আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল মায়েদা;(২৭তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৯৫-৯৭

সূরা মায়েদার ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَقْتُلُوا الصَّيْدَ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ وَمَنْ قَتَلَهُ مِنْكُمْ مُتَعَمِّدًا فَجَزَاءٌ مِثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ يَحْكُمُ بِهِ ذَوَا عَدْلٍ مِنْكُمْ هَدْيًا بَالِغَ الْكَعْبَةِ أَوْ كَفَّارَةٌ طَعَامُ مَسَاكِينَ أَوْ عَدْلُ ذَلِكَ صِيَامًا لِيَذُوقَ وَبَالَ أَمْرِهِ عَفَا اللَّهُ عَمَّا سَلَفَ وَمَنْ عَادَ فَيَنْتَقِمُ اللَّهُ مِنْهُ وَاللَّهُ عَزِيزٌ ذُو انْتِقَامٍ

"হে মু‘মিনগণ! তোমরা হজ্জ ও ওমরাহ্‌র এহ্‌রামে থাকা অবস্থায় শিকার বধ করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তা বধ করে ফেলেছে, তার বিনিময় বা কাফফারা হচ্ছে অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু যা সে বধ করেছে, তোমাদের মধ্যে দুজন ন্যায়বান লোক এর সাক্ষী দেবে যে (জন্তুটি তার অনুরূপ)- এই কোরবানী হাদিয়াস্বরূপ, তা কাবায় পৌঁছাতে হবে। অথবা তার কাফ্‌ফারা হবে কোরবানীর পরিবর্তে দরিদ্রকে খাদ্য দান করা কিংবা সমসংখ্যক রোযা রাখা যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। আল্লাহ্‌ (এ সংক্রান্ত) তোমাদের বিগত কৃতকর্ম ক্ষমা করেছেন, কিন্তু যে কেউ তা পুনরাবৃত্তি করবে আল্লাহ্‌ তার থেকে প্রতিশোধ নিবেন (অর্থাৎ কঠোর শাস্তি দিবেন)। আর আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণে পূর্ণরূপে সক্ষম।" (৫:৯৫)

আগের পর্বে বলা হয়েছিল- যারা হজ্ব করতে যায় আল্লাহ পাক তাদের জন্যে কিছু বিধি নিষেধ বেঁধে দিয়েছেন তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্যে। এসব বিধি নিষেধের মধ্যে রয়েছে এহরাম বাঁধা অবস্থায় পশু শিকার করা হারাম। এ আয়াতে আল্লাহর এই নিষেধাজ্ঞার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে, যারা এই হুকুম অমান্য করে শিকার করবে এবং এই আদেশের প্রতি অসম্মান দেখাবে তাদেরকে এ কাজের শাস্তিস্বরূপ কাফফারা দিতে হবে। কাফফারাটি হলো যে জন্তুটি শিকার করা হয়েছে ঠিক সে রকম আরেকটি পশু আল্লাহর ঘরের কাছে কোরবানী করতে হবে-যাতে গরিবেরা এই কোরবানীর গোশত উপভোগ করতে পারে। যদি ঐ শিকারীর পক্ষে কোরবানী করার মতো অবস্থা না থাকে তাহলে গোশতের পরিবর্তে মিসকিনদেরকে খাবার দিতে হবে, কমপক্ষে ৬০ জন ফকিরকে পেট ভরে খেতে দিতে হবে। যদি আর্থিক সমস্যার কারণে ৬০ জন ফকিরকে খাওয়ানো সম্ভব না হয় তাহলে কমপক্ষে ৬০ দিন রোযা রাখতে হবে যাতে ক্ষুধার্তদের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে এবং নোংরা কাজের শাস্তি ভোগ করতে পারে।

এ আয়াত থেকে আমাদের শিক্ষণীয় হলোঃ

এক. এহরাম অবস্থায় কেবল মানুষজনই নয় বরং জন্তু জানোয়ারেরও প্রকৃত অর্থেই নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে।

দুই. ভুলক্রমে নীতিবিরুদ্ধ কাজ করার চেয়ে ভয়াবহ হলো জেনে শুনে সচেতনভাবে ঐশী বিধান লঙ্ঘন করা। সেজন্যে তার অপরাধটি যেমন গুরুতর বলে বিবেচিত হয় তার শাস্তিও তাই কঠোরতরো হয়।

তিন. ইসলামী শাস্তির বিধি-বিধানে সাধারণত আর্থিক জরিমানা করা হয় অসহায়-বঞ্চিত গরিবদের সহযোগিতার জন্যে। এটা মানব রচিত আইনের বিপরীত, কেননা মানবীয় আইনে আর্থিক জরিমানাগুলো সরকারী কোষাগারে চলে যায়।

এ সূরার ৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ الْبَحْرِ وَطَعَامُهُ مَتَاعًا لَكُمْ وَلِلسَّيَّارَةِ وَحُرِّمَ عَلَيْكُمْ صَيْدُ الْبَرِّ مَا دُمْتُمْ حُرُمًا وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

"অবশ্য এহরাম অবস্থায় সমুদ্রের শিকার ও তা ভক্ষণ করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে-এটা তোমাদের ও ভ্রমণকারীদের জন্যে পাথেয়, কিন্তু তোমরা যতক্ষণ এহ্‌রাম অবস্থায় থাক ততক্ষণ স্থলজ শিকার তোমাদের জন্য হারাম। আর তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর, তাঁরই দিকে তোমাদের একত্রিত করা হবে।" (৫:৯৬)

পূর্ববর্তী আয়াতে স্থলজ পশু শিকার করা হারাম ঘোষণা করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছেঃ অবশ্য আল্লাহ সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করা এবং সেগুলো খাওয়া তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন। এমন নয় যে, সকল পথ তোমাদের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং কোনোরকম খাবার-দাবারেরও অনুমতি দেয়া হয়নি। মূলতঃ এ ধরনের ঐশী আদেশ মানুষের তাকওয়ার পরিমাণ পরিমাপ করার জন্যে এক ধরনের পরীক্ষাস্বরূপ। যাতে আল্লাহর আদেশের প্রতি কতটুকু আনুগত্য আছে আর ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা বা ব্যক্তিগত চাহিদা চরিতার্থ করার প্রতি কতোটুকু লিপ্সা তা নির্ধারণ করা যায়। এ কারণেই আল্লাহ একটি পথ বন্ধ করে আরেকটি পথ খুলে দিয়েছেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের শিক্ষণীয় হলোঃ

এক. সামুদ্রিক সম্পদগুলো কেবল উপকূলবাসীদের জন্যে নির্দিষ্ট নয় বরং সেগুলো ব্যবহার করার অধিকার সবার।

দুই. শিকার তখনই জায়েয যখন তা খাবারের জন্যে করা হয়, শিকার বিনোদনের জন্যে নয় যে একটি প্রাণী হত্যা করে মজা লুটবে।

তিন. কিয়ামতের কথা স্মরণ রাখা এবং আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবার কথা মনে রাখাটা মানুষের পক্ষে গুনাহ এবং নাফরমানী থেকে বিরত থাকার উপায়।

এ সূরার ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

جَعَلَ اللَّهُ الْكَعْبَةَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ قِيَامًا لِلنَّاسِ وَالشَّهْرَ الْحَرَامَ وَالْهَدْيَ وَالْقَلَائِدَ ذَلِكَ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

"আল্লাহ্ বায়তুল হারাম বা সম্মানিত গৃহ কা'বা কে মানুষের জন্য কল্যাণ ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার উপকরণ বানিয়েছেন; একইভাবে পবিত্র মাস, কোরবানীর জন্তু ও মানতের উদ্দেশ্যে গলায় মালা পরানো পশুসমূহও এর অর্ন্তভূক্ত। এসব এজন্য যে, তোমরা যেন জানতে পার, যা কিছু আস্‌মান ও যমীনে রয়েছে আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে অবহিত এবং আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।" (৫:৯৭)

আগের আয়াতে হজ্বের কিছু বিধি বিধান বর্ণনা করার পর এ আয়াতে হজ্বের কেন্দ্রীয় আমল তথা কাবা ঘর এবং এই ঘরের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছেঃ আল্লাহ পাক এই ঘরকে ঐক্য, ইবাদাত, মারেফাত ও নিরাপত্তার কেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করেছেন। কাবা হলো এমন একটি ঘর যার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা সবসময়ের জন্যেই জরুরি। বিশেষ করে হজ্বের সময়-যা সম্মানিত মাসগুলোর মধ্যে পড়েছে, যে সময় যে-কোনো রকমের যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি নিষেধ এমনকি হজ্বে কোরবানীর জন্যে নির্দিষ্ট কিংবা অনির্দিষ্ট পশুগুলোর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। কোনো রকম বিশেষ সুবিধা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া এবং মৌখিক কিংবা সশস্ত্র কোনোরকম বিবাদ ছাড়া আল্লাহর ঘরের পাশে মিলিয়ন মিলিয়ন হজ্বযাত্রীর সমাবেশ-তাও আবার সম্মানীত মাসগুলোতে-এটা সত্যিই ইসলামের অসামান্য কৃতিত্ব। তাছাড়া হজ্বের কর্মসূচিগুলোও প্রমাণ করে যে, হজ্ব আল্লাহর অসীম জ্ঞান থেকেই উদ্ভুত। আল্লাহ সৃষ্টির সকল বস্তুর ব্যাপারে জানেন। তিনি ছাড়া মানুষের সীমিত জ্ঞান কখনোই বিশাল এবং চমৎকার এই সমাবেশের জন্যে আদেশ জারি করতে সক্ষম নয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ

এক. ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো কোনো স্থান এবং কাল সম্মান এবং মর্যাদার অধিকারী। সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া সমাজের স্থিতিশীলতার উৎস।

দুই. মসজিদ এবং জবাইয়ের স্থান-ইবাদত ও জীবনযাত্রার এই দু'টি উপকরণ মানুষের দ্বীন আর দুনিয়াবি কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধানকারী। আল্লাহ পাক হজ্বের মৌসুমে এ দুটোকেই পাশাপাশি স্থান দিয়েছেন।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)