আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন'আম;(১৯তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন'আম; আয়াত ৮০-৮৩

সূরা আন’আমের ৮০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَحَاجَّهُ قَوْمُهُ قَالَ أَتُحَاجُّونِّي فِي اللَّهِ وَقَدْ هَدَانِ وَلَا أَخَافُ مَا تُشْرِكُونَ بِهِ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ رَبِّي شَيْئًا وَسِعَ رَبِّي كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ

"তার সঙ্গে তার সম্প্রদায় বিতর্ক করলো। সে বললো : তোমরা কি আমার সঙ্গে আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে বিতর্ক করছো ? অথচ তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন। তোমরা যাদেরকে শরীক করো, আমি তাদেরকে ভয় করি না- তবে আমার প্রতিপালকই যদি কোন কষ্ট দিতে চান (সেটি ভিন্ন কথা)। আমার প্রতিপালক প্রত্যেক বস্তুকে নিজ জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। তোমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করো না?" (৬:৮০)

গত পর্বে আমরা বলেছি, আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রথমে মূর্তিপুজক, চাঁদ, তারা ও সূর্য উপাসকদের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের মতো বলেছিলেন, ‘এসব গ্রহ-নক্ষত্রই আমার প্রতিপালক’। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্রমাণ করেন, এসব বস্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কোন ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে না। কাজেই মানুষের প্রতিপালক হওয়ার কোন যোগ্যতা তাদের নেই। হযরত ইব্রাহিম (আ.) পরিস্কার ঘোষণা করেন, তোমরা যেসব বস্তুর উপাসনা করো আমি তাদের স্রষ্টাকে আমার প্রতিপালক মনে করি। সে আলোচনার ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে, হযরত ইব্রাহিমের সম্প্রদায় তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত উগ্র আচরণ করছে। তারা তো হযরত ইব্রাহিমের কথা মেনে নেয়ই নি, উল্টো তাঁকে তাদের সঙ্গে মূর্তিপুজা করতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছে। তাদের এ প্রচেষ্টার জবাবে ইব্রাহিম (আ.) বলেন, মহান আল্লাহ আমার সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরার পর তাকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর পরিচয় ও উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস আমি মেনে নিতে পারি না।

এ আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে, শির্‌ক ও কুফরের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে পথ আমি বেছে নিয়েছি তাতে যদি আমার কোন ক্ষতি হয়, তবে তোমরা ভেবো না যে, তোমাদের মূর্তি আমার কোন ক্ষতি করতে পেরেছে; বরং, সেটি আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। কারণ, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই সম্ভব নয়। তিনি সবকিছুর ওপর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং প্রতিটি বিষয়ে পূর্ণ অবহিত।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :

এক. ঈমানদার ব্যক্তি একাকিত্বে ভয় পান না। এমনকি সব মানুষ কাফের হয়ে গেলেও তিনি নিজের ধর্মবিশ্বাসে অটল থাকেন।

দুই. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অন্যতম প্রমাণ হলো গায়রুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুকে- তা সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন- ভয় না পাওয়া।

সূরা আন’আমের ৮১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلَا تَخَافُونَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا فَأَيُّ الْفَرِيقَيْنِ أَحَقُّ بِالْأَمْنِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

"যাদেরকে তোমরা আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে রেখেছো, তাদেরকে কীভাবে ভয় করো, অথচ তোমরা ভয় করো না যে, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে এমন বস্তুকে শরিক করছো- যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। যদি জেনে থাকো (তাহলে বলো, কিয়ামতের দিন) আমাদের দু'দলের মধ্যে শাস্তি পাওয়ার অধিক যোগ্য কে, যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাকো!" (৬:৮১)

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এ আয়াতে নিজের স্বভাবসুলত যুক্তি তুলে ধরে বলেন, তোমরা মুশরিকরা ইহকাল ও পরকালে আল্লাহর ক্রোধকে ভয় পাও না-এমনকি নিজেদেরকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করছো। অথচ তোমরা আশা করছো, আমি তোমাদের মূর্তিকে ভয় পাবো? তোমরা যে মূর্তির উপাসনা করছো তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই এবং তারা তোমাদের জন্য কোন ওহিও নাজিল করতে পারেনি। আল্লাহর নবী আরো বলেন, এখনো সময় আছে, তোমরা নিজের হাতে তৈরি মূর্তির পরিবর্তে আল্লাহকে ভয় করো। এটি করলে কিয়ামত বা বিচার দিবসে তোমরা নিরাপদে থাকবে। তোমরা কেন একটি সুনিশ্চিত বিষয়কে ত্যাগ করে কল্পনা ও ধারণাপ্রসূত বিষয়কে আঁকড়ে ধরেছো?

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক.  যুক্তি এবং বিচার-বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস গড়ে তোলা উচিত; কল্পনা, ধারণা, স্বপ্ন ও অলীক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নয়।

দুই. ধর্ম বিরোধীদের সঙ্গে আলাপের সময় প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতিতে কথা বলা উচিত। নিজের অবস্থানে অটল থাকার জন্য গোঁয়ার্তুমি করা উচিত নয়। তাদের প্রতি এ প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া উচিত : তোমাদের বক্তব্য এবং আমার যুক্তির মধ্যে কোন্‌টিকে তোমার কাছে বাস্তবতার সবচেয়ে কাছাকাছি মনে হয়?

সূরা আন’আমের ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ

"যারা ঈমান আনে এবং নিজ বিশ্বাসকে শিরক ও জুলুমের সঙ্গে মিশ্রিত করে না, তারাই শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে এবং তারাই সুপথগামী।" (৬:৮২)

পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তার সম্প্রদায়ের তর্ক-বিতর্কের কথা উল্লেখের পর আল্লাহর নবীর প্রশ্নের যেসব উত্তর তার কওমের লোকজন দিতে পারেনি, সেসব উত্তর দিতে গিয়ে বলেছে: কিয়ামতের দিন সতকর্মশীল মুমিন ব্যক্তিরাই কেবল নিরাপদে থাকবে। এসব ব্যক্তি বিশ্বাসের দিক দিয়ে এক আল্লাহর প্রতি ঈমানদার এবং কোন ধরনের শিরক বা কুফরি করেননি। সেইসঙ্গে তারা বাস্তব জীবনে কারো প্রতি জুলুম করেননি বরং আজীবন সতকর্মই ছিল তাদের ব্রত।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক.  ঈমান আনার চেয়ে ঈমান রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর পথে অবিচল থাকার মাধ্যমে ঈমান সুদৃঢ় করা সম্ভব।

দুই.  প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তিরাই আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনিশ্চিত নিরাপত্তার অধিকারী। তাও আবার সেই কেয়ামতের দিন- যেদিন কেউই নিরাপদ নয়।

সূরা আন’আমের ৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آَتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَنْ نَشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ

"এটি ছিল আমার যুক্তি, যা আমি ইব্রাহিমকে তাঁর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে প্রদান করেছিলাম। আমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় সমুন্নত করি। আপনার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী।" (৬:৮৩)

হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার সম্প্রদায়ের ঘটনাবলী বর্ণনার শেষ পর্যায়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলছেন : নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার এ ধরনের কৌশলপূর্ণ আচরণ আমরা তাকে শিখিয়েছি। ওহীর মাধ্যমে তাকে এ যুক্তিপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। মানুষের মধ্যে যারা চিন্তাশীল তারা অবশ্যই বুঝতে পারবে যে, ইব্রাহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ও রাসূল মনোনিত হয়েছেন। আল্লাহর বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মানুষকে সঠিকপথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া, নবী-রাসূল হিসেবে সমাজের সর্বোতকৃষ্ট ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। মনগড়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেউ নবুওয়াতের মতো বিশাল দায়িত্ব পায়নি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষের মর্যাদা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত- সম্পদ ও ক্ষমতার ভিত্তিতে নয়।

দুই. আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসূলরা যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে সঠিক পথে আসার দাওয়াত দিতেন। অন্ধভাবে আল্লাহর পথে আসার জন্য আহবান তারা কখনো জানাননি।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)