আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন'আম;(১৮তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন'আম; আয়াত ৭৫-৭৯

সূরা আন'আমের ৭৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِينَ ((৭৫

"আমি এভাবেই ইব্রাহিমকে আসমান ও জমিনের অত্যাশ্চর্য বস্তুগুলো দেখাতে লাগলাম- যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায়।" (৬:৭৫)

আগের পর্বে আমরা বলেছিলাম, আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) যুক্তি ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁর সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি পিতৃপুরুষের শিখিয়ে দেয়া মূর্তিপুজা করতে অস্বীকৃতি জানান। মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন : মূর্তিপুজার বিরুদ্ধে হযরত ইব্রাহিমের এ দৃঢ় অবস্থানের কারণে আসমান ও জমিন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় বিষয় তাকে জানিয়ে দেই। এর ফলে ইব্রাহিম সৃষ্টিজগতের বহু অজানা বিষয় জানতে পারেন এবং তার মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, এ সৃষ্টিজগতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদর্শিত পথ গ্রহণ এবং সে পথে মানুষকে আহবান জানায়- মহান আল্লাহ তার জন্য সঠিক পথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দেন। এমনকি তাকে সৃষ্টিজগতের অনেক গোপন রহস্য জানতেও সহযোগিতা করেন।

দুই. আমরা যেন বাহ্যিকভাবে কোন কিছু দেখেই তাতে আকৃষ্ট হয়ে না যাই। পৃথিবীর বাহ্যিক চাকচিক্য যেন আমাদের পথভ্রষ্ট করতে না পারে। মহান আল্লাহর উপস্থিতি এবং তার কাছে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি আমাদেরকে সব সময় মনে রাখতে হবে।

সূরা আন'আমের ৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَبًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَا أُحِبُّ الْآَفِلِينَ ((৭৬

"এরপর যখন রাতের অন্ধকার তার উপর সমাচ্ছন্ন হলো, তখন সে একটি তারকা দেখতে পেল। সে বলল : এটি আমার প্রতিপালক। এরপর যখন তা অস্তমিত হলো, তখন বলল : আমি অস্তগামীদেরকে ভালোবাসি না।" (৬:৭৬)

হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র যুগে মূর্তিপুজার পাশাপাশি আকাশের তারা, চাঁদ ও সূর্য সম্পর্কেও মানুষের বিশেষ কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল। মানুষ তাদের ভাগ্যের ওপর এসব গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করতো। বর্তমানেও বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে এ ধরনের বিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায়। যেমন বলা হয় : অমুকের ভাগ্যাকাশে সৌভাগ্যের তারা উদিত হয়েছে কিন্তু আমার আকাশে একটি তারাও নেই।

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিশেষ পদ্ধতিতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি প্রথমে অন্য সবার মতো এসব প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ভান করেন। আল্লাহর নবী তারা, চাঁদ ও সূর্যের কাছে নিজের ভাগ্যকে সঁপে দেন। তাদেরকে সৃষ্টিকর্তা বলেও মেনে নেন। কিন্তু এক পর্যায়ে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্দেশ করে বলেন : এসব তারকা ও নক্ষত্র তো সারাক্ষণ উদিত এবং অস্তমিত হচ্ছে। যে ডুবে যাচ্ছে তার উপাসনা করা যায় না। যে নিজেই অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে তার পক্ষে সৃষ্টিজগতের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা অসম্ভব।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. আল্লাহর পথে আহবান করার অন্যতম পদ্ধতি হলো পথভ্রষ্ট মানুষের কাতারে নিজেকে শামিল করে তাদের যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণ দিয়ে তাদের বিশ্বাসকে ভুল বলে প্রমাণ করা।

দুই. মানুষকে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহকে চিনতে এবং তার ইবাদত করতে হবে। অমূলক ধারণার ওপর ভর করে উপাসনা করা অর্থহীন।

সূরা আন'আমের ৭৭ ও ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِنْ لَمْ يَهْدِنِي رَبِّي لَأَكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ (৭৭) فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ ((৭৮

"এরপর যখন চাঁদকে ঝলমল  করতে দেখল, বলল : এটি আমার প্রতিপালক। তারপর যখন তা অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন বললো : যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ-প্রদর্শন না করেন, তবে অবশ্যই আমি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবো।" (৬:৭৭)

"এরপর যখন সূর্যকে চক্‌চক্‌ করতে দেখল, বলল : এটি আমার প্রতিপালক, এটি তুলনামুলকভাবে বড়। তারপর যখন তাও ডুবে গেল, তখন বলল : হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা যেসব বিষয়কে শরিক করো, আমি ওসব থেকে মুক্ত।" (৬:৭৮)

আগের আয়াতে তারকাপুজার ইতিহাস এবং তা প্রত্যাখ্যান করার পর এ আয়াতে চাঁদ ও সূর্যের উপাসনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে : হযরত ইব্রাহিম (আ.) অন্যান্য মানুষের মতো চাঁদ ও সূর্যকে দেখে তাদেরকে উপাসনার ভান করলেন। এমনকি সূর্য চাঁদের চেয়ে বড় হওয়ার কারণে তিনি সূর্যের প্রতি একটু বেশি গুরুত্ব দিলেন। কিন্তু চাঁদ ও সূর্য ডুবে যাওয়ার পর হযরত ইব্রাহিম তার সম্প্রদায়ের লোকজনকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন : যেসব গ্রহ-নক্ষত্র অস্তমিত হয় তারা উপাসনার যোগ্য নয়। তিনি তার কওমের মানুষদের একথা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তারা ভুলের মধ্যে রয়েছে এবং তিনি যদি তাদের এ উপাসনার পদ্ধতি মেনে নেন, তাহলে তিনিও পথভ্রষ্ট হয়ে যাবেন। ইব্রাহিম (আ.) তাদেরকে প্রশ্ন করলেন : যেসব বস্তুর নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই তাদেরকে আপনারা কীভাবে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করেন?

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলে তাকে সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করা নবী-রাসূলদের কাজ।

দুই. পথভ্রষ্ট ব্যক্তি বা জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া উচিত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যেমন প্রথমে তারকা, এরপর চাঁদ এবং সবশেষে সূর্যের উপাসনা করতে অস্বীকার করেছিলেন।

সূরা আন'আমের ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ((৭৯

"আমি একান্তভাবে সেই সত্ত্বার দিকে মুখ ফিরিয়েছি, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই।" (৬:৭৯)

হযরত ইব্রাহিম (আ.) তারকারাজি, চাঁদ ও সূর্যের উপাসকদের সামনে সঠিক পথ বাতলে দিতে গিয়ে বলেন, এসব গ্রহ-নক্ষত্রের কোনোটিই আমার প্রতিপালক হতে পারে না। আমার প্রতিপালক হচ্ছেন তিনি- যিনি আমাকেসহ এসব গ্রহ-নক্ষত্রকেও সৃষ্টি করেছেন। আমি সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত হতে চাই বলে যে আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, তার সঙ্গে কাউকে শরীক না করে তার দিকেই ফিরে যাচ্ছি এবং তার কাছেই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন  করছি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. যখনই আমাদের সামনে সত্য ও সঠিক পথের ঠিকানা পরিস্কার হয়ে যাবে তখনই আমাদের তা গ্রহণ করে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে।

দুই. শিরক থেকে দূরে থাকার অর্থ হচ্ছে, জীবনের সব ক্ষেত্রে- সব কাজে একমাত্র আল্লাহকে স্মরণ করা এবং একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করা। অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করার অর্থ তৌহিদ বা একত্ববাদ থেকে দূরে সরে যাওয়া। এ ধরনের কাজের পরিণতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)