আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(২১তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৭২-৭৫

সূরা মায়েদার ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَقَدْ كَفَرَ‌ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّـهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْ‌يَمَ وَقَالَ الْمَسِيحُ يَا بَنِي إِسْرَ‌ائِيلَ اعْبُدُوا اللَّـهَ رَ‌بِّي وَرَ‌بَّكُمْ إِنَّهُ مَن يُشْرِ‌كْ بِاللَّـهِ فَقَدْ حَرَّ‌مَ اللَّـهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ‌ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ‌ ﴿৭২

নিঃসন্দেহে তারা অবিশ্বাসী যারা বলে, ‘মারইয়াম-তনয় ঈসা মসীহ-ই আল্লাহ’; অথচ স্বয়ং মসীহ (এভাবে) বলেছিল, ‘হে বনী ইসরাইল! কেবল সেই আল্লাহর উপাসনা কর যিনি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক।’ (কেননা,) যে কেউ তাঁর জন্য অংশী সাব্যস্ত করবে, তার জন্য আল্লাহ বেহেশ্ত নিষিদ্ধ করেছেন; আর তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং অত্যাচারিদের কোন সাহায্যকারী নেই।  (৫:৭২)

গত কয়েকটি পর্বে আমরা ইহুদিদের চিন্তাগত ও জ্ঞানগত বিচ্যুতিগুলো সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্য জেনেছি । তারা গোড়ামির কারণে সত্যকে মেনে নেয়নি। আর এ আয়াতে মহান আল্লাহ খ্রিস্টানদের বলছেন: তোমরা কিভাবে মাসিহ বা হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র বা স্বয়ং আল্লাহ বলে মনে কর। মাসিহ কি নিজে এ ধরনের দাবি করেছেন, নাকি তোমরা ইহুদিদের মোকাবেলায় নিজ ধর্মকে বড় করে দেখানোর জন্য এ ধরনের দাবি করছ? তোমরা জেনে রাখ, মাসিহ বা হযরত ঈসা (আ.)-কে নিয়ে তোমরা যেসব অদ্ভুত কথা বলছ তা তোমাদের বিশ্বাসকে ও তোমাদেরকে অন্যদের চেয়ে বড় করছে না, বরং শির্ক বা অংশীবাদীতার মাধ্যমে কলুষিত করছে। তোমরা এর মাধ্যমে একত্ববাদ থেকে দূরে সরে গেছ এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা অর্জনের পরিবর্তে তাঁর কাছ থেকে নিজেদের বিতাড়িত করেছ। ফলে তোমরা দয়াময় আল্লাহর বেহেশত থেকে বঞ্চিত হবে এবং জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে, যে আগুন সহ্য করার ক্ষমতা কারো নেই ও সেখানে তোমরা কোনো সাহায্যকারী বা উদ্ধারকারী পাবে না।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বর্তমান যুগে প্রচলিত বাইবেলেও দেখা যায় মাসিহ বা হযরত ঈসা (আ.) তাঁর কোনো বক্তব্যেই এ দাবি করেননি যে তিনি আল্লাহর পুত্র বা অন্যতম খোদা। বরং মারকসের বাইবেলের ১২ তম অধ্যায়ের ২৯ তম বাক্যে তিনি বলেছেন: আমাদের আল্লাহ বা স্রস্টা মাত্র একজন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. বিশ্বাসে ও কাজে যেমন কোনো ঘাটতি বা কমতি গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি ধর্মের প্রধানদের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত করা বা বাড়িয়ে বলাও বৈধ নয়। কারণ, ঈমানের দাবি করা সত্ত্বেও এ ধরনের অতিরঞ্জন শির্ক ও কুফর।

দুই. কেউই পাপীদেরকে দোযখ থেকে মুক্ত করতে পারবে না। এমনকি হযরত ঈসা (আ.)ও কাউকে দোযখ থেকে মুক্ত করতে পারবেন না, তাই কেউ যেন তাকে খোদা মনে করে দোযখ থেকে মুক্তির আশা না করে।

সূরা মায়েদার ৭৩ ও ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَّقَدْ كَفَرَ‌ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّـهَ ثَالِثُ ثَلَاثَةٍ وَمَا مِنْ إِلَـٰهٍ إِلَّا إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ وَإِن لَّمْ يَنتَهُوا عَمَّا يَقُولُونَ لَيَمَسَّنَّ الَّذِينَ كَفَرُ‌وا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿৭৩﴾ أَفَلَا يَتُوبُونَ إِلَى اللَّـهِ وَيَسْتَغْفِرُ‌ونَهُ وَاللَّـهُ غَفُورٌ‌ رَّ‌حِيمٌ ﴿৭৪

"নিঃসন্দেহে তারা অবিশ্বাসী যারা বলে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তিনের মধ্যে তৃতীয়’, অথচ অদ্বিতীয় আল্লাহ ভিন্ন কোন উপাস্য নেই এবং যদি তারা যা বলে তা থেকে ফিরে না আসে, তবে তাদের মধ্যে যারা অবিশ্বাস করেছে অবশ্যই তাদের বেদনাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। (৭৩) তারা কি আল্লাহর দিকে তওবা (প্রত্যাবর্তন) করবে না এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে না; অথচ আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, অনন্ত করুণাময়।(৭৪)

আগের আয়াতে হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস তথা তাঁকে মানুষের চেয়েও বড় কোনো সত্তা ও এমনকি আল্লাহর মর্যাদায় আসীন করার পরিণতি সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। এ দুই আয়াতে বলা হচ্ছে- তাদের এ ধরনের বিশ্বাস সৃষ্টিকূলের স্রস্টা মহান আল্লাহকে তাঁর মূল মর্যাদার চেয়ে অনেক ছোটভাবে তুলে ধরছে। আল্লাহকে তিন খোদার মধ্যে অন্যতম বলে দাবি করে খ্রিস্টানরা। অথচ প্রভুত্বের বিষয়টি সৃষ্টিকর্তা থেকে পৃথক নয়। স্রস্টা যদি একজন হন, তবে উপাস্যও হবে মাত্র একজনই। খ্রিস্টানদের এ সব অদ্ভুত ও বিচ্যুত দাবির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ বলছেন, যারা নিজ বিশ্বাস সংশোধন করতে প্রস্তুত নয়, তাদেরকে আল্লাহ কঠোর শাস্তি দেবেন। আর যদি তারা তওবা করে এক আল্লাহর দিকে ফিরে আসে তাহলে তারা অবশ্যই মুক্তি পাবে ও আশ্রয় পাবে আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. কোরআন অতীতের ধর্ম ও নবী-রাসূলকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি ঐশী কিতাবগুলোর এবং নবী-রাসূলদের শিক্ষার বিকৃতির কথা তুলে ধরেছে। এভাবে কোরআন সত্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরার ও বিচ্যুত ব্যক্তিদের সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

দুই. কুফর বলতে কেবল আল্লাহকে অস্বীকার করাকেই বোঝায় না। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করাও এক ধরনের কুফর।

তিন. কেউ যদি আন্তরিক চিত্তে অনুতপ্ত হয় ও তওবা করে তবে আল্লাহ তার অতীতের সমস্ত পাপ ক্ষমা করবেন এবং তার ভবিষ্যতকেও রহমত ও দয়ার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করবেন।

সূরা মায়েদার ৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَّا الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْ‌يَمَ إِلَّا رَ‌سُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّ‌سُلُ وَأُمُّهُ صِدِّيقَةٌ كَانَا يَأْكُلَانِ الطَّعَامَ انظُرْ‌ كَيْفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ الْآيَاتِ ثُمَّ انظُرْ‌ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ ((৭৫

"মারইয়াম-তনয় মসীহ তো কেবল এক রাসূল, নিঃসন্দেহে তার পূর্বে (আরও) অনেক রাসূল অতিবাহিত হয়েছে এবং তার মাতাও সত্যবাদিনী (নারী) ছিল, তারা উভয়েই খাদ্য গ্রহণ করত। দেখ, আমরা বিধানসমূহকে তাদের জন্য কীভাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছি; এবং আরও দেখ, তাদেরকে কীভাবে (সত্য থেকে) ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। " (৫:৭৫)

মহান আল্লাহ ও হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে খ্রিস্টানদের বিচ্যুত চিন্তাধারা তুলে ধরার পর কোরআন এ আয়াতে তিনটি প্রমাণ তুলে ধরে বলছে যে, ঈসা মাসিহ আল্লাহ নন। কারণ, তিনি মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছেন, অথচ আল্লাহ তো জন্ম নেন না। দ্বিতীয়ত: অতীতের নবীদের মধ্য থেকে আদম (আ.)-কেও ব্যতিক্রমী নিয়মে সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ। হযরত ঈসা (আ.)'র মা ছিলেন, কিন্তু হযরত আদম (আ.) মা ও বাবা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ তাকে আল্লাহ মনে করত না। তৃতীয়ত: তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া হলো হযরত ঈসা (আ.) জন্মের পর আল্লাহয় পরিণত হয়েছেন, আল্লাহ হওয়ার পরও কেন তিনি ও তাঁর মা মানুষের মত খাবার খেতেন? কেন তাঁরা খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন? খোদা কি ক্ষুধার্ত হন? তোমাদের খোদা কেমন অদ্ভুত ও খাদ্য-নির্ভর?

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. কোনো কোনো বিশেষ ব্যতিক্রম বা বিশেষ ক্ষমতা আল্লাহ হওয়ার প্রমাণ নয়। নবী. রাসূলদের মোজেজাও তাঁদেরকে আল্লাহর মর্যাদায় উন্নীত করে না।

দুই. সত্য বলা ও সৎ আচরণ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবীয় মূল্যবোধ। আল্লাহ হযরত মরিয়ম (সা.)কে এসব গুণের জন্যই সিদ্দিকা বলে সম্মানিত করেছেন। তিন. হযরত মরিয়ম (সা.) ও তাঁর পুত্র হযরত ঈসা (আ.)-উভয়ই ছিলেন মানুষ, যদিও তাঁরা ছিলেন অনেক উচ্চ মর্যাদার অধিকারী।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)