আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(২৬তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৯২-৯৪

সূরা মায়েদার ৯২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَاحْذَرُوا فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ

"তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রাসূলের অনুগত হও এবং (আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা থেকে) বিরত থাকো। কিন্তু যদি তোমরা বিমুখ হও (এবং অবাধ্যতা করো), তবে জেনে রাখ, আমাদের রাসূলের দায়িত্ব প্রকাশ্যে (আমার বাণী) প্রচার ছাড়া অন্য কিছু নয়।" (৫:৯২)

এ সূরার আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, মহান আল্লাহ মানুষকে মদ পান ও জুয়া খেলা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর এ সব নির্দেশ তোমাদেরই স্বার্থ রক্ষা করছে বলে তোমাদের মেনে চলা উচিত এবং এ সব পাপকাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। তোমাদের এ কথা ভাবা উচিত নয়, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তোমরা তাঁর বা তাঁর রাসূলের কোন ক্ষতি করতে পারবে। রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধুমাত্র আল্লাহর বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। তোমরা যদি আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলো তাতে যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.)'র কোন লাভ নেই, তেমনি এ নির্দেশ অমান্য করলেও তাঁর কোন ক্ষতি হবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

এক. নবী-রাসূলদের কাজ হচ্ছে, আল্লাহর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া; মানুষকে এ বার্তা মানতে বাধ্য করা নয়। তাঁরা মানুষকে সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করেছেন। তবে এ সত্য গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

দুই. রাসূলকে অনুসরণের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহর আনুগত্য করতে পারি। এ কারণে, পবিত্র কোরআনের দিক-নির্দেশনা মেনে চলার পাশাপাশি রাসূলের সুন্নতেরও অনুসরণ করতে হবে।

সূরা মায়েদার ৯৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَآَمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوْا وَأَحْسَنُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

"যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তারা (মদপান নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে) যা খেয়েছে, সে জন্য তাদের কোন গোনাহ নেই। যেহেতু তারা যখন ভবিষ্যতের জন্য সংযত হয়, বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, (নিষিদ্ধ বস্তু থেকে) বিরত থাকে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে; এরপর (খারাপ কাজ থেকে) বিরত থাকে এবং সৎকাজ করে। আল্লাহ সৎ কর্মশীলদের ভালোবাসেন।" (৫:৯৩)

হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, মদপান নিষিদ্ধের আয়াত নাজিল হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে যারা আগে মদপান করতেন তাদের ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে। এ সময় বিশ্বনবী (সাঃ) বলেন, আয়াত নাযিলের আগে যারা মদপান করেছেন, তাদের কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তবে তারা যেন এখন থেকে মদপান না করেন বা জুয়া না খেলেন। এর পরিবর্তে তাদেরকে সৎকাজ করতে হবে এবং এ পথে অটল থাকতে হবে।

এ আয়াতে ঈমান ও তাকওয়া শব্দ দু'টি তিনবার করে ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকে মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে ঈমান ও তাকওয়ার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জনের শর্ত হচ্ছে, মনেপ্রাণে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং কাজে-কর্মে তাকওয়া বা খোদাভীতি অবলম্বন করা।

এ আয়াতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-

এক. পরোপকারের মাধ্যমে মানুষের শক্তিশালী ঈমানী চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া, পরোপকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

দুই. শুধুমাত্র ঈমান যথেষ্ট নয়- এর সঙ্গে আমলও প্রয়োজন। তবে সে আমল হতে হবে নেক বা সৎ এবং সব ধরনের মন্দ ও খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।

তিন. মৌসুমি বা ক্ষণস্থায়ী ঈমানের কোন কার্যকারিতা নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈমানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরী।

সূরা মায়েদার ৯৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَيَبْلُوَنَّكُمُ اللَّهُ بِشَيْءٍ مِنَ الصَّيْدِ تَنَالُهُ أَيْدِيكُمْ وَرِمَاحُكُمْ لِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَخَافُهُ بِالْغَيْبِ فَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ

"হে মুমিনগণ, আল্লাহ তোমাদেরকে এমন কিছু শিকারের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন, যে শিকার পর্যন্ত তোমাদের হাত ও বর্শা সহজেই পৌঁছাতে পারে- যাতে আল্লাহ বুঝতে পারেন যে, কে তাকে অদৃশ্যভাবেও ভয় করে (এবং তার নির্দেশ মেনে চলে)। সুতরাং, যে ব্যক্তি এরপর সীমা লঙ্ঘন করবে, তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।" (৫:৯৪)

এ আয়াতের পাশাপাশি পরবর্তী আয়াতগুলোতে পবিত্র হজ্বব্রত পালন এবং যে ব্যক্তি এ মহান ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করবেন তার প্রতি উপদেশ রয়েছে। হজ্ব পালনকারী ব্যক্তি বা হাজী ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকার করতে পারবেন না। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- অনেক সময় মশা-মাছির মতো কিছু প্রাণী মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে চলে আসে, যাদেরকে অনিচ্ছাকৃতভাবে অভ্যাসের বশে মানুষ মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু ইহরাম বাঁধা অবস্থায় কোনভাবেই কোন প্রাণী হত্যা করা যাবে না। এর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে অদ্ভুত এক পরীক্ষা করতে চান। তিনি দেখতে চান, কে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আর কে প্রবৃত্তির তাড়নায় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

পবিত্র কোরআনের অন্য অনেক জায়গায় আল্লাহ মানুষের ঈমানের পরীক্ষা নেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আদি পিতা হযরত আদম ও মা হাওয়ার ঘটনা। দুঃখজনকভাবে তাঁরা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি এবং নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেলেছিলেন।

অবশ্য মহান আল্লাহ তার গায়েবি জ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের সব কার্যকলাপ সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত রয়েছেন। কাজেই আমাদের মানসিকতা বোঝার জন্য কিংবা আমাদের কর্ম সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তার পরীক্ষা নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো এবং আমরা যাতে নিজেদেরকে চিনতে পারি ও সীমা লঙ্ঘন না করি- সে লক্ষ্যে তিনি আমাদের পরীক্ষা করেন। সেইসঙ্গে প্রতিটি পরীক্ষার বিপরীতে মহান আল্লাহ আমাদের জন্য পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পুরস্কার, এর উল্টোটা হলে শাস্তি।

যাই হোক, মুমিন ব্যক্তিরা দাবি করেন, তারা আল্লাহর নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করেন। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা খোদায়ী পরীক্ষার সম্মুখীন হন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের এ দাবি পরিমাপ করা সম্ভব নয়। যদি আল্লাহর নির্দেশ আমার মনোবাসনার বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও আমি মেনে নেই, কেবলমাত্র তখনই প্রমাণ হবে আমি আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করেছি। মদপানসহ আল্লাহর নির্দেশিত গোনাহ'র কাজগুলো থেকে দূরে থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং, যদি প্রয়োজন হয় তবে অনেক সময় হালাল বস্তু থেকেও দূরে থাকতে হবে। এবং কেবল সেক্ষেত্রেই প্রমাণ হবে আমরা প্রকৃত ঈমানদার এবং আমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করেছি। আমাদের পক্ষে কুপ্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা পরিহার করা সম্ভব হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

এক. সব মানুষকে আল্লাহ জীবনের কোন না কোন সময় পরীক্ষা করবেনই। এ পরীক্ষা তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য যারা মু'মিন ও নিজেদের ঈমানদার বলে দাবি করেন।

দুই. তাকওয়া ও ঈমান প্রদর্শনের বস্তু নয়- এটি অন্তরের বিষয়। মানুষের ভয়ে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং ঈমানদার ব্যক্তি প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সব সময় আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলেন।

তিন. হজ্বের সময় মহান আল্লাহ মানুষের জন্য স্বাভাবিক সময়ের অনেক হালাল কাজ হারাম করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তার বান্দাকে পরীক্ষা করার পাশাপাশি বান্দা যাতে কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের ঈমান রক্ষা করতে পারে তার অনুশীলন করিয়ে নেন। 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)