আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন'আম;(২৩তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আন'আম; আয়াত ৯৮-১০২

সূরা আনআ'মের  ৯৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ

“তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর একটি হচ্ছে তোমাদের স্থায়ী ঠিকানা ও একটি হচ্ছে গচ্ছিত স্থল। নিশ্চয়ই আমি প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি তাদের জন্য যারা চিন্তা করে।” (৬:৯৮)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : মহান আল্লাহ অন্য সব প্রাণীর তুলনায় তোমাদেরকে সুন্দরতম হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সাদা-কালো এবং বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে তোমরা সবাই একই সম্প্রদায়ের। এক আদম-হাওয়ার সন্তান তোমরা। অবশ্য তোমাদের কেউ এরইমধ্যে পৃথিবীতে এসেছো এবং কেউ কেউ পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় রয়েছো। আবার অনেকে এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছো। কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই কবর থেকে উত্থিত হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. সব মানুষ পরস্পরের ভাই। কাজেই মানুষে মানুষে শ্রেণী-বৈষম্যের কোন অর্থ হয় না।

দুই. এক পিতা-মাতার সন্তানদের এত রূপ মহান আল্লাহর বিশাল ক্ষমতার পরিচায়ক।

সূরা আন’আমের ৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُتَرَاكِبًا وَمِنَ النَّخْلِ مِنْ طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَجَنَّاتٍ مِنْ أَعْنَابٍ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ انْظُرُوا إِلَى ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَلِكُمْ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

"তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং এরপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি,যা নুয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের বাগান,জয়তুন,আনার প্রভৃতির কোনো কোনোটির পরস্পরের সঙ্গে মিল রয়েছে এবং কোনো কোনোটির মিল নেই। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য করো- যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য করো। নিশ্চয়ই এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদারদের জন্য।" (৬:৯৯)

আগের আয়াতে সব মানুষের একটিমাত্র উতসের কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে সব ধরনের উদ্ভিদ ও লতা-গুল্ম সৃষ্টির একক উতস তথা পানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি এবং অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা রয়েছে আল্লাহরই হাতে। মানুষ বীজ থেকে অঙ্কুর বের হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পারে মাত্র, মূল কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এ ছাড়া, এ আয়াতে আঙ্গুর ও খোরমা ফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য ফলের তুলনায় এ দু’টি ফলের উপকারিতা অনেক বেশি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. গাছ-পালা ও ফল-মূলের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক শুধু বস্তুগত ও খাদ্যসামগ্রী হিসেবে ব্যবহারের মধ্যে সীমিত থাকা উচিত নয়। বরং, এ ব্যাপারে গভীর চিন্তাভাবনা করা উচিত এবং আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করার মাধ্যম হওয়া উচিত। পেটের মতো মস্তিস্কেরও উচিত এসব ফল থেকে শক্তি গ্রহণ করে তা আল্লাহকে আরো বেশি চেনার কাজে ব্যবহার করা।

দুই. প্রকৃতির প্রতি ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে তাকানো উচিত নয়। গভীরভাবে এ সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে ধারণা লাভের মাধ্যমে আল্লাহ’র প্রতি আরো বেশি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

সূরা আন’আমের ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَجَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ الْجِنَّ وَخَلَقَهُمْ وَخَرَقُوا لَهُ بَنِينَ وَبَنَاتٍ بِغَيْرِ عِلْمٍ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يَصِفُونَ

"তারা জ্বিনদেরকে আল্লাহর অংশীদার স্থির করে; অথচ তাদেরকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তারা অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহর জন্য পুত্র ও কন্যা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। তারা যা বলে- তা থেকে তিনি পবিত্র ও সমুন্নত।" (৬:১০০)

দুঃখজনকভাবে ইসলামের আবির্ভাবের আগে ঐশি ধর্মগুলোর অনুসারীরা প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক করেছে। খিস্টানরা হযরত ঈসা (আ.)কে এবং ইহুদিরা হযরত ওযাইরকে আল্লাহর সন্তান মনে করতো। তাদের কেউ কেউ আবার ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর সন্তান মনে করতো। যরাথ্রুষ্টরা সৃষ্টিকর্তাকে সব কল্যাণ এবং শয়তানকে সব অকল্যাণের উৎস বলে মনে করতো। তারা শয়তানকে আল্লাহর এক ধরনের সমকক্ষ মনে করতো। তাদের মতে, শয়তান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই সব ধরনের অকল্যাণ করার সামর্থ্য রাখে। আরবদের কেউ কেউ জিন জাতিকে আল্লাহর প্রতিনিধি মনে করতো এবং তারা বলতো, জিনদের সঙ্গে আল্লাহ’র পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে।

এ আয়াতে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণার জবাব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে: জিনও তোমাদের মতো আল্লাহরই একটি সৃষ্টি। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কোন পুত্র বা কন্যাসন্তান নেই যারা পৃথিবী পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করতে পারে। মানুষ আল্লাহ সম্পর্কে যা কিছু ধারণা করতে পারে- তার তুলনায় তাঁর স্থান অনেক উর্দ্ধে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. সব ধরনের কুসংস্কারের মূলে রয়েছে অজ্ঞতা। ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের উচিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া; কুসংস্কারের সাহায্য নেয়া উচিত নয়।

দুই. আল্লাহর কোন স্ত্রী নেই বা থাকার প্রয়োজনও নেই। কাজেই তার সন্তান থাকারও প্রশ্ন উঠতে পারে না।

সূরা আন’আমের ১০১ ও ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (101) ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ (102)

"তিনি আসমান ও জমিনের অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন। কীভাবে আল্লাহর পুত্র হতে পারে, অথচ তার কোন সঙ্গিনী নেই? তিন সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব বস্তু সম্পর্কে সুবিজ্ঞ।" (৬:১০১)

"তিনিই আল্লাহ; তোমাদের প্রতিপালক। তিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা। কাজেই তোমরা তারই ইবাদত করো। তিনি প্রত্যেক বস্তুর কার্যনির্বাহী।"(৬:১০২)

এ আয়াতে মহান আল্লাহ এ বিশ্ব চরাচর সৃষ্টিতে তার একক কর্তৃত্বের বিষয়টি আরেকবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব জিনিসকে তিনি অস্বিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। প্রতিটি জিনিসের সৃষ্টিরহস্য তাঁর নখদর্পনে রয়েছে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বলে তার জন্য স্ত্রী বা সন্তানের ব্যবস্থা করার জন্য তোমরা ব্যাকুল হয়ো না। তিনি তোমাদের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। কাজেই তোমাদের উচিত একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা এবং তিনি ছাড়া অন্য সবকিছুর উপাসনা থেকে বিরত থাকা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. পবিত্র কুরআনের বর্ণিত আল্লাহর সঙ্গে বিকৃত আসমানী কিতাবগুলোর আল্লাহর তুলনা করলে সহজেই এর পার্থক্যগুলো চোখে পড়বে।

দুই. আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্যের মধ্যেই তার ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা নিহীত রয়েছে। তিনি আমাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে সৃষ্টি করেছেন বলেই তিনি ইবাদতের যোগ্য।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)