আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(২৪তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৮৪-৮৮

সূরা মায়েদার ৮৪, ৮৫ এবং ৮৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا لَنَا لَا نُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَمَا جَاءَنَا مِنَ الْحَقِّ وَنَطْمَعُ أَنْ يُدْخِلَنَا رَبُّنَا مَعَ الْقَوْمِ الصَّالِحِينَ (৮৪) فَأَثَابَهُمُ اللَّهُ بِمَا قَالُوا جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الْمُحْسِنِينَ (৮৫) وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ ((৮৬

"আমাদের কি ওজর থাকতে পারে যে, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে, তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব না এবং এ আশা করবো না যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎ লোকদের সাথে প্রবিষ্ট করবেন?" (৫:৮৪)

"অতপর তাদেরকে আল্লাহ এ উক্তির প্রতিদানস্বরূপ এমন উদ্যান দেবেন যার তলদেশে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হবে। তারা তন্মধ্যে চিরকাল অবস্থান করবে। এটাই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান।" (৫:৮৫)

"যারা কাফের হয়েছে এবং আমার নিদর্শনাবলিকে মিথ্যা বলেছে তারাই দোযখি।" (৫:৮৬)

গত পর্বে বলা হয়েছে, খ্রিস্টানদের একটি দল সূরা মারিয়ামের আয়াতগুলো শুনে আনন্দাশ্রু ফেললো এবং কোরআনের সত্যতার পক্ষে সাক্ষী দেয়। এ আয়াতগুলোতে আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছেঃ তাঁরা কোরআনের এতো বেশি অনুরাগী হয়ে পড়েছে যে নিজেরাই বলাবলি করছিলোঃ কেন আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এই সত্য ও সঠিক কালামের প্রতি ঈমান আনবো না? আমরা কি নেককার পূন্যবানদের সাথে বেহেশতে প্রবেশ করার ব্যাপারে আশাবাদী নই? আল্লাহও এই আয়াতগুলোতে এ ধরনের বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তিকে চিরন্তন বেহেশতে প্রবেশ করার পুরস্কার বলে উল্লেখ করেছেন, যে স্থানটি পূণ্যবানদের জন্যে এবং তাদের ছাড়া সেখানে অন্য কারো প্রবেশ করার কোনো পথ নেই।

আয়াতটিতে আরো বলা হয়েছেঃ অবশ্য একদল আবার এই সত্যকে মেনে নিতে রাজি ছিলো না, তারা সত্যকে অস্বীকার করলো, তাই তাদের স্থান হলো দোযখ। এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. মানুষ যখন সত্যকে চিনতেই পারলো, তখন আর তাকে অস্বীকার করার বা প্রত্যাখ্যান করার কোনো ওজর-আপত্তি খাটে না।

দুই. আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস ওহির প্রতি ঈমান থেকে আলাদা নয়। সৃষ্টির হেদায়েতের চিন্তা যে খোদা করে না তাকে গ্রহণ করাটা অর্থহীন।

তিন. আত্মজিজ্ঞাসা হলো সত্যকে উপলব্ধি করা এবং পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হবার উপায়। আল্লাহও এ ধরনের লোকের প্রশংসা করেন।

সূরা মায়েদার ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

"হে মুমিনগণ! তোমরা ঐসব সুস্বাদু বস্তু হারাম করো না, যেগুলো আল্লাহ তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন এবং সীমা অতিক্রম করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না।" (৫:৮৭)

ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছেঃ একদিন হযরত মুহাম্মাদ (সা) জনগণের উদ্দেশ্যে কিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছিলেন। মানুষ রাসূলে খোদার বর্ণনা শুনে এতো বেশি আলোড়িত হলো এবং কান্নাকাটি করলো যে, সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলো ভালো খাবার দাবার ছেড়ে দেবে, আরাম আয়েশ নিজের সুখ শান্তিকে হারাম করে ফেলবে, রাতগুলোকে ইবাদাত বন্দেগীর মধ্যদিয়ে কাটাবে, দিনের বেলা রোযা রাখবে, দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী সঙ্গ ত্যাগ করবে এমনকি এই সিদ্ধান্তের ওপর তারা স্থির অবিচল থাকবে বলে শপথও নিয়েছিলো। নবীজী এই খবর শুনতে পেয়ে লোকজনকে মসজিদে সমবেত করে বললেনঃ আমাদের দ্বীন ইসলাম সংসারত্যাগী বৈরাগ্যদের দ্বীন নয়। আমি আল্লাহর রাসূল হবার পরও ঘর এবং পরিবারের কাছ থেকে পৃথক হই নি। তাদের সাথে কাবার খাই, আমার স্ত্রীদের সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করি। জেনে রেখো, যে আমার পদ্ধতির বাইরে যাবে সে মুসলমান নয়।

এ আয়াতে জীবনের ভারসাম্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তোমাদের ওপর যা কিছু হারাম করেছেন, সেগুলো করা জায়েজ নয়। আবার যেসব বিষয় তোমাদের ওপর হালাল করা হয়েছে সেগুলোকে হারাম করাও জায়েজ নয়। মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধের প্রতি আত্মসমর্পিত এবং আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমার মধ্যেই পদচারণা করে। না তার চেয়ে অগ্রবর্তী হবে না পশ্চাৎবর্তী। মানুষ যে হালালকে নিজেদের জন্যে হারাম করে নিচ্ছে, তা এক ধরনের আগ্রাসন এবং ঐশী সীমা লঙ্ঘনের শামিল। এ আচরণ ঈমানের আত্মার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. খাদ্য সামগ্রী, পানীয় সামগ্রী এবং হালাল ভোগ্যবস্তুগুলোকে আল্লাহ মুমিনদের জন্যে দিয়েছেন, তাই এগুলোকে পরিত্যাগ করা ঐশী রহমত ও দয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতার শামিল।

দুই. ইসলাম মানব স্বভাবসিদ্ধ একটি ধর্ম, তাই পবিত্র জিনিসগুলোকে ত্যাগ করা মানব স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ণয়।

তিন. ইসলামে সবধরনের উগ্রতা নিষিদ্ধ, এ দু'টি আচরণই ঐশী সীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে- হালালকে হারাম করা যেমন জায়েজ নয় তেমনি হারামকে হালাল করা জায়েজ নয়। এইসব বিধান আল্লাহর হাতে, মানুষের হাতে নয়।

চার. হালাল বস্তুগুলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। সেইসাথে হালাল বস্তুগুলো থেকে উপকৃত হবার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি কিংবা অপচয় করাটাও উচিত নয়।

সূরা মায়েদার ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي أَنْتُمْ بِهِ مُؤْمِنُونَ

"আল্লাহ তায়ালা যেসব বস্তু তোমাদেরকে দিয়েছেন, তন্মধ্য থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তু খাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, যার প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।" (৫:৮৮)

আগের আয়াতে মানুষকে পার্থিব জগতের হালাল ভোগ্যবস্তু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ আয়াতে হালাল এবং পবিত্র বিষয়গুলো ব্যবহার করার আদেশ দিয়ে বলা হচ্ছেঃ ভেবো না পার্থিব জগতের কল্যাণগুলোকে কাজে লাগানো অপছন্দনীয় কিংবা নিন্দনীয় কোনো কাজ, বরং পার্থিব জগতের সকল নিয়ামতই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্যে দেয়া রিযিক। তিনিই এগুলো তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তোমরা এসব সুযোগ সুবিধাকে নিজেদের কল্যাণে ব্যবহার করবে-এটাই সঙ্গত।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো- এসব কল্যাণময় নিয়ামতকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ন্যায়, ভারসাম্য এবং তাকওয়ার মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। কোরআনের অপর আয়াতেও আল্লাহ বলেছেন খাও এবং পান করো, তবে অপচয় করো না। আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ খাও এবং যথার্থ কাজ করো, খাও এবং অন্যদেরকেও খাওয়াও।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ

এক. পার্থিব সুযোগ-সুবিধাগুলো অর্থাৎ ঐশী নিয়ামতগুলো থেকে উপকৃত হবার ক্ষেত্রে ঈমানদার এবং তাকওয়ার মানদণ্ড মেনে চলাটা জরুরি।

দুই. তাকওয়া মানে পৃথিবী অর্থাৎ পার্থিব জগতকে উপেক্ষা করা নয় বরং পার্থিব জগতকে যথার্থভাবে ব্যবহার করতে হবে পরকালীন কল্যাণের জন্যে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)