আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন'আম;(১৭তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন'আম; আয়াত ৭১-৭৪

সূরার ৭১ ও ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ أَنَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُنَا وَلَا يَضُرُّنَا وَنُرَدُّ عَلَى أَعْقَابِنَا بَعْدَ إِذْ هَدَانَا اللَّهُ كَالَّذِي اسْتَهْوَتْهُ الشَّيَاطِينُ فِي الْأَرْضِ حَيْرَانَ لَهُ أَصْحَابٌ يَدْعُونَهُ إِلَى الْهُدَى ائْتِنَا قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَى وَأُمِرْنَا لِنُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (৭১) وَأَنْ أَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَاتَّقُوهُ وَهُوَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ ((৭২

"(হে নবী! আপনি তাদের) বলে দিন : আমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুকে আহবান করবো, যে আমাদের উপকার ও ক্ষতি করতে পারে না এবং আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শন করার পর আমরা কি পেছনে ফিরে (কাফের হয়ে) যাবো? ওই ব্যক্তির মতো যাকে শয়তানরা বনভূমিতে বিপথগামী করে দিয়েছে- সে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। তার সহচররা তাকে পথের দিকে ডেকে বলছে : এসো আমাদের কাছে। আপনি বলে দিন : নিশ্চয়ই আল্লাহর পথই সুপথ। আমরা নিজ প্রতিপালকের আজ্ঞাবহ হতে আদিষ্ট হয়েছি।" (৬:৭১)

"এবং নামাজ কায়েম করো ও তাঁকে ভয় করো। তাঁর সামনেই তোমাদেরকে (ফিরে যেতে এবং) একত্রিত হতে হবে।" (৬:৭২)

আগের পর্বগুলোতে আমরা বলেছি, মক্কার মুশরিক ও মূর্তিপুজকরা নও মুসলিমদের ঈমান নষ্ট করার জন্য প্রতিমুহূর্তে তাদেরকে শিরকের দিকে আহবান জানাতো। তারা বিশ্বনবী (সা.) ও পবিত্র কুরআনের শিক্ষাকে উপহাস করে নও মুসলিমদের বিপথগামী করার চেষ্টা করতো। এ আয়াতে মহান আল্লাহ দৃঢ়তার সঙ্গে মুশরিক ও মূর্তি পুজকদের এসব হীন কাজের জবাব দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)’কে  নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন করতে বলছেন যে, যেসব ব্যক্তি বা বস্তুর কোন ক্ষমতা নেই- আল্লাহকে বাদ দিয়ে সেসবের উপাসনার কি কোন অর্থ হয়? এসব মূর্তি মানুষকে কী দিতে পারে যে, তার লোভে মানুষ তার ইবাদত করবে? অথবা এসব বস্তু মানুষের কী ক্ষতি করতে পারে যে তার ভয়ে এসবের ইবাদত করতে হবে?

নও মুসলিমরা জীবনের একটি বড় অংশ মূর্তিপুজা করে কাটালেও সত্যের বাণী শোনামাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং প্রতিমার উপাসনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তারা যদি আবারো মূর্তিপুজায় ফিরে যেতে চান তাহলে তারা ইহকাল ও পরকালে সফলতার মুখ দেখবেন না এবং পূর্ণতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হবেন। জাহিলিয়াতের যুগে আরবরা বিশ্বাস করতো, মরুভূমিতে কেউ পথ হারিয়ে ফেললে তার জন্য শয়তান ও দুষ্টু জিনরা দায়ী। তারা মানুষকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। পবিত্র কুরআন আরবদের এ ধারণাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলছে, একত্ববাদের পথ থেকে শিরকের দিকে ফিরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সেই অন্ধকার ও বিপদসঙ্কুল পথে পাড়ি জমানো যা শয়তান তাদের জন্য পেতে রেখেছে। এ সূরার শেষাংশে বলা হচ্ছে, পথভ্রষ্ট অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশাবলীর কাছে আত্মসমর্পন করা। কারণ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে সবকিছু এবং তাঁর সন্তুষ্টির ওপর মানুষের সৌভাগ্য নির্ভর করছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মাটির তৈরি যে মূর্তি মানুষের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না তার উপাসনা অর্থহীন।

দুই. বিশ্ব চরাচরের সব বস্তু ও প্রাণী আল্লাহর উপাসনায় বিভোর। কাজেই মানুষেরও উচিত সেই আল্লাহ’র ইবাদত করা।

সূরা আন'আমের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ وَيَوْمَ يَقُولُ كُنْ فَيَكُونُ قَوْلُهُ الْحَقُّ وَلَهُ الْمُلْكُ يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ ((৭৩

"তিনিই সঠিকভাবে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। যেদিন তিনি (তাদেরকে) বলবেন : হয়ে যা, তখনই তা হয়ে যাবে। তাঁর কথা সত্য। (কিয়ামতের দিন হচ্ছে) সে দিন- যে দিন শিঙ্গায় ফুতকার করা হবে, সেদিন তাঁরই আধিপত্য থাকবে। তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্যমান বিষয়ে জ্ঞাত। তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।" (৬:৭৩)

আগের দুই আয়াতে পবিত্র কুরআন আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন এবং তার নির্দেশাবালী মেনে চলার আহবান জানিয়েছে। এ আয়াতে এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তোমরা কি এ বিষয়টি স্বীকার করো না যে, এ বিশ্ব চরাচর শুরু হয়েছে তারই মাধ্যমে? তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং বিচার দিবসে আমাদের বিচার করবেন। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং সবকিছুর ওপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কাজেই মানুষের উচিত আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার জন্য তাঁর পূর্ণ আনুগত্য করা। তিনি ন্যায়ের ভিত্তিতে এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তার সব কথা সত্য এবং তিনি ন্যায়বিচারক।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :

এক. মহান আল্লাহ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সৃষ্টিজগতকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। তিনি সঠিক ও সুনিপুণভাবে প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।

দুই. জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে মহান আল্লাহ মানুষ ও জ্বিন জাতির জন্য বিভিন্ন নির্দেশ জারি করেছেন। কাজেই মানুষের উচিত বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা।

সূরা আন'আমের ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ آَزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آَلِهَةً إِنِّي أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ((৭৪

"স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম পিতা আযরকে বললেন : তুমি কি প্রতিমাগুলোকে উপাস্য মনে করো? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট।" (৬:৭৪)

আগের আয়াতগুলোতে মক্কার মুশরিক বা মূর্তিপুজকদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের পাশাপাশি রাসূলের পক্ষ থেকে তাদেরকে যে জবাব দেয়া হয়েছে- তা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)’কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলছেন, আপনি এ কথা মনে করবেন না যে, শুধুমাত্র মক্কার অধিবাসীরা মূর্তিপুজা করছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র যুগেও বহু মানুষ প্রতিমাপুজা করতো। হযরত ইব্রাহিম তার সম্প্রদায়ের মূর্তিপুজক নেতাদের উদ্দেশ করে বলতেন : আপনারা কীভাবে প্রাণহীন মূর্তিকে নিজেদের সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করছেন এবং তাদের উপাসনা করছেন? এর মাধ্যমে আপনারা সফলকাম হতে পারবেন না।

অবশ্য এখানে একটি প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে সবার ভুল ভাঙানো প্রয়োজন। আযর হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর চাচা ছিলেন, পিতা নয়। তবে হযরত ইব্রাহিমের ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার তার ওপর অর্পিত থাকায় তিনি ছিলেন তাঁর পিতার মতো। এ আয়াতে তাই আযরকে হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র পিতা বলে সম্মোধন করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :

এক.  মাতা-পিতার ধর্মবিশ্বাস অন্ধভাবে অনুসরণ করতে সন্তান বাধ্য নয়। বরং তাকে বিচারবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে সত্য উপলব্ধি করতে এবং ভ্রান্ত ধারণা ত্যাগ করতে হবে। শুধুমাত্র পিতৃপুরুষদের ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করলেই চলবে না, সেইসঙ্গে পিতা ও অভিভাবকদের সঠিক পথে আসার আহবানও জানাতে হবে।

দুই. বিভিন্ন জাতি হাজার হাজার বছর ধরে ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি লালন করলেও এগুলোর কোন যুক্তিপূর্ণ ভিত্তি না থাকায় তা পরিত্যাগ করতে হবে। সঠিক ধর্ম চেনার উপায় যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি; হাজার বছরের ঐতিহ্য কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্য উপলব্ধির মানদণ্ড নয়।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)