আল হাসানাইন (আ.)

সমকালীন বাস্তবতা ও মানবাধিকার

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

বিগত বিংশ শতাব্দী ও বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জটিল মানবীয় বিষয় হলো মানবাধিকার। বর্তমানে তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। মানবাধিকার এখন আধুনিক সভ্য মানুষের মূলমন্ত্র ও আদর্শ এবং তার পরিচিতি ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ধরনের পরিভাষা,যেমন মৌলিক স্বাধীনতা,আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং মানবীয় আচার-আচরণ,এমনকি নারী অধিকার ইত্যাদির ব্যাপক প্রভাব ও কার্যকারিতা রয়েছে। কিন্তু এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,আসলে কি বর্তমান বিশ্বে প্রকৃত মানবাধিকার সংরক্ষিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে? আজ বিশ্বে মানবাধিকার বলে যা কিছু করা হচ্ছে বা বলা হচ্ছে আসলে তা প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার নয়;বরং তা হচ্ছে খণ্ডিত ও অপূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার। প্রকৃত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ কেবল তখনই সম্ভব হবে যখন তা ‘মানুষ’সংক্রান্ত প্রকৃত বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন থেকে উৎসারিত হবে। পাশ্চাত্যজগৎ ও সভ্যতা আসলে বস্তুবাদী যা পদার্থ ও বস্তুর বাইরে অবস্তুগত সব কিছুকেই হয় অস্বীকার করে নতুবা উপেক্ষা করে। তাই পাশ্চাত্য সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ যত বড় মহানই হোক না কেন সে প্রাণীজগতের অন্তর্গত। অর্থাৎ সে উন্নত ও বুদ্ধিমান প্রাণী বা তার চেয়ে বুদ্ধিমান ও শ্রেষ্ঠ প্রাণী নেই। যেহেতু মানবাত্মা অবস্তুগত ও অজড়,তাই পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী দর্শন ও সভ্যতায় তা উপেক্ষিত। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা ও সত্য হচ্ছে এই যে,মানুষ আসলে আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে গঠিত। আর তার পূর্ণ বিকাশ তার আত্মা ও দেহের পূর্ণ ও প্রকৃত বিকাশ ও উৎকর্ষের ওপর নির্ভরশীল। কারণ আত্মা ও দেহের মধ্যকার প্রগাঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান। আর বিষয়টি সকল ধর্মে স্বীকৃত। তবে ইসলাম ধর্মে এ বিষয়টি যত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ পরিসরে উপস্থাপিত হয়েছে তা অন্য কোন ধর্ম ও মতাদর্শে উপস্থাপিত হয় নি। পবিত্র কোরআন ও ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সত্তাগতভাবে সম্মানিত ও মর্যাদাবান। পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাঈলের ৭০ নং আয়াতে বলা হয়েছে : “আমরা আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি।” এ আয়াতের আলোকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,মানুষকে এমন সব মহান গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে মহান আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন যা তাকে সৃষ্টিজগতে সকল সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। আর এ কারণেই সে এ পৃথিবীতে খলীফা (প্রতিনিধি) এবং তিনি (মহান আল্লাহ্) সকল ফেরেশতা ও ইবলিসকে মানুষকে (আদম) সিজদাহ্ করার আদেশ দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে এতদপ্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে : “যাকে আমি আমার নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি তার উদ্দেশ্যে সিজদাহ্ করতে কিসে তোমাকে বাধা দিল?” (সূরা সাদ : ৭৫)

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,একমাত্র ইসলাম ধর্মেই মানুষ ও মানব জীবনকে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং এ ভিত্তিতে মানুষ ও তার জীবন সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। যেহেতু মানব জীবনের দু’টি প্রধান দিক রয়েছে যেগুলো হচ্ছে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক বস্তুগত। তা সমুদয় মানবাধিকারে অবশ্যই মানব জীবনের এ দু’টি দিক মানুষের প্রতি মহান আল্লাহ প্রদত্ত এ ঐশী সম্মান ও মর্যাদার সাথে অবশ্যই পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল হতে হবে। এখানে উল্লেখ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রমাণিত যে,কাঙ্ক্ষিত মানবীয় পূর্ণতা এবং মনুষ্যত্ব ও সুকুমার মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ,স্রষ্টায় বিশ্বাস ও তার নৈকট্যের মধ্যেই নিহিত সেহেতু মহান আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসই হচ্ছে সকল অধিকারের মূল ভিত্তি। তাই স্বাধীনতা,ন্যায়বিচার,শৃঙ্খলা মানবাধিকারসমূহের মূল লক্ষ্য নয়। মূল লক্ষ্য হচ্ছে মহান স্রষ্টার সাথে মিলন ও নৈকট্য লাভ। আর প্রকৃত স্বাধীনতা মানুষ কেবল মহান আল্লাহর একনিষ্ঠ দাসত্ব ও ইবাদতের মাধ্যমেই অর্জন করে। কারণ এর ফলে মানুষ সব ধরনের মিথ্যা দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত ও স্বাধীন হয়।

বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের সরাসরি প্রাধান্য ও প্রভাবে গৃহীত মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণা ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ পূর্ণাঙ্গ তো নয়ই;বরং সেগুলোর প্রচুর ত্রুটিপূর্ণ দিক রয়েছে। যেমন দার্শনিক বিষয়াদি থেকে আইনগত ও সামাজিক বিষয়াদি বিচ্ছিন্নকরণ;সেগুলোর মধ্যে স্থাপিত ধারা-উপধারাসমূহের মধ্যকার যৌক্তিক ক্রমবিন্যাসের অনুপস্থিতি। তাই মানবাধিকার সংক্রান্ত পাশ্চাত্যের প্রাধান্যপ্রাপ্ত বিশ্বঘোষণা ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ একদিকে যেমন যৌক্তিক ও দৃঢ় দার্শনিক ভিত্তিবর্জিত তেমনি অন্যদিকে তা সংকীর্ণ বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত;তাই তাত্ত্বিকভাবে তা অপূর্ণ। এরপর তা ব্যবহারিকভাবে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতেও পারছে না। কারণ এ ঘোষণার রূপকার পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রসমূহই বিশ্বের দুর্বল জাতিগুলোকে টুকরো টুকরো করে তাদের সহায় সম্পদ লুণ্ঠন করেছে এবং অবিরত করে যাচ্ছে;এরচেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘণ্যতম চিত্র আর কী হতে পারে? পাশ্চাত্য আজ মানবাধিকারের বোল তুলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন,আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়ামানে ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের বিশেষ করে আমেরিকার মানবাধিকার লঙ্ঘন আজ কার অজানা? পাশ্চাত্যের এ দ্বিমুখী নীতি বিশ্ববিবেকের কাছে মোটেও বিস্ময়কর ঠেকছে না। এ দ্বিমুখী নীতির ফলেই পাশ্চাত্য ইসরাইলকে গণতান্ত্রিক দেশ বলে বিবেচনা করে,অথচ যে সব দেশ পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে না তাদেরকে মানবাধিকারবিরোধী বলে চিহ্নিত করছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গুটিকতক পরাশক্তির ভেটো প্রদানের অধিকার আসলে মানবাধিকারের নির্লজ্জ লঙ্ঘন।

মুসলিম দেশগুলো দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদী শাসনে থাকার কারণে সে সব দেশে মানবিকতা ও মানবাধিকারের মৌলিক উন্নয়ন তেমন কিছুই ঘটে নি। সত্যিই এটা দুঃখজনক। আর এর সাথে মানবাধিকার সংক্রান্ত পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাওয়ায় সার্বিকভাবে অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। তবে গত বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন হওয়ার জন্য এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখা দিয়েছে। আমরা আশা রাখি,সঠিক ইসলামী মূল্যবোধের দিকে মুসলিম উম্মাহ্ বিশেষ করে তরুণ মুসলিম প্রজন্মের প্রত্যাবর্তন,আগামীতে মুসলিম বিশ্ব তথা সমগ্র বিশ্বে মানবিকতা ও মানবাধিকারের প্রকৃত উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটাবে।

(জ্যোতি বর্ষ ২ সংখ্যা ৩)

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)