম বা মতের ব্যাপারেই অন্ধ-বিদ্বেষ রাখা উচিত হবে না। অন্যদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার পাশাপাশি নিজের পথ বা আদর্শও তুলে ধরতে হবে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)