আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(২০তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা;(২০তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৬৯-৭১

সূরা মায়েদার ৬৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالصَّابِئُونَ وَالنَّصَارَى مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

"নিশ্চয়ই যারা মুসলমান, যারা ইহুদি, ছাবেয়ি বা খ্রিস্টান, তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহর প্রতি, কিয়ামতের প্রতি এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।" (৫:৬৯)

আগের পর্বে বলা হয়েছে যে, ঐশী কোনো দ্বীনেরই অনুসারীদের আল্লাহর দরবারে স্থান নেই যদি না তারা নিজেদের ঐশী গ্রন্থের ওপর সুস্থির অটল থাকে এবং সমাজকে তারি ভিত্তিতে গড়ে তোলে। এ আয়াতে বলা হয়েছে- কোনো ঐশী ধর্মেরই অনুসারীদের মধ্যে কেউ কারো ওপরে শ্রেষ্ঠ নন। মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং সাবেআন এমনকি প্রাচীন জনগোষ্ঠি বা জনসংখ্যার প্রাচুর্য, নবুয়্যতির ঐতিহ্য ইত্যাদি কোনো কিছুই তাদের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নয়। এখানে সাবেআন বলতে বোঝায়- হযরত ইয়াহিয়া (আ.), হযরত নূহ (আ.)দের মতো নবীরাসূলদের অনুসারীদেরকে। এদেরও কারুরই কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে হ্যাঁ, তারা যদি ঈমানদার হয় এবং সমাজে পূণ্য কাজ করার মধ্য দিয়ে তাদের আকিদা বিশ্বাসের প্রমাণ রাখে, তাহলে আল্লাহর কাছে তাদের নৈকট্য লাভের সুযোগ রয়েছে।

অবশ্য এটা স্পষ্ট যে, পরবর্তী নবীর আগমনে ঐশী ধর্মের প্রত্যেক অনুসারীর উচিত তাঁর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর শরীয়ত অনুযায়ী আমল করা। তা না হলে নতুন নবীদের নবুয়্যত অর্থহীন হয়ে যেত। সুতরাং আল্লাহর সর্বশেষ নবী যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন তাই আল্লাহর ওপর প্রকৃত ঈমান আনার জন্যে তাঁর রাসূলের ওপরও ঈমান আনা প্রয়োজন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. সকল ঐশী ধর্মেই শান্তি ও সমৃদ্ধির মানদণ্ড হলো ঈমান এবং সৎ কাজ করা, কেবল দাবী করা নয়।

দুই. মানুষের প্রকৃত প্রশান্তি কেবল আল্লাহর ওপর ঈমান এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমেই অর্জিত হয়।

সূরা মায়েদার ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَقَدْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَأَرْسَلْنَا إِلَيْهِمْ رُسُلًا كُلَّمَا جَاءَهُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَى أَنْفُسُهُمْ فَرِيقًا كَذَّبُوا وَفَرِيقًا يَقْتُلُونَ

"আমি বনী ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তাদের কাছে অনেক পয়গম্বর প্রেরণ করেছিলাম। যখনই তাদের কাছে কোনো পয়গম্বর এমন নির্দেশ নিয়ে আসতো যা তাদের মনে চাইত না, তখন তাদের অনেকের প্রতি তারা মিথ্যারোপ করতো এবং অনেককে হত্যা করে ফেলতো।" (৫:৭০)

হযরত মুসা বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের অবরোধ থেকে বের করে আনার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হলেন তাদের কাছ থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নেওয়ার জন্যে যে তারা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এবং এর ওপর অটল থাকবে। তারাও তা মেনে নেয় তবে কোরআনের অন্য আয়াতে এসেছে যে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তারা যে কেবল ঐশী হুকুমকেই পদদলিত করেছে তাই নয় বরং তারা নবী রাসূলদেরকে পর্যন্ত অপদস্থ করেছে। যেহেতু নবীগণ বনী ইসরাইলের কামনা বাসনা বা চাহিদার বিপরীত আদেশ দিতেন সেহেতু তারা নবীদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এমনকি হত্যাও করেছে।

এ আয়াতটিতে মুসলমানদের জন্যে এক ধরনের সতর্কতা রয়েছে। তাহলো নবীজীর ওফাতের পর তাঁর অসিয়্যতগুলো যেন মুসলমানরা ভুলে না যায়। সেইসঙ্গে গাদিরের প্রতিশ্রুতির ওপর যেন দৃঢ় ও অটল থাকে। এই সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত দু'বার এ বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. কাফেররা যে আল্লাহর নবীকে অস্বীকার করেছে সেটা তাদের যুক্তি কিংবা বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে নয়। তাদের এই বিরোধিতার মূল প্রোথিত ছিল নিজেদের কামনা বাসনা চরিতার্থতার মুক্ত স্বাধীনতা। ঐশী ধর্ম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে যাতে মানুষের আত্মিক পূর্ণতা ও বিকাশ ঘটে।

দুই. দুর্নীতি পরায়ন সমাজে পবিত্র ও নেক বান্দাদের আদর্শ ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় কিংবা স্বয়ং ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।

সূরা মায়েদার ৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَحَسِبُوا أَلَّا تَكُونَ فِتْنَةٌ فَعَمُوا وَصَمُّوا ثُمَّ تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ثُمَّ عَمُوا وَصَمُّوا كَثِيرٌ مِنْهُمْ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ

"তারা ধারণা করেছে যে, কোনো অনিষ্ট হবে না। ফলে তারা আরো অন্ধ ও বধির হয়ে গেল। এরপর আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করলেন। এরপরও তাদের অধিকাংশই অন্ধ ও বধির হয়ে রইল। আল্লাহ দেখেন তারা যা কিছু করেন।" (৫:৭১)

আগের পর্বে বলা হয়েছি যে, ইহুদিরা নিজেদেরকে সবোর্ত্তম প্রজন্ম বলে গর্ব করতো। সেইসাথে তারা ভাবত আল্লাহর কাছে তারাই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়। এ কারণে তারা ভেবেছিল আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করবেন না এবং যতো খারাপ কাজই করুক না কেন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না কিংবা শাস্তি দেয়া হলেও খুবই কম সময়ের জন্যে দেয়া হবে। এ রকম গর্ব অহংকার তাদেরকে অন্ধ এবং বধির করে তুলেছিল। এ কারণে তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারতো না। বুঝতো না যে তাদের জন্যেও রয়েছে পরীক্ষা এবং পুরস্কার অথবা শাস্তির ব্যবস্থা। এটা যে আল্লাহর একটা স্থায়ী রীতি তা তারা ভাবতো না। আল্লাহ ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল মানুষকেই পরীক্ষা করেন যাতে তাদের বাইরের দিকটা উন্মোচিত হয় এবং নিজের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা অসীম রহমতের অধিকারী। মানুষ একবার ভুল করলেই যে তাকে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করেন তা নয় বরং তাদের তওবা বারবার তিনি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই ঐশী সত্যতা এবং আল্লাহর আয়াতকে উপেক্ষা করেছে, যার কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঐশী দয়া ও রহমত প্রাপ্তির ক্ষেত্র তাদের জন্যে আর অবশিষ্ট থাকল না।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখবো-

এক. অকারণ সন্দেহ আর গর্ব-অহংকার মানুষকে সত্য উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত রাখে।

দুই. মানুষ যদিও আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং সৃষ্টিরাজ্যে তাঁর অস্তিত্বকে দেখতে পায় না বা মেনে নেয় না, তারপরও আল্লাহ সবসময়ই মানুষকে দেখেন।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)