আল হাসানাইন (আ.)

গীবত

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

জিহ্বার দ্বারা যে সব কঠিন পাপ কাজ সংঘটিত হয় তার অন্যতম হল গীবত। গীবত করার ফলে মানুষের অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা আল্লাহর ক্ষমা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গীবত হল কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়। এ আলোচনা অপরের দৈহিক ত্রুটি,বংশগত ত্রুটি,চারিত্রিক ত্রুটি অথবা কথা,কাজ,পোশাক-পরিচ্ছদের ত্রুটি সম্পর্কিত হলেও তা গীবত বলে পরিগণিত হবে। এমনকি কোন ব্যক্তির গৃহ বা গৃহের আসবাবপত্রের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা হলে তাও গীবত বলে গণ্য হবে।

মহানবী (সা.) একদিন তাঁর সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন : ‘তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে?’ সাহাবীরা বললেন : ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশি জানেন।’ তিনি বললেন : ‘তোমার ভাইয়ের এমন আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে।’ সাহাবীরা বললেন : ‘যে বিষয়ে আলোচনা করা হয় তা যদি তার মধ্যে থাকে? তিনি বললেন :‘সে বিষয় তার মধ্যে থাকলেই তো গীবত। না থাকলে তা আরও বড় অন্যায়;অর্থাৎ অপবাদ হবে।’

গীবত কেবল মৌখিকভাবে সংঘটিত হয় তা নয়;বরং ইশারা-ইঙ্গিত বা অনুকরণের মাধ্যমেও গীবত হতে পারে। হযরত আয়েশা বলেন : ‘একবার এক মহিলা আগমন করল। সে যখন চলে গেল,তখন আমি হাতে ইশারা করে প্রকাশ করলাম,সে বেঁটে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : তুমি তার গীবত করেছ।’

পবিত্র কুরআনে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করা হয়েছে :

وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ

‘এবং তোমাদের কেউ যেন কারও গীবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা অপছন্দ কর।’

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

‘তোমরা গীবত থেকে বেঁচে থাক। কেননা,গীবত যিনার চেয়েও কঠিন।’

এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে,যিনা করে মানুষ তওবা করলে আল্লাহ তা‘আলাতওবা কবুল করে নেন,কিন্তু গীবতকারীকে ক্ষমা করা হয় না,যতক্ষণ যার গীবত করা হয় সে ক্ষমা না করে।

অন্যদিকে গীবতের সামাজিক ক্ষতির দিকটিও ব্যাপক। কারণ,গীবতের মাধ্যমে এক মানুষ অপর মানুষের প্রকাশ্য নিন্দা করে এবং এতে সমাজে ফিতনার সৃষ্টি হয়।

গীবতের কারণ

১. ক্রোধ : ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কারও গীবত করা হয়।

২. অন্যদের অনুসরণ : অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা অপরের কথার সাথে কথা মিলিয়ে গীবত করা হয়। এক্ষেত্রে মনে করা হয় যে,সামাজিকতার খাতিরে যদি সে অন্য কারও কথায় সায় না দেয় তবে তাকে অসামাজিক বলে চিহ্নিত করা হবে।

৩. পূর্ব সতর্কতা : পূর্ব সতর্কতার কারণে গীবত করা হয়। যদি কেউ মনে করে যে তার বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্য দেবে,তখন সে পূর্ব থেকেই ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকে যাতে তার কথার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।

৪. চিত্তের প্রশান্তি : নিজের দোষকে হালকা করা বা নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যও গীবত করা হয় এভাবে যে,এ কাজটি কেবল আমিই করিনি,আমার সাথে অন্যরাও ছিল।

৫. গর্ব ও অহংকার : গর্ব ও অহংকারের কারণে গীবত করা হয়। নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় বলে জাহির করার জন্য অন্য ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা হয়।

৬. হিংসা : হিংসার কারণেও গীবত করা হয়। যখন এক ব্যক্তির সামনে অপর ব্যক্তির প্রশংসা করা হয় তখন সে ঐ ব্যক্তির প্রতি হিংসার কারণে গীবত করে।

৭. ক্রীড়া-কৌতুক : অনেক সময় ক্রীড়া-কৌতুকের বশবর্তী হয়ে গীবত করা হয়। এতে অপরের দোষ বর্ণনা করে নিজে হাসা এবং অপরকে হাসানো লক্ষ্য থাকে।

৮. সহমর্মিতা প্রকাশ : কখনও কখনও অন্যের প্রতি সমবেদনা জানাতে গিয়ে গীবত করে। যেমন বলে যে,অমুকের জন্য আমার কষ্ট হয়। কারণ,সে খুবই হতভাগ্য,সে যদি অমুক কাজটি না করত তাহলে সে এতটা দুর্ভাগা হত না।

 

গীবতের পারলৌকিক পরিণাম

১. একটি হাদীসে বলা হয়েছে : ‘যার নিকট কোন মুমিনকে অপদস্থ করা হয় এবং সাহায্য করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সে সাহায্য না করে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন সকলের সামনে তাকে অপদস্থ করবেন।’

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে : যে ব্যক্তি স্বীয় মুমিন ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার মান-সম্মানের প্রতিরক্ষা করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার মান-সম্মান রক্ষা করাকে নিজের ওপর ওয়াজীব মনে করেন।’

২. কোন ব্যক্তি যদি অপর কোন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে তবে আল্লাহ্ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।

৩. গীবতকারীর সৎ আমলগুলোকে মুছে দেয়া হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন :‘কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত করা হবে এবং তার আমলনামা তার হাতে দেয়া হবে। কিন্তু কোন সৎকর্মই তার মধ্যে খুঁজে পাবে না। তখন সে আল্লাহকে বলবে : হে আল্লাহ্! এটা আমার আমলনামা নয়। কেননা,আমি এতে আমার কোন ইবাদাত-বন্দেগীই দেখছি না। বলা হবে : তোমার প্রতিপালক না ভুল করেন,আর না ভুলে যান। তোমার কৃতকর্ম অন্যের গীবত করার কারণে বরবাদ হয়ে গেছে। অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে আনা হবে এবং তাকেও তার আমলনামা দেয়া হবে। তাতে অনেক ইবাদাতই লিপিবদ্ধ থাকবে। তখন সে বলবে : হে আল্লাহ্! এটা আমার আমল নামা নয়। কেননা,আমি এ ইবাদাতসমূহ আঞ্জাম দেইনি। বলা হবে : অমুক ব্যক্তি তোমার গীবত করেছে তাই আমি তার নেক কর্মসমূহ তোমাকে দান করেছি।’

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন :

প্রত্যেক মুসলমানের ওপর গীবত হারাম। যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে তদ্রূপ গীবত মানুষের নেকীগুলোকে খেয়ে ফেলে।’১০

৪. গীবতকারী কিয়ামতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন :‘মিরাজের রাতে একদল লোককে দেখলাম যে,তারা নখ দিয়ে নিজেদের মুখে আঁচড় কাটছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বললেন : এরা হল মানুষের গীবতকারী ও মানুষের সম্মান বিনষ্টকারী।’১১

 

গীবত শ্রবণ করা

গীবত শ্রবণ করাও গীবত করার ন্যায় কবীরা গুনাহ। একটি হাদীসে বলা হয়েছে :  ‘শ্রোতাও গীবতকারীদের একজন।’১২

হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘গীবত শ্রবণকারী গীবতকারীর অনুরূপ।’১৩

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : ‘গীবত কুফর স্বরূপ এবং শ্রবণকারী আর তার প্রতি সন্তুষ্টি পোষণকারী হল মুশরিকস্বরূপ।’১৪

গীবত থেকে বিরত থাকার সুফল

মহানবী (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি কোন সভায় তার ভাইয়ের গীবত শোনে এবং সেটাকে ব্যাহত করে আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে ১০০০ মন্দ দিককে তার হতে দূর করে দেবেন।’১৫

গীবতের কাফফারা

গীবতের কাফফারা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,যার গীবত করেছ যখনই তার কথা স্মরণ করবে,আল্লাহর কাছে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে।’১৬

গীবত জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রসমূহ

যদিও ইসলাম ধর্মে গীবত কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত;কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে গীবত করাটা জায়েয হয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘চার ব্যক্তির নিন্দা করা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়;যে পাপাচারী নিজের পাপ প্রকাশ করে দেয়। ঐ মিথ্যুক নেতার যাকে অনুগ্রহ করা হলে কৃতজ্ঞ হয় না,আর তার অনিষ্ট করা হলে ক্ষমা করে না। আর যারা ঠাট্টা মশকরা করে মা তুলে গালি দেয়। যারা মুসলিম উম্মাহ হতে বেরিয়ে আমার উম্মতের ত্রুটি বর্ণনা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার হাতে নেয়।’১৭

নিচে গীবত জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রগুলো উল্লেখ করা হল :

১. জুলুমের বিচারপ্রাপ্তি : জুলুমের বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয। যদি কোন অত্যাচারিত ব্যক্তি ন্যায়বিচারের দাবিতে বিচারকের শরণাপন্ন হয় তবে অত্যাচারীর নাম বর্ণনা করাতে কোন দোষ নেই। সুতরাং অত্যাচারিতদের অত্যাচারীর গীবত করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

لَّا يُحِبُّ اللَّـهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَن ظُلِمَ وَكَانَ اللَّـهُ سَمِيعًا عَلِيمًا

আল্লাহ কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না,তবে কারও প্রতি অত্যাচার করা হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা,আল্লাহ শ্রবণকারী,বিজ্ঞ।১৮

২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ : মন্দ বিষয় দূর করা অথবা গোনাহগারকে সৎপথে আনার জন্য গীবত করা জায়েয। তবে বিষয়টি যথাযথভাবে হতে হবে।

৩. পরামর্শের ক্ষেত্রে : বিবাহের ক্ষেত্রে বা সামাজিক কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে কারো দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা জায়েয। এমন পরিস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা না হলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থের বিপরীতে সামাজিক স্বার্থকে প্রাধান্য দান করতে হবে।

৪. শরীয়তের বিধান জানার ক্ষেত্রে : কোন সমস্যার ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান জানার জন্য যদি কারও কথা উল্লেখ না করলে সঠিক নির্দেশনা জানা না যায় সেক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয।

৫. অনিষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য : কোন মুসলমানকে অনিষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য গীবত করা জায়েয। উদাহরণস্বরূপ একজন দ্বীনদার ব্যক্তিকে কোন পাপাচারীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে দেখলে সেই পাপাচারী সম্পর্কে তাকে অবহিত করা জরুরি। নইলে দ্বীনদার ব্যক্তিও তার প্রভাবে পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে।

৬. প্রকাশ্য পাপকার্যে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে : যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপকাজ করে এবং তার পাপাচার কারও কাছে গোপন নয় এমন ব্যক্তির গীবত হয় না। যেমন প্রকাশ্য মদপানকারী। মহানবী (সা.) বলেছেন : প্রকাশ্য গুনাহকারীর কোন সম্মান নেই এবং তার গীবত করা জায়েয।’১৯

৭. মন্দের প্রতিরোধ : কখনও কখনও সমাজকে নিষ্কলুষ রাখার লক্ষ্যে কারও কারও দোষ-ত্রুটি লোকদেরকে বা অন্ততপক্ষে দায়িত্ববান ব্যক্তিদের অবগত করা জরুরি যাতে তাদের সাহায্য নিয়ে সমাজে অনাচার প্রতিরোধ করা যায়।

৮. ধর্মে বিদআত সৃষ্টিকারী : যারা ধর্মের মধ্যে বিদআত সৃষ্টি করে এবং লোকদের দ্বীন থেকে পথভ্রষ্ট করতে চায় তাদের পরিচয় তুলে ধরা গীবত নয়;বরং এক্ষেত্রে একজন মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল তাদের পরিচয় তুলে ধরা।

৯. সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে : সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রেও কারও ত্রুটি বর্ণনা করায় কোন দোষ নেই।

 

গীবত থেকে আত্মরক্ষার উপায়

১. পরিণাম নিয়ে চিন্তা করা : গীবত থেকে আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হল এর পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করা। মানুষ এটা চিন্তা করবে যে,গীবতের ফলে তার আমলনামা বরবাদ হয়ে যাবে এবং কিয়ামতে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ চিন্তার মাধ্যমে সে নিজেকে গীবত করা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে।

২. নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে মনোনিবেশ করা : যখন মানুষ অপরের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতে যাবে তখনই তাকে এটা মনে করতে হবে যে,সে নিজেও এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। তাহলে নিজের মধ্যে যে ত্রুটি রয়েছে সেটার জন্য অন্যকে দোষারোপ করার কোন অধিকারই তার নেই।

৩. মানুষের অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন : এ কথা চিন্তা করা যে,যদি অন্য কোন ব্যক্তি তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে তবে তার অনুভূতি কেমন হবে;এ একই অনুভূতি অন্যেরও হবে যখন সে তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করবে। এ বিষয়টি তাকে গীবত করা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে।

৪. গীবত করার কারণ দূর করা : যে ব্যক্তি গীবত করছে তাকে চিন্তা করে বের করতে হবে যে,সে কোন কারণে গীবত করছে। তার মধ্যে যে কারণ সে খুঁজে পাবে সেই কারণ তাকে দূর করতে হবে। যদি ক্রোধের কারণে গীবত করে তবে তাকে ক্রোধ দমন করতে হবে,যদি হিংসার কারণে গীবত করে তবে হিংসা পরিহার করতে হবে,যদি অন্যের অনুসরণ ও মন রক্ষার জন্য হয় তবে তার চিন্তা করা উচিত,যে বিষয়ে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তাতে যদি মানুষ সন্তুষ্ট হয় তবে এতে কি লাভ? বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিই তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

অপবাদ আরোপ

অপবাদ আরোপ মানব চরিত্রের অপর বড় স্খলন। কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা হল গীবত,আর যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে যে ত্রুটি নেই তা বর্ণনা করা হয় তবে তাকে অপবাদ বলে। এটি গীবতের চেয়েও বড় গুনাহ।২০

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

مَن يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا

‘এবং যে কেউ কোন দোষ-ত্রুটি অথবা গুনাহ করে এবং পরে তা অন্য কোন নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়,নিঃসন্দেহে সে মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য গুনাহের বোঝা বহন করে।’২১

অপবাদের প্রকারভেদ

অপবাদ আরোপের তিনটি ভাগ রয়েছে। যথা-মহান আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ,নবী-রাসূলগণ ও ইমামগণের প্রতি অপবাদ আরোপ ও সাধারণ মানুষের প্রতি অপবাদ আরোপ। এগুলোর মধ্যে মহান আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপবাদ। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে :

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّـهِ الْكَذِبَ وَهُوَ يُدْعَىٰ إِلَى الْإِسْلَامِ وَاللَّـهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

‘যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহূত হয়ে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তার অপেক্ষা অধিক অবিচারক আর কে?’২২

অপবাদ আরোপের পরিণাম

মহানবী (সা.) বলেন : ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের প্রতি অপবাদ আরোপ করে বা তাকে এমন কোন বিষয়ে অভিযুক্ত করে যে ব্যাপারে সে নির্দোষ তাহলে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাকে আগুনের একটি টিলার ওপর দাঁড় করাবেন যতক্ষণ না সে ঐ বিশ্বাসীকে অভিযুক্ত করার ব্যাপারে অনুতাপ করে।’২৩

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : ‘যখন কোন ব্যক্তি তার মুমিন ভাইয়ের প্রতি অপবাদ আরোপ করে তখন তার অন্তর থেকে ঈমান সেভাবেই নষ্ট হয়ে যায় যেভাবে লবণ পানিতে নষ্ট হয়ে যায়।’২৪

তাই আমাদের সবার উচিত অন্যের প্রতি অপবাদ আরোপ করা থেকে বিরত থাকা। এমনকি যারা অপবাদ আরোপ করে তাদের সংস্পর্শ থেকেও আমাদের দূরে থাকা উচিত।

 

চোগলখুরী করা

এক ব্যক্তির কথা অপরের কাছে লাগানোকে চোগলখুরী বলে। এটিও জিহ্বার দ্বারা সংঘটিত অন্যতম বড় গুনাহ। এর মাধ্যমে মানুষ দুই ব্যক্তির সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবীদের বললেন : ‘আমি কি তোমাদের সর্বাধিক দুষ্ট সম্পর্কে বলব না?’ সাহাবীরা আরজ করলেন : ‘আপনি বলুন সর্বাধিক দুষ্ট কে।’

তিনি বললেন : ‘যে চোগলখুরী করে বন্ধুদের সম্পর্কে ফাটল ধরায় এবং স্বচ্ছ লোকদের দোষ খুঁজে বেড়ায়।’২৫

পবিত্র কুরআনে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে :

وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ

‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের,যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।’২৬

এ আয়াতে কোন কোন আলেমের মতে ; هُمَزَةٍ এর অর্থ যে চোগলখুরী করে।

চোগলখুরীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় এবং পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের চোগলখুরী পরিহার করতে হবে এবং একইসাথে চোগলখোরকে পরিহার করাও আমাদের জন্য একান্ত আবশ্যক। কারণ,এমন ব্যক্তি যেভাবে অন্যদের কথা আমাদের কাছে বলে থাকে তেমনি আমাদের কথাও অন্যদের কাছে বলে বেড়ায়।

তথ্যসূত্র :

১. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম গাযযালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৭

২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৮

৩. সূরা হুজুরাত : ১২

৪. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম গাযযালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৬

৫. আততারগীব ওয়াত তারহীব, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং ২৪

৬. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম গাযযালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৮; বিহারুল আনওয়ার, ৭৫তম খণ্ড, অধ্যায় ৬৬, হাদীস নং ১

৭. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম গাযযালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৯; বিহারুল আনওয়ার, ৭৫তম খণ্ড, অধ্যায় ৬৬, হাদীস নং ১

৮. বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত তিরমিযী, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং ১৮৮০

৯. জামেউল আখবার, হাদীস নং ১১৪৪; বিহারুল আনওয়ার ৭৫তম খণ্ড, অধ্যায় ৬৬,হাদীস নং ৩৫

১০. কাশফুর রিবা, পৃ. ৯

১১. তানবীহুল খাওয়াতির, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৫; এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৬; বিহারুল আনওয়ার ৭৫তম খণ্ড, অধ্যায় ৬৬, হাদীস নং ১

১২. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম গাযযালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৮

১৩. গুরারুল হিকাম, হাদীস নং ১১৭১

১৪. মুসতাদরাক, ৯ম খণ্ড, অধ্যায় ১৩৬, হাদীস ১০৪৬২

১৫. আমালীয়ে সাদুক, হাদীস নং ৩৫০

১৬. আল কাফি, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৪

১৭. বিহারুল আনওয়ার, ৭৫তম খণ্ড, হাদীস নং ৬৪

১৮. সূরা নিসা : ১৪৮

১৯. বিহারুল আনওয়ার, ৭৫তম খণ্ড, হাদীস নং ৩৩

২০. বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত তিরমিযী, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং ১৮৮৪

২১. সূরা নিসা : ১১২

২২. সূরা সাফ্ফ : ৭

২৩. বিহারুল আনওয়ার, ৭৫ তম খণ্ড, পৃ. ১৯৪

২৪. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ৬২, হাদীস নং ১৯

২৫. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম গাযযালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৫৭

২৬. সূরা হুমাযাহ্ : ১

(লেখাটি ত্রৈমাসিক প্রত্যাশা, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা থেকে নেওয়া হয়েছে)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)