আল হাসানাইন (আ.)

আত্নশুদ্ধির প্রচেষ্টা-২য় পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

রোজা রাখার অর্থ কেবলমাত্র খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকা নয়, বরং মানুষকে পাপ থেকেও বিরত থাকতে হবে। এটুকু হলো তাদের জন্য, যারা নিতান্তই আনকোরা। (স্বর্গীয় মানুষেরা, যাঁরা খোদার মহত্বের খনি উন্মোচন করতে চান, তাদের ক্ষেত্রে রোজার নিয়ম-কানুন এর থেকে আলাদা।) অন্ততঃ রোজার প্রাথমিক আদব কায়দা মেনে চলা উচিত, এবং যেভাবে করে পানাহার থেকে বিরত থাকো, ঠিক একইভাবে চোখ, কান এবং জিহবাকেও সীমালঙ্ঘন করা থেকে সংযত করো। এখন থেকে তোমাদের জিহবাকে অপরের সমালোচনা, গিবত, মন্দ কথা এবং মিথ্যা থেকে দূরে রাখো; হিংসা-জিঘাংসা এবং অন্যান্য শয়তানী বৈশিষ্ট্যকে নিজের অন্তর থেকে বহিষ্কার করো। যদি পারো, আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলো। প্রতারণা না করে নিষ্ঠার সাথে কাজ করো। মানুষ এবং জ্বীনদের মধ্যে যেসব শয়তান আছে, তাদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলো। যদিও আমরা দৃশ্যতঃ এই মহামূল্যবান মর্যাদাকে আমাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতে পারি না, অন্ততপক্ষে এটুকু নিশ্চিত করার চেষ্টা করো যেনো তোমার রোজার সাথে কোনো পাপ না থাকে। তা না হলে তোমার রোজা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হলেও সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

কোনো কাজের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হওয়া না হওয়া এবং সেই কাজ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়া – এই দুয়ের মাঝে বিরাট ব্যবধান আছে। যদি পবিত্র রমজান মাসের শেষে তোমাদের কথা ও কর্মে কোনো পরিবর্তন না আসে, তোমাদের আচার-আচরণ যদি রোজার মাসের আগের দিনগুলোর থেকে ভিন্ন না হয়, তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে রোজার প্রকৃত তাৎপর্য তোমরা উপলব্ধি করতে পারো নাই। আর তোমরা যা করেছো, তা কেবলই দৈহিক রোজা।

এই মহান মাস, যে মাসে তোমাকে ঐশী উৎসবে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এসময়ে যদি তুমি খোদার ব্যাপারে মারেফত (অন্তর্দৃষ্টি) অর্জন করতে না পারো, কিংবা অন্ততঃ নিজের ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে না পারো, তাহলে বুঝে নিতে হবে তুমি আল্লাহর দেয়া এই উৎসবে ঠিকভাবে অংশগ্রহণ করো নাই। তোমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই পবিত্র মাস, যা কিনা “আল্লাহর মাস”, যে সময়ে খোদার বান্দাদের জন্যে ঐশী দয়ার দরজা খুলে যায়। এবং কিছু বর্ণনা অনুযায়ী এ সময়ে শয়তানদেরকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়; আর এমন সময়ে যদি তোমরা নিজেদের সংস্কার করতে না পারো, আত্মশুদ্ধি করতে না পারো, নফস-এ-আমারাহ কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, নিজের স্বার্থপর কামনা-বাসনাকে দমন করতে না পারো, এই দুনিয়া ও বস্তুজগতের মায়া ত্যাগ করতে না পারো, তাহলে রোজার মাস শেষ হওয়ার পরে এগুলো অর্জন করা তোমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হবে। তাই এই অপূর্ব দয়া শেষ হবার আগেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করো, আত্মসংস্কার করো, নিজেকে বিশুদ্ধ করে তোলো। রোজার মাসের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো। এমনটা যেনো না হয় যে, রমজান মাস আসার আগেই শয়তান তোমাকে এমনভাবে আক্রান্ত করে ফেলেছে যে, যখন শয়তানকে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে, তখন তুমি নিজে থেকেই নানারকম পাপকাজ ও ইসলামবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছো ! অনেকসময় খোদা থেকে দূরে সরে যাবার কারণে এবং বড় বড় গুনাহের কারণে সীমালঙ্ঘনকারী পাপী মানুষ অজ্ঞতা ও অন্ধকারের এতই অতলে নেমে যায় যে, শয়তানের আর তাকে প্ররোচিত করার প্রয়োজন হয় না, বরং সে নিজেই শয়তানের রং ধারণ করে। “সিবগাত আল্লাহ” হলো শয়তানের রঙের বিপরীত।

যে ব্যক্তি স্বার্থপর কামনা-বাসনার পিছনে ছোটে যে শয়তানের প্রতি অনুগত, ধীরে ধীরে সে-ও শয়তানের রঙ ধারণ করে। অন্ততপক্ষে এই একটা মাসে তোমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, এবং মহামহিম খোদা অসন্তুষ্ট হন, এমন কথা ও আচরণ এড়িয়ে চলা উচিত। এখনই, এই আজকের দিনেই খোদার সাথে চুক্তি করো যে পবিত্র রমজান মাসে তোমরা পরচর্চা, গিবত, অপরের সম্পর্কে মন্দ বলা, ইত্যাদি কাজ পরিত্যাগ করবে। তোমার জিহবা, চোখ, হাত, কান এবং অন্যান্য অঙ্গকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসো। নিজের কথা ও কর্মকে তদারকি করো। তাহলে হয়তো আল্লাহ তোমার দিকে দৃষ্টি দেবেন এবং দয়া করবেন। একমাস রোজার পর শয়তানকে যখন শিকলমুক্ত করা হবে, ততদিনে তোমার সংস্কার হয়েছে, তুমি বদলে গেছো, তুমি আর শয়তানের ধোঁকায় প্রতারিত হবে না, তুমি নিজেই নিজেকে বিশুদ্ধ করে তুলবে। আমি আবারো বলছি, পবিত্র রমজানের এই তিরিশটি দিনে তোমার জিহবা, চোখ, কান এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণের প্রতিজ্ঞা করো। সেইসাথে তুমি যেসব কাজ করার চিন্তা করছো, বা যেসব বিষয় শোনার পরিকল্পনা করছো, সেসবের ব্যাপারে শরয়ী দৃষ্টিকোণ কী, সেদিকে সতর্ক নজর রাখো। এটা হলো রোজা রাখার প্রাথমিক এবং বাহ্যিক নিয়ম। অন্ততঃ রোজার এই বাহ্যিক রীতিনীতিটুকু পালন করো ! কাউকে গিবত করতে দেখলে তাকে থামাও, বলো যে রোজার এই ত্রিশ দিনে নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা (আল্লাহর সাথে) বিশেষ চুক্তি করেছি। আর যদি তাকে পরচর্চা থেকে বিরত করতে না পারো, তাহলে সেই স্থান ত্যাগ করো। বসে বসে গিবত শুনো না। মুসলমানেরা যেনো তোমার থেকে নিরাপদ থাকে।

যার চোখ, হাত জিহবা থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ নয়, সে প্রকৃত মুসলিম নয়; যদিও সে মুখে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” উচ্চারণ করা আনুষ্ঠানিক ও বাহ্যিক মুসলমান। আল্লাহ না করুন, কিন্তু যদি তোমরা কাউকে আঘাত করতে চাও, গিবত করতে কিংবা অপবাদ আরোপ করতে চাও, তাহলে জেনে রাখা উচিত যে তোমরা তোমাদের প্রভুর সামনেই আছো। (এই মাসে) তোমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার অতিথি, (আর এসময়ে যদি কারো উপর অপবাদ আরোপ করো কিংবা গিবত করো, তবে সেক্ষেত্রে) মহামহিম খোদার সামনে তোমরা তাঁরই কোনো বান্দার সাথে দুর্ব্যবহার করবে, আর খোদার কোনো বান্দাকে অপবাদ দেয়া মানে হলো খোদাকেই অপবাদ দেয়া। তারা খোদারই বান্দা, বিশেষতঃ যদি তারা জ্ঞান ও তাক্বওয়ার পথে পণ্ডিত ব্যক্তি হয়ে থাকেন। লক্ষ্য করে দেখবে যে, ক্ষেত্রবিশেষে এজাতীয় মন্দ কাজ মানুষকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যে মৃত্যুর মুহুর্তেও সে খোদাকে অস্বীকার করে ! সে ঐশী নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে : “অতঃপর যারা মন্দ কর্ম করত, তাদের পরিণাম হয়েছে মন্দ। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলত এবং সেগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত।" (সূরা আর-রূম, ৩০:১০) এগুলো ধীরে ধীরে ঘটে। আজকে একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি, আগামীকাল একটু-আধটু গিবত, পরশু কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে অপবাদ, এমনি করে অন্তরে এসব পাপ একটু একটু করে জমা হয়; অন্তরকে কালো করে দেয়, মারেফত (খোদার সম্পর্কে জ্ঞান) অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এবং এভাবে বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে মানুষ সবকিছু অস্বীকার করে অবশেষে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে।

কুরআনের কয়েকটি আয়াতের কিছু তাফসির অনুযায়ী, মানুষের কর্মকে রিভিউ করার জন্য রাসূল (সা.) ও নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) সামনে উপস্থাপন করা হবে। যখন রাসূল (সা.) তোমার কর্মকে রিভিউ করবেন এবং দেখবেন যে সেটা কতই না ভুল ও পাপে পূর্ণ, কতটা দুঃখিত তিনি হবেন ! তুমি নিশ্চয়ই খোদার মনোনীত বান্দাকে দুঃখিত ও চিন্তিত দেখতে চাও না, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর মন ভেঙে দিতে চাও না, তাঁকে দুঃখ দিতে চাও না। যখন তিনি দেখবেন যে তোমার হিসাবের খাতা কেবলই গিবত, অপবাদ, অপর মুসলিমের সম্পর্কে নাহক কথায় পূর্ণ, আর দেখবেন যে তোমার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র ছিলো যত দুনিয়াবী আর বস্তুবাদী বিষয়, আর তোমার হৃদয় ছিলো হিংসা, জিঘাংসা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ – সেক্ষেত্রে পরম পবিত্র আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর ফেরেশতাদের উপস্থিতিতে তিনি (রাসূল (সা.)) বিব্রত হতে পারেন যে তার সম্প্রদায় ও অনুসারীরা ঐশী দয়ার ব্যাপারে অকৃতজ্ঞ ছিলো, এবং বেখেয়াল হয়ে তারা দুর্বীনিতভাবে মহান স্রষ্টার আস্থা ভঙ্গ করেছে। আমাদের নিজেদের লোক, এমনকি যদি কম সম্মানিত ব্যক্তিও হয়, তবুও সে ভুল করলে আমরা বিব্রত বোধ করি। আর তোমরা তো আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তির (মুহাম্মাদের) ক্বওম (জাতি), (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর সালাম) – আর মাদ্রাসায় দাখিল হওয়ার মাধ্যমে তোমরা নিজেদেরকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের সাথে আরো বেশি সম্পর্কযুক্ত করে ফেলেছো। এই তোমরা যদি নোংরা কাজ করো, তবে নবী (সা.) ব্যথিত হবেন, তিনি এটা সহ্য করতে পারবেন না, আর আল্লাহ না করুন (একারণে) তোমরা ধ্বংস হয়ে না যাও। আল্লাহর রাসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর সালাম) ও বিশুদ্ধ ইমামগণকে আল্লাহর সামনে দুঃখিত ও ব্যথিত কোরো না।

মানুষের অন্তর হলো আয়নার মতন –জ্জ্বল, পরিষ্কার – কিন্তু বেশি বেশি দুনিয়ার মায়া আর পাপের কারণে সে আয়না অন্ধকার হয়ে যায়। রোজার মাধ্যমে মানুষ কামনা-বাসনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, ভোগ-বিলাসকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কেউ যদি অন্ততঃ প্রতারণা না করে নিষ্ঠা সহকারে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোজা রাখে, (আমি বলছি না যে অন্যান্য ইবাদতগুলো নিষ্ঠা সহকারে করতে হবে না; অবশ্যই সবরকম ইবাদতই নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে হবে), তাহলে আশা করা যায় যে, অন্ততঃ এই একটা মাসে যথাযথভাবে রোজা রাখার পুরস্কার হিসেবে খোদার করুণা তাঁর বান্দার উপর বর্ষিত হবে, এবং বান্দার হৃদয়ের আয়না থেকে কলুষ ও অন্ধকার দূর হয়ে যাবে, এবং দুনিয়াবী আনন্দ থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর যখন ক্বদরের রাত উপস্থিত হবে, তখন এই বান্দা আলোকিত হয়ে উঠবে, যেটা আল্লাহর ওলী আর প্রকৃত মুমিনেরা অর্জন করেন।

এ ধরণের রোজার পুরষ্কার হলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা : “সাওম আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার।” আর কোনো কিছুই এমন রোজার পুরস্কার হতে পারে না। এমনকি স্বর্গীয় বাগানও এমন রোজার পুরস্কার হতে পারে না। কেউ যদি রোজাকে মনে করে একদিকে খাদ্যের জন্য মুখ বন্ধ রাখা আর অপরদিকে গিবতের জন্য মুখ খুলে দেয়া; বন্ধু-বান্ধবদের সাথে উষ্ণ আড্ডায় সেহরি পর্যন্ত রাতভর পরচর্চায় লিপ্ত থাকা, তবে এমন রোজা কোনোই কাজে আসবে না, এর কোনো প্রভাবও থাকবে না। যে এভাবে রোজা রাখে, সেতো খোদার উৎসবে যোগ দেবার ন্যূনতম ভদ্রতাটুকু জানে না। সে তার দয়াময়ের হক নষ্ট করেছে – দয়াময় আল্লাহ, যিনি কিনা মানুষ সৃষ্টির আগেই তার জীবন যাপন ও বৃদ্ধির সকল উপায় উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি পথপ্রদর্শনের জন্য নবী পাঠিয়েছেন। তিনি ঐশী গ্রন্থ নাযিল করেছেন। মানুষকে দান করা হয়েছে মহত্বের উৎস ও আলো (আল্লাহ তায়ালা) পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি, দেয়া হয়েছে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধিমত্তা ও তাঁর রহমত পাবার সম্মান। এখন তিনি (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর গেস্টহাউজে প্রবেশের আমন্ত্রণ দান করেছেন, যেনো মানুষ সেখানে রহমতের টেবিলে বসে খোদার শোকর গুজার করতে পারে এবং তাঁর যথাসম্ভব গুণকীর্তন করতে পারে। যে বান্দা খোদার পক্ষ থেকে এমন সুযোগ পায়, যে কিনা খোদার-ই দেয়া অফুরন্ত রিজিক গ্রহণ করছে – সেই প্রভু, সেই মেজবানের বিরোধিতা করা কি এমন বান্দার সাজে ? খোদার দেয়া রিজিক ব্যবহার করে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতা করবে – এটা কি বান্দার করা উচিত ? যে হাত মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, সে হাতে কামড় দেয়ার মতই কি না এ ব্যাপারটা ?

অতএব সচেতন হতে হবে এবং রোজার রীতিনীতির সাথে পরিচিত হতে হবে। সৎগুণাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক কাজকর্মের মাধ্যমে খোদাদ্রোহীতা করা যাবে না। পরম সত্তার অতিথিদের জানতে হবে মহিমান্বিত প্রভুর সান্নিধ্য কী জিনিস – যা পাওয়ার জন্য নবীগণ (আ.) ও ইমামগণ (আ.) সর্বদা প্রচেষ্টা চালাতেন; আলো ও মহত্বের উৎসকে পেতে চাইতেন। “...এবং আমাদের অন্তরের দৃষ্টিকে তোমার দিকে তাকানোর মাধ্যমে আলোকিত করে দাও, যতক্ষণ না আমাদের অন্তর্দৃষ্টি আলোর পর্দাকে ছিন্ন করে মহত্ত্বের উৎসের সাথে মিলিত না হয়।” প্রশংসিত মহিমান্বিত খোদা তাঁর বান্দাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আলো ও মহত্ত্বের উৎসে প্রবেশ করার জন্য। কিন্তু বান্দা যদি অযোগ্য হয়, তবে সে এই চমৎকার মহান অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে না। সদাপ্রশংসিত খোদা তাঁর বান্দাদেরকে সবধরণের দয়া ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তির উৎসবে আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু যদি বান্দা এই সুউচ্চ অবস্থানে উপস্থিত হবার জন্য প্রস্তুত না থাকে, সে প্রবেশ-ই করতে পারবে না। এটা কী করে সম্ভব যে দেহ ও মনের পাপ, আধ্যাত্মিক অবিশুদ্ধতা ও নীচতা সহকারে কেউ তার প্রভুর গেস্টহাউজে প্রবেশ করবে তাঁর সান্নিধ্য পাবার জন্য ?

সেজন্যে যোগ্যতা প্রয়োজন। প্রস্তুতি নেয়া দরকার। অন্ধকারের পর্দা দ্বারা আবৃত অসম্মানিত দূষিত হৃদয় নিয়ে কোনো ব্যক্তি এই আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও সত্যগুলো উপলব্ধি করতে পারবে না। সেজন্যে অবশ্যই সেসব পর্দা, যা আল্লাহর সাথে অন্তরের মিলিত হবার পথে বাধা, সেগুলিকে ছিন্ন করতে হবে। তবেই না কেউ চির প্রত্যাশিত খোদায়ী সান্নিধ্যে প্রবেশ করতে পারবে ৷

মানুষের অন্তরের পর্দা

খোদা ছাড়া অন্য যেকোনো কিছুর প্রতি মনোযোগ মানুষকে অন্ধকার ও আলোর পর্দা দিয়ে ঢেকে ফেলে। যদি কোনো দুনিয়াবী বিষয় মানুষের মনোযোগকে দুনিয়ার দিকে নিয়ে যায় এবং মহিমান্বিত খোদাকে উপেক্ষা করার কারণ হয়, তবে (অন্তরের উপর) অন্ধকার পর্দা পড়ে যায়। বস্তুজাগতিক দুনিয়ার সবই হলো অন্ধকার পর্দা। অপরপক্ষে, এই দুনিয়া যদি মহাসত্যের দিকে মনোযোগী হবার উপকরণ হয়, উপকরণ হয় পরকালীন বাসস্থান, যা হলো “সম্মানজনক আবাস” – সেখানে উপস্থিত হবার, তাহলে এই অন্ধকার পর্দাগুলো আলোর পর্দায় রূপান্তরিত হয়। “

ইমামগনের শেখান মুনাজাতে মহান খোদার নিকট অন্তরের দৃষ্টি এবং ঔজ্জ্বল্যের জন্য নিবেদন করা হয়, যেনো মুনাজাতকারী আলোর পর্দাগুলিকেও ছিন্ন করে মহত্ত্বের উৎসের নিকট পৌঁছে যায়। “যতক্ষণ না অন্তরের দৃষ্টি আলোর পর্দাকে এমনভাবে ছিন্ন করে যে, সে মহত্ত্বের উৎসের সাথে মিলিত হয়।”

কিন্তু যে ব্যক্তি এখন পর্যন্ত অন্ধকারের পর্দাগুলিই ছিন্ন করতে পারেনি, যে ব্যক্তি তার সকল মনোযোগ প্রাকৃতিক দুনিয়ার দিকে নিবদ্ধ করেছে, এবং আল্লাহ না করুন আল্লাহর থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে, এবং যে ব্যক্তি এই দুনিয়ার ঊর্ধ্ব অপর জগৎ এবং আধ্যাত্মিক জগতসমূহ সম্পর্কে মূলতঃ বেখবর, এবং নিজেকে এমন এক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে যে, সে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি, তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতাগুলিকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি, তার অন্তরকে আবৃত করে ফেলা অন্ধকারের পর্দাগুলিকে দূরে ঠেলার সিদ্ধান্ত নেয়নি – সে নিজেকে (জাহান্নামের) “অতল গহবরের” বাসিন্দা করে ফেলেছে, যা হলো চূড়ান্ত পর্দা : “অতঃপর তাকে নামিয়ে দিয়েছি নীচ থেকে নীচে।” (সূরা আত-ত্বীন, ৯৫:৫), অথচ যেখানে রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টির সর্বোচ্চ সম্মানিত অবস্থায় ও সম্মানজনক অবস্থান দিয়ে তৈরী করেছেন : “নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আত-ত্বীন, ৯৫:৪)।

কেউ যদি নিজের কামনার দাস হয়ে পড়ে, এবং যখন থেকে সে নিজেকে বুঝতে শুরু করে, তখন যদি নীচ দুনিয়াবি বিষয় ছাড়া অন্য কোনোদিকে মনোযোগ না দেয়, এবং মনে না করে যে এই নোংরা অন্ধকার দুনিয়ার ঊর্ধ্বে অন্য কোনো জায়গা ও অবস্থান রয়েছে, তাহলে সে অন্ধকারের পর্দায় ডুবে যাবে, এবং তাদের মত হয়ে যাবে, যাদের কথা বলা হয়েছে কুরআনে : “কিন্তু সে তো কেবলি অধঃপতিত ও নিজের রিপুর অনুগামী হয়েই রইলো।” (সূরা আল আ'রাফ, ৭:১৭৬)।

পাপ দ্বারা দূষিত এমন এক হৃদয়, অন্ধকারের পর্দা যাকে আবৃত করে ফেলেছে, এবং নানান পাপকর্মের দরুণ সেই অন্ধকার হৃদয় মহান খোদার থেকে এতই দূরে সরে গিয়েছে যে, প্রবৃত্তি ও কামনার অনুসরন আর শুধু দুনিয়ার লাভের পিছনে ছোটা তার বুদ্ধিমত্তা ও অন্তর্দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিয়েছে – এমন হৃদয়ের ব্যক্তি অন্ধকার পর্দার আবরণ থেকে মুক্ত হতে পারবে না; আলোর পর্দা ছিন্ন করে আল্লাহ ব্যতীত আর সকল কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা তো দূরের কথা।

এমন লোককেও তোমরা দেখবে যে, (আধ্যাত্মিকতার) এই বাস্তবতাগুলি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান আছে, কিন্তু এর উপর ঈমান নেই। যারা গোরস্থানে কাজ করে, তারা মৃত মানুষকে ভয় পায় না, কারণ তারা নিশ্চিতভাবে জানে যে মৃত মানুষ কারো ক্ষতি করতে পারে না; এমনকি মানুষটি যখন বেঁচে ছিলো, সেই দেহে আত্মা ছিলো, তখনও সে ক্ষতির কারণ ছিলো না, আর প্রাণবিহীন এই শূন্য খাঁচা কী-ই বা ক্ষতি করতে পারবে ? কিন্তু যারা মৃত মানুষকে ভয় পায়, তারা একারণে ভয় পায় যে, এই বিষয়ের সত্যতায় তাদের আস্থা নেই। তাদের কেবলমাত্র জ্ঞান আছে। তারা স্রষ্টা সম্পর্কে জানে, জানে প্রতিদান দিবস সম্পর্কে, কিন্তু তারা পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত নয়। তাদের বুদ্ধিশক্তি যা বুঝতে পেরেছে, সে ব্যাপারে তাদের অন্তর বেখবর। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ তারা জানে, জানে পুনরুত্থান দিবসের বাস্তবতা সম্পর্কেও, কিন্তু ঠিক এই ইন্টেলেকচুয়াল প্রমাণগুলিই হয়তো হৃদয়ের সামনে এমন এক পর্দা হিসাবে উপস্থিত হয়েছে, যা অন্তরে ঈমানের আলোকে জ্বলে উঠতে দিচ্ছে না। ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের অন্তরে ঈমানের আলো প্রজ্জ্বলিত হবে না, যতক্ষণ না মহান আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অন্ধকার ও বাধাবিঘ্ন হতে মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে আসেন : “যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক; তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।...” (সূরা বাকারা, ২:২৫৭)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যার অভিভাবক, তিনি যাকে অন্ধকার থেকে বের করে আনেন, সে আর একটি পাপও করে না, অপরের গিবত করে না, মানুষকে অপবাদ দেয় না, এবং সে কখনোই দ্বীনি ভাইদের প্রতি হিংসা-দ্বেষ পোষণ করে না। তার নিজের হৃদয়ই আলোকিত এক অনুভুতি দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়, এবং সে তখন আর দুনিয়া বা দুনিয়াবী বিষয়কে বেশি আদরণীয় করে দেখে না। যেমনটা ইমাম আলী (আ.) বলেছেন: “যদি আমাকে গোটা দুনিয়া আর এতে যা কিছু আছে তার সবকিছু দেয়া হতো, আর তার বিনিময়ে একটা পিঁপড়ার মুখ থেকে অন্যায়ভাবে, নিষ্ঠুরভাবে বার্লি দানার খোসা কেড়ে নিতে বলা হতো, আমি কখনোই সে প্রস্তাব গ্রহণ করতাম না।”

কিন্তু তোমাদের কেউ কেউ সব বিষয়ে নিজেদেরকে জড়াতে চাও; আর ইসলামের মহান স্কলারদের সম্পর্কে মন্দ কথা বলো। সাধারণ মানুষেরা যদি রাস্তার আতর বিক্রেতা কিংবা মুদি দোকানি সম্পর্কে গিবত করে তো তোমরা গিবত করো ইসলামের স্কলারদের, তাদেরকে অপমান করো, তাদের সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলো – কারণ তোমাদের ঈমান দৃঢ় নয় এবং কর্মফল যে ভোগ করতে হবে, সে ব্যাপারে তোমরা বিশ্বাস করো না।

আর কিছু নয়, বরং ইসমত (নিষ্পাপতা, নির্ভুলতা) হলো পরিপূর্ণ ঈমান। নিষ্পাপতা হলো আসলে ঈমান থেকে উৎসরিত। কোনো মানুষের যদি মহান আল্লাহ তায়ালার উপর ঈমান থাকে, এবং সে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে খোদাকে সেভাবেই দেখে, যেভাবে সে চোখ দিয়ে দেখে সূর্যকে, তাহলে তার দ্বারা কোনো পাপ সংঘটন সম্ভব হবে না। সশস্ত্র ব্যক্তির সামনে মানুষ যেমন “নিষ্পাপ” হয়ে যায়, অনেকটা তেমন। এই ভয়টা আসে খোদায়ী উপস্থিতির উপর বিশ্বাস থেকে, আর এই বিশ্বাস মানুষকে পাপ করা থেকে বিরত রাখে। মাসুমিন (আ.) (নিষ্পাপগণ) – তাঁদেরকে বিশুদ্ধ মাটি থেকে তৈরী করার পর তাঁদের আধ্যাত্মিক নিষ্ঠা, দীপ্তি ও সৎ গুনাবলী অর্জনের কারণে তাঁরা নিজেদেরকে খোদার সম্মুখে সদা-উপস্থিত হিসেবে দেখতেন, সর্বজ্ঞ আল্লাহর উপস্থিতিতে – যিনি সকল কিছু জানেন এবং সব বিষয়কে পরিবেষ্টন করে আছেন। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কথাটির তাৎপর্যের উপর তাঁদের ইমান আছে (পরিপূর্ণ আস্থা আছে), এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুই নশ্বর, আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই ক্ষমতা নেই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার : “...আল্লাহর সত্তা ছাড়া আর সকল কিছু ধ্বংস হবে...” (সূরা আল কাসাস, ২৮:৮৮)।

সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দুনিয়া-ই আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য – এই কথায় যদি মানুষের নিশ্চয়তা ও আস্থা থাকে, এবং মহান আল্লাহ তায়ালা সদা উপস্থিত ও সকল কিছু দেখেন – এতে যদি ঈমান থাকে, তবে সেই ব্যক্তির পাপ করার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। কিন্তু ঐশী উপস্থিতির (আল্লাহর উপস্থিতি) ব্যাপারে যদিওবা তার জ্ঞান আছে, কিন্তু আস্থা নেই (ঈমান নেই)। নানামুখী পাপ তার হৃদয়কে অন্ধকার ও কালো করে দিয়েছে, যার ফলে এই সত্যগুলিকে মেনে নিতেই সে অক্ষম হয়ে পড়েছে, এবং এমনকি এগুলোকে অবাস্তবও মনে করছে হয়তো।

প্রকৃতপক্ষে, মানুষ কখনোই বেপরোয়া জীবন যাপন করতো না, যদি সে নিশ্চিত না হোক, একে অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা হিসেবে মনে করতো যে, পবিত্র কুরআনে যা বলা হয়েছে তা সত্য, যে ওয়াদাগুলো করা হয়েছে, যে শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে – এগুলো সত্য, এবং তার উচিত তার পথ ও কর্মকে সংশোধন করা। যদি তোমরা এমন কথা শুনতে যে এই রাস্তা দিয়ে গেলে হিংস্র প্রাণীর মুখোমুখি হতে হবে কিংবা এই রাস্তায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আছে যারা তোমাকে অপহরণ করবে, তাহলে ঠিকই ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাদ দিতে, এবং তথ্যটার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের চেষ্টা করতে। “জাহান্নাম বলে একটা কিছু হয়তো আছে যেখানে (পাপকর্মের শাস্তি হিসেবে) অনন্তকাল আগুনের মধ্যে থাকতে হবে” – কেউ এটা মনে করবে, অথচ একইসাথে পাপকাজও করে যেতে থাকবে – এটা কী করে সম্ভব ?

যে ব্যক্তি মনে করে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ সদা বিরাজমান ও সবকিছু দেখছেন, এবং সে নিজেকেও তার রবের সামনে উপস্থিত বলে অনুভব করে, যে মনে করে যে তার কথা ও কর্মের প্রতিফল দেয়া হবে, বিচার হবে, শাস্তি হবে, এবং এই দুনিয়ায় নেয়া তার প্রতিটা পদক্ষেপ, উচ্চারিত প্রতিটি কথা, কৃত কর্মগুলো – সবকিছুই রাক্বিব ও আতিদ নামক আল্লাহর ফেরেশতা দ্বারা রেকর্ড করা হচ্ছে, এবং তারা খুব ভালোভাবেই সেটা রেকর্ড করছে – এমতাবস্থায় কি সেই ব্যক্তি নিজের ভুল ও পাপকর্মের ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারে ? মানুষ এমনকি এই সত্যগুলোকে “সম্ভব” বলেও মনে করে না – এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যাপার। কারো কারো আচার আচরণ ও জীবন যাপন দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে অপার্থিব জগতের অস্তিত্বকেই তারা সম্ভব বলে মনে করে না; কারণ পরকালের জগতটাকে কেবলমাত্র “সম্ভব” বলে মনে করাটাই মানুষকে অসংখ্য ভুল ও পাপ থেকে দূরে রাখে।

আত্মশুদ্ধির পথে প্রথম পদক্ষেপ:

আর কতকাল তোমরা গাফিলতির মাঝে ঘুমিয়ে থাকতে চাও ? এইভাবে পাপে নিমজ্জিত হয়ে ? খোদাকে ভয় করো ! তোমার কর্মফলের ব্যাপারে সতর্ক হও ! গাফিলতির এই ঘুম থেকে জেগে ওঠো ! না, তোমরা এখনও জেগে ওঠোনি। তোমরা এখনও প্রথম পদক্ষেপটিই নাওনি। (খোদামুখী) অভিযাত্রার পথে প্রথম পদক্ষেপ হলো ইয়াক্বযাহ (জেগে ওঠা), কিন্তু তোমরা এখনও ঘুমিয়ে আছো। তোমাদের চোখ হয়তো খোলা আছে, কিন্তু হৃদয় ঘুমিয়ে আছে। তোমাদের অন্তর যদি ঘুমিয়ে না থাকতো এবং পাপকর্মের দরুণ কালো না হতো, মরিচা না ধরতো, তাহলে এমন উদাসীনভাবে বেখেয়াল হয়ে নিজেদের অনুচিত কথা-কর্ম চালিয়ে যেতে না। পরকালীন দুনিয়া নিয়ে যদি একটু ভাবতে, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে চিন্তা করতে, তবে তোমরা নিজেদের দায়িত্বগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে ৷ (এই দুনিয়ার বাইরেও) আরেকটা দুনিয়া আছে, পুনরুত্থান আছে। (মানুষ অন্যান্য সৃষ্টির মত নয়, যাদের কোনো প্রত্যাবর্তন নেই।) কেনো তোমরা সাবধান হচ্ছো না ? কেনো জেগে উঠছো না, সচেতন হচ্ছো না ? কেনো নিতান্তই অসতর্কভাবে নিজের মুসলিম ভাইয়ের গিবতে লিপ্ত হচ্ছো, তার সম্পর্কে মন্দ কথা বলছো, অথবা এগুলো শুনছো ? তোমরা কি জানো না যে, যে জিহবা গিবতে লিপ্ত হয়, কেয়ামতের দিন তাকে পদদলিত করা হবে ? গিবত যে জাহান্নামীদের খাবার, তা শুনেছো ? কখনো কি চিন্তা করে দেখোনি এই বিভেদ, শত্রুতা, ঈর্ষা, সন্দেহপ্রবণতা, স্বার্থপরতা আর অহংকার-ঔদ্ধত্যের ফলাফল কতটা মন্দ ? এসব মন্দ নিষিদ্ধ কাজের সূদুরপ্রসারী ফলাফল হলো জাহান্নাম, আর আল্লাহ না করুন, এসব কাজ এমনকি চিরস্থায়ী আগুনের দিকে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে, তা জানো কি ?

আল্লাহ চান না মানুষ এমন রোগে আক্রান্ত হোক, যাতে কষ্ট অনুভুত হয় না। কারণ রোগে কষ্ট অনুভুত হলে মানুষ বাধ্য হয় প্রতিকার খুঁজতে, ডাক্তারের কাছে বা হসপিটালে যেতে, কিন্তু যে রোগে কোনো কষ্ট অনুভুত হয় না, তা আরো ভয়ানক। যতক্ষণে সেটা ধরা পড়ে, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। মানসিক অসুস্থতার কারণে যদি ব্যথা অনুভুত হতো, তাহলে সেই ব্যথার জন্য খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো যেতো। কারণ মানুষ বাধ্য হয়ে শেষমেষ প্রতিকার খুঁজতো। কিন্তু ব্যথাহীন এই ভয়ানক রোগের সমাধান কী ? অহংকার ও স্বার্থপরতার রোগের কোনো কষ্ট নেই। (এগুলো ছাড়াও) অন্যান্য পাপ মানুষের হৃদয় ও আত্মাকে দূষিত করে ফেলে, কোনোরূপ ব্যথা অনুভুত হওয়া ছাড়াই। এসব রোগে যে শুধু ব্যথা অনুভুত হয় না, তা নয়, বরং এতে আপাতঃ আনন্দও পাওয়া যায়। পরচর্চার আড্ডাগুলো খুবই আনন্দের ! নিজের প্রতি ভালোবাসা আর দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা, যা হলো সকল পাপের মূল, তা-ও সুখকর। ড্রপসি রোগে আক্রান্ত রোগী পানির কারনেই মারা যায়, তবুও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পানি খাওয়াকে উপভোগ করে।

এটাই স্বাভাবিক যে, অসুস্থতার কারণে যদি মানুষ আনন্দ পায়, আর তাতে কোনো ব্যথা-বেদনাও না থাকে, তবে সে এর কোনো প্রতিকার খুঁজবে না। যতই তাকে সতর্ক করা হোক না কেনো যে এটা প্রাণঘাতী রোগ, সে বিশ্বাসই করবে না ! যদি কাউকে ভোগবাদিতা ও দুনিয়াপূজার রোগে পেয়ে বসে, আর দুনিয়ার প্রতি মায়ায় তার অন্তর আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তবে দুনিয়া আর দুনিয়াবী জিনিস ছাড়া অন্য যেকোনো কিছুতেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আল্লাহ না করুন, তখন সে হবে আল্লাহর শত্রু, আল্লাহর বান্দাদের শত্রু, নবী-আউলিয়াগণ ও আল্লাহর ফেরেশতাদের শত্রু। তাদেরকে সে অপছন্দ করবে, ঘৃণা করবে। আর যখন খোদার তরফ থেকে ফেরেশতা তার জান কবজ করতে আসবে, তখন তার ঘৃণাবোধ হবে, বিকর্ষণ হবে, কারণ সে দেখবে যে খোদার ফেরেশতা তাকে তার প্রিয়বস্তু (দুনিয়া ও দুনিয়াবী জিনিস) থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।

সেক্ষেত্রে এমনও সম্ভব যে সেই ব্যক্তি আল্লাহদ্রোহী হয়ে, খোদায়ী উপস্থিতির প্রতি শত্রুতা পোষণ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। কাযভিন এর অন্যতম মহৎ ব্যক্তি (তাঁর উপর সালাম) বলেছিলেন যে, তিনি একবার এক লোকের মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলেন। জীবনের শেষ মুহুর্তে সে চোখ খুলে বলেছিলো, “খোদা আমার উপর যে জুলুম করেছেন, আর কারো উপর এত জুলুম করা হয়নি ! খোদা এখন আমায় এই সন্তানদের থেকে আলাদা করতে চান, যাদেরকে বড় করতে আমি এত কষ্ট সহ্য করেছি। এর চেয়ে বড় জুলুম কি আর আছে ?” কেউ যদি নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে, দুনিয়া থেকে নজর ফিরিয়ে না নেয়, এবং অন্তর থেকে দুনিয়ার মায়াকে বিতাড়িত না করে, তাহলে আশঙ্কা থেকে যায় যে, খোদার প্রতি এবং তাঁর আউলিয়াগণের প্রতি উপচে-পড়া রাগ ও ঘৃণা নিয়ে সে দুনিয়া ত্যাগ করবে। তাকে ভয়ানক পরিণাম বরণ করতে হবে। এধরণের লাগামহীন বেপরোয়া মানুষকে কি আশরাফুল মাখলুকাত বলা উচিত, নাকি বলা উচিত আসফালাস সাফিলিন (নিকৃষ্টদের মধ্যে নিকৃষ্টতম) ? “সময়ের শপথ। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।” কুরআনের এই সূরা অনুযায়ী, (সবাই-ই ক্ষতিগ্রস্ত) কেবলমাত্র ব্যতিক্রম হলো সেইসব বিশ্বাসীগণ, যারা সৎকাজ করে। আর সৎকাজ অবশ্যই আত্মার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু তোমরা দেখবে যে, মানুষের অধিকাংশ কাজই (আত্মার সাথে নয়, বরং) দেহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না। যদি তুমি দুনিয়া ও নিজের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা পরিচালিত হও, আর এই মায়া যদি তোমাকে আধ্যাত্মিক সত্য ও বাস্তবতাগুলো অনুধাবন করতে বাধা দেয়, বাধা দেয় নির্ভেজালভাবে আল্লাহর রাহে কাজ করতে, সৎকাজের আদেশ ও সবরের তাকিদ করতে, আর ফলশ্রুতিতে সঠিক পথনির্দেশ গ্রহণ করা বাধাগ্রস্ত হয়, তবে তুমি পথভ্রষ্ট ৷ থভ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে যাবে এই দুনিয়ায়, এবং পরকালেও; কারণ যৌবন তুমি শেষ করে ফেলবে, বঞ্চিত হবে স্বর্গীয় সুখ ও পরকালীন অন্যান্য সৌভাগ্য থেকে, এমনকি দুনিয়াবী সৌভাগ্য থেকেও। অন্যান্য মানুষের যদি জান্নাতে যাবার কোনো পথ না-ও থাকে, ঐশী দয়ার দরজা যদি তাদের জন্য বন্ধও হয়ে যায়, যদি জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল বসবাস তাদের জন্য নির্ধারিতও হয়ে যায়, তবুও তারা তো অন্তত এই দুনিয়ার জীবনটাকে সর্বোচ্চ ভোগ করে নেবে, দুনিয়াবী আরাম-আয়েশ উপভোগ করবে, কিন্তু তুমি ?...

সাবধান ! দুনিয়া ও আত্মপ্রেম না আবার তোমাদের মাঝে এতটা বৃদ্ধি পায় যে, শয়তান তোমাদের ঈমান কেড়ে নিতে সক্ষম হবে ! বলা হয় যে, শয়তানের সকল প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষের ঈমান কেড়ে নেয়া। শয়তানের দিবারাত্র সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা হলো মানুষকে ঈমানহারা করার জন্য। ঈমানের গ্যারান্টির দলিল তো তোমাকে কেউ দেয়নি। হয়তো কারো ঈমানটাই ধার করা (অর্থাৎ দৃঢ় নয়), এবং শেষমেষ শয়তান সেটাকে পেয়ে বসবে, আর সে এই দুনিয়া ত্যাগ করবে অন্তরে মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর আউলিয়াগণের প্রতি শত্রুতা নিয়ে। আবার হয়তো কেউ জীবনভর ঐশী দয়া পেয়েও শেষজীবনে এসে হতাশ হয়ে ঈমান ত্যাগ করলো, আর দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো রহমান রহিম আল্লাহর বিরোধী হয়ে।

যদি দুনিয়াবী বিষয়ে তোমার কোনো আগ্রহ থাকে, সম্পর্ক থাকে, দুনিয়ার প্রতি মায়া থাকে – তবে তা ছিন্ন করতে চেষ্টা করো। বাহ্যিক জাঁকজমকের এই দুনিয়া এতই তুচ্ছ যে সে ভালোবাসা পাবার যোগ্য নয়। আর যারা দুনিয়ার জীবনের এই তুচ্ছ বাহ্যিক জাঁকজমক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, দুনিয়ার জীবন তো তাদের ভালোবাসা পাবার যোগ্য-ই নয়। এই দুনিয়ার জীবনে তোমাদের কী আছে যে এর প্রতি তোমরা আসক্ত হবে ? মসজিদ, মাদ্রাসা, নামাজের জায়গা কিংবা ঘরের কোণটি ছাড়া তোমাদের আর কিছুই নেই। আর এর জন্য প্রতিযোগীতা করা কি তোমাদের সাজে ?

এগুলো কি তোমাদের ভিতরে মতানৈক্য সৃষ্টি আর সমাজকে দূষিত করার কারণ হতে পারে ? ধরো, দুনিয়াবী মানুষদের মতন তোমাদের জীবনও আরামদায়ক বিলাসী জীবন, আর আল্লাহ না করুন, সেই জীবনটাকে তোমরা ভোগ-বিলাস, পানাহারে কাটিয়ে দিয়েছো। এরপর এই জীবনটা যখন শেষ হবে, তখন দেখবে যে জীবনটা এক সুখ-স্বপ্নের মতন পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই জীবনের প্রতিফল ও দায়বদ্ধতাগুলো ঠিকঠিক সাথেই থাকবে। অনন্ত শাস্তির তুলনায় এই সংক্ষিপ্ত আপাতঃ সুখকর জীবনের (ধরে নিলাম এই জীবন সুখকর) কী মূল্য আছে ? দুনিয়াবী মানুষের শাস্তি কখনো কখনো অনন্তকালের জন্য। দুনিয়াবী মানুষেরা, যারা ভাবে যে তারা দুনিয়াবী সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে লাভবান হয়েছে, তারা ব্যর্থ হয়েছে, এবং তারা ভুলের মধ্যে আছে। সবাই দুনিয়াকে নিজের পরিবেশ-পরিস্থিতির জানালা দিয়ে দেখে, আর মনে করে যে সে যেটুকু দেখেছে, সেটাই হলো দুনিয়া। বস্তুজাগতিক দুনিয়ার যেটুকু মানুষ বিচরণ করেছে ও আবিষ্কার করেছে, বস্তুজাগতিক দুনিয়া তার চেয়ে অনেক বেশি বড়। গোটা এই জগতটার সম্পর্কে বর্ননা আছে যে, “আল্লাহ কখনো এর দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকান নাই।” (বিহারুল আনওয়ার, অধ্যায় ১২২, হাদিস ১০৯) তবে সেই অপর জগতটি কেমন, যার দিকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন ? যে মহত্বের উৎসের দিকে (আল্লাহর পরম সান্নিধ্যের দিকে) মানুষকে আহবান জানানো হয়েছে, তা আসলে কী রকম ?

তুমি যদি নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করো, কর্মকে সংশোধন করো, অন্তর থেকে ক্ষমতার লোভ, পদ-পদবীর প্রতি আকর্ষণ, আত্ন-কেন্দ্রীকতা ইত্যাদি দূর করো, তবে তোমার জন্য একটা উচ্চ মর্যাদার স্থান তৈরী হবে। আল্লাহর সৎ বান্দাদের জন্য যে উচ্চ মর্যাদার স্থান প্রস্তুত করা হয়, তার তুলনায় গোটা দুনিয়া ও এর বাহ্যিক সকল বিষয়ের এমনকি এক পয়সা মূল্য নেই। এই সুউচ্চ অবস্থান অর্জনের চেষ্টা করো। যদি পারো তো নিজেদের কাজে লাগাও, এমনভাবে আত্মোন্নয়ন করো যেনো তোমরা এমনকি এই সুউচ্চ অবস্থানের দিকেও নজর না দাও। এই সুউচ্চ অবস্থান অর্জনের জন্য আল্লাহর ইবাদত কোরো না। বরং খোদাকে ডাকো, মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে তাঁকে সেজদা করো কারণ তিনিই ইবাদতের একমাত্র যোগ্য, সর্বশক্তিমান। তবেই আলোর পর্দা ছিন্ন করে মহত্ত্বের উৎসকে লাভ করতে পারবে। কিন্তু এমন অবস্থান কি তোমার বর্তমান কথা-কর্ম দ্বারা অর্জন করা সম্ভব ? তুমি যে পথে হাঁটছো, সে পথে কি সেই অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব ? খোদায়ী শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া, জাহান্নামের আগুনের ভয়াবহতা থেকে পালানো কি এতই সহজ ? নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) আল্লাহর কাছে অশ্রুপাত ও ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর কান্না যে আসলে আমাদের জন্য শিক্ষা, এবং এর মাধ্যমে তাঁরা অন্যদের শিখাতে চেয়েছেন কিভাবে আল্লাহর কাছে কাঁদতে হয়, তা কি বোঝো ? এত উচ্চ আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর কাছে সুউচ্চ অবস্থান অর্জন করার পরও তারা খোদার ভয়ে অশ্রুপাত করতেন ! তাঁরা বুঝতেন যে সামনে এগিয়ে চলার পথ কতটা কঠিন ও ভয়ানক। সিরাত, যার একপাশে হলো এই দুনিয়া আর অন্যপাশে পরকালীন দুনিয়া, আর যা জাহান্নামের মধ্য দিয়ে গেছে – সেই সিরাত অতিক্রম করার পরিশ্রম, কষ্ট ও দুঃসাধ্যতা সম্পর্কে তাঁরা সচেতন ছিলেন। তাঁরা আলমে বারযাখ (কবরের জগৎ) সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, সচেতন ছিলেন পুনরুত্থানের ব্যাপারে, শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে। তাই তাঁরা কখনোই তৃপ্ত ছিলেন না, সদা সর্বদা ঐশী শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।

এসব ভয়াবহ শাস্তি নিয়ে তোমরা কী চিন্তা করেছো ? আর তা থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় নিয়ে ? কখন তোমরা আত্মসংস্কার ও আত্মশুদ্ধির সিদ্ধান্ত নেবে ? এখন, যতদিন তোমাদের বয়স কম, যৌবনের শক্তি আছে নিজেদের ভিতর, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার শক্তি আছে, শারীরিক দুর্বলতা পেয়ে বসেনি এখনো, এমন সময় যদি পরিশুদ্ধির চিন্তা না করো, নিজেদের গড়ে না তোলো, তাহলে যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে, তোমাদের দেহমন দুর্বলতার কবলে পড়বে, ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ়তা, প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, পাপের বোঝা তোমাদের হৃদয়কে কালো করে ফেলবে – তখন কিভাবে পরিশুদ্ধ হবে, নিজেকে গড়ে তুলবে ? জীবনের ফেলে আসা প্রতিটা মুহুর্ত, প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে সাথে আত্মসংস্কার আরো কঠিন হয়ে আসে, আর অন্তরের ব্যাধি ও অন্ধকার বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়তে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শক্তি কমে আসে, নেতিবাচক গুনাবলী বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে আত্মশুদ্ধি, সদগুণাবলী ও তাক্বওয়া অর্জন কঠিন হয়ে যায়। মানুষ তখন আর তওবা করতে পারে না। তওবা তো আর কেবল মুখে বলা নয় যে “আমি আল্লাহর কাছে তওবা করলাম”, বরং অনুতপ্ত হওয়া ও পাপকর্ম ত্যাগ করাই হলো তওবা। যে ব্যক্তি পঞ্চাশ কিংবা সত্তর বছর যাবৎ মিথ্যা, গিবত ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিলো, পাপ আর সীমালঙ্ঘন করতে করতেই যার দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছে, তার পক্ষে এভাবে অনুতপ্ত হয়ে পাপকর্ম ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। এমন মানুষেরা জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পাপেই নিমজ্জিত থাকে।

তরুণ যুবকদের নিষ্কর্মা বসে থেকে বয়সের ভারে সাদা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত নয়। (আমি বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়েছি, বৃদ্ধ বয়সের দূর্ভাগ্য ও কষ্ট সম্পর্কে আমি জানি।) তরুণ বয়সেই তোমরা কিছু অর্জন করতে পারবে। যতদিন যৌবনের শক্তি ও দৃঢ়তা আছে, তোমরা নিজেদের স্বার্থপর কামনা-বাসনাগুলোকে বিতাড়িত করতে পারবে, দূর করতে পারবে দুনিয়াবী আকর্ষণ ও পাশবিক বৃত্তিগুলোকে। কিন্তু যদি তরুণ বয়সেই আত্মসংস্কারের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলার চিন্তা না করো, তাহলে যখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হবে, ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যাবে। বয়স থাকতে থাকতেই চিন্তা করো, শ্রান্ত-ক্লান্ত বৃদ্ধ হবার আগেই চিন্তা করো। তরুণ অন্তর হলো জান্নাতী হৃদয়, এই অন্তরে রোগের প্রতি ঝোঁক কম থাকে। কিন্তু বয়স্ক মানুষের অন্তরে রোগের প্রতি ঝোঁক থাকে প্রবল, তার হৃদয়ে পাপের শেকড় এতটাই গভীর ও দৃঢ় যে তা উৎপাটন করা যায় না।

মানুষ যখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়, তখন অন্তরকে প্রকৃত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন। আল্লাহ না করুন, যদি আত্মশুদ্ধি না করেই দুনিয়া ত্যাগ করো, তাহলে কিভাবে খোদার সামনে দাঁড়াবে, যেখানে তোমার অন্তরটা কালো হয়ে গিয়েছে, চোখ-কান-জিহবা পাপে কলুষিত হয়ে গিয়েছে ? যে জিনিস পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ অবস্থায় তোমাকে দেয়া হয়েছিলো, আস্থা ভঙ্গ করে তাকে কলুষিত করে কিভাবে সেটা আল্লাহর কাছে ফেরত দেবে ? এই চোখ, কান, যা তোমার নিয়ন্ত্রণাধীন, এই হাত, এই জিহবা, যা তোমার আদেশ মেনে চলছে, শরীরের এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ – এগুলো সবই তোমার কাছে সর্বশক্তিমান খোদার আমানত, আর এগুলো তোমাকে দেয়া হয়েছিলো শতভাগ পবিত্র, বিশুদ্ধ অবস্থায়। এগুলো দিয়ে পাপকর্ম করলে তা অবিশুদ্ধ, কলূষিত হয়ে যায়। আল্লাহ না করুন, এগুলো যদি নিষিদ্ধ কর্মের দ্বারা কলুষিত হয়ে যায়, তাহলে যখন আমানত ফেরত দেবার সময় আসবে, তখন হয়তো জিজ্ঞাসা করা হবে যে, আমানতের জিনিস কি এভাবেই রক্ষা করতে হয় (যেভাবে তুমি একে রেখেছিলে) ? যখন তোমার কাছে আমানত রাখা হয়েছিলো, তখন কি এগুলো এই অবস্থায়ই ছিলো ? তোমাকে যে অন্তর দেয়া হয়েছিলো, সেটার কি এই দশা ছিলো ? তোমাকে যে দৃষ্টি দান করা হয়েছিলো, তা কি এমনই ছিলো ? তোমার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যাকে তোমার ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়েছিলো, সেগুলো কি এরকম নোংরা আর কলুষিত ছিলো ? আমানতের এত বড় খেয়ানত করে কিভাবে খোদার সামনে দাঁড়াবে ?

তোমরা এখনও তরুণ। তোমরা এমনভাবে জীবন যাপন করেছো যে, দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক আরাম-আয়েশই ত্যাগ করেছো। এখন যদি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়, যৌবনের সুসময়গুলো খোদার পথে ব্যয় করো নির্দিষ্ট পবিত্র এক লক্ষ্য নিয়ে, তাহলেই এই জীবনটা আর ব্যর্থ হবে না; বরং ইহকাল ও পরকাল তোমারই হবে। কিন্তু তোমাদের আচার-আচরণ যদি এমনই থেকে যায় যেমনটা দেখা যাচ্ছে, তাহলে তোমরা যৌবনকে নষ্ট করেছো এবং জীবনের সবচে সুন্দর সময়টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। পরকালে খোদার সামনে তোমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে, তিরস্কার করা হবে, এবং খোদাদ্রোহী কাজকর্মের শাস্তি কেবল ঐ দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এই দুনিয়াতেও নানাবিধ কষ্ট-ক্লেশ, দুর্গতি, সমস্যা ইত্যাদি তোমাদের আঁকড়ে ধরবে, আর দুর্ভাগ্যের ঘূর্ণিস্রোতে পড়ে যাবে ৷

আমি এখন জীবনের শেষ দিনগুলি পার করছি। আজ হোক কাল হোক আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু তোমাদের সামনে এখনও অনেক বিপদ রয়েছে; আমি কালো অন্ধকার দিন দেখতে পাচ্ছি। যদি তোমরা নিজেদের কে সংশোধন না করো, প্রস্তুত না হও, এবং যদি তোমাদের অধ্যয়ন ও জীবনযাত্রাকে নিয়মমাফিক পরিচালনা না করো, তাহলে, আল্লাহ না করুন, তোমরা শেষ হয়ে যাবে। সুযোগ হারানোর আগেই, প্রতিটা ধর্মীয় ও তত্ত্বীয় বিষয়ে শত্রুর কবলে পড়ার আগেই চিন্তা করো ! ঘুম ভাঙো ! জেগে ওঠো !

মানুষের প্রথম কাজ হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের ও আত্মসংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া। প্রস্তুত হও, নিজেদের গুছিয়ে নাও। একজন অসৎ আলেম, যে দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যে নিজের পদ-পদবী রক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত, এমন স্কলার কখনো ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না। বরং সে অন্যান্যদের তুলনায় ইসলামের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর হবে। খোদার তরে একটি পদক্ষেপ নাও। অন্তর থেকে দুনিয়ার প্রতি মায়া দূর করে দাও। তবেই তোমরা জিহাদ করতে পারবে। এখন থেকে এই বিষয়টাই তোমার অন্তরে গড়ে তোলো, জাগিয়ে তোলো যে, আমি অবশ্যই ইসলামের একজন সক্রিয়-সশস্ত্র যোদ্ধা হবো, ইসলামের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবো। শেষ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি ইসলামের জন্য কাজ করে যাবো। “এখনও সময় হইনি অথবা চরম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটা উপযুক্ত সময় না”, এসব কথা বলে অজুহাত তৈরী কোরো না। ইসলামের কাজে লাগার চেষ্টা করো। সংক্ষেপে, মানুষ হয়ে ওঠো ! উপনিবেশবাদীরা প্রকৃত মানুষকে ভয় পায়। তারা মানুষের ভয়ে ভীত। ধর্মশিক্ষাকেন্দ্র ও জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রগুলো মানুষ গড়ার কারখানা হবে, তা উপনিবেশবাদীদের চায় না। তারা মানুষকে ভয় পায়। কোনো দেশে যদি একজন হলেও প্রকৃত মানুষ পাওয়া যায়, সেটা তাদেরকে অসুবিধায় ফেলে, তাদের স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলে ৷

নিজেদেরকে গড়ে তোলা তোমাদের দায়িত্ব, দায়িত্ব হলো নিখুঁত, নির্ভেজাল পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠা, ইসলামের শত্রুদের নোংরা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যদি তোমরা সুসংগঠিত ও প্রস্তুত না হও, ইসলামের উপর যে চাবুকের আঘাত প্রতিনিয়ত আসছে, যদি তার বিরুদ্ধে লড়াই না করো, তবে যে কেবল তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে তা-ই না, বরং ইসলামের রীতি-নীতি আইন-কানুনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; আর এর জন্য তোমরাই দায়ী থাকবে। তোমরা আলেমরা ! এই স্কলাররা ! তোমরা মুসলিমেরা ! তোমরা দায়ী থাকবে। “তোমরা সবাই দ্বায়ীত্বশীল, আর উম্মাহর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তোমাদেরই।” তোমাদের যুবকদের অবশ্যই নিজের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করতে হবে যেনো প্রতিটা শোষণ-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারো। এছাড়া ভিন্ন কোনো পন্থা নেই : তোমাদের মর্যাদা, ইসলামের মর্যাদা, ইসলামী রাষ্ট্রের মর্যাদা তোমাদের প্রতিরোধের উপর নির্ভরশীল ৷

হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ ! ইসলামকে, মুসলমানদেরকে ও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে বিদেশী শত্রু-শয়তান থেকে রক্ষা করো। ইসলামের উলামা ও মহান মারজাগণকে (অনুসরণযোগ্য আলেম) পবিত্র কুরআনের আইনের পক্ষে লড়াইয়ে সাহায্য ও বিজয় দান করো, ইসলামের পবিত্র আদর্শ প্রচারে তাদেরকে সহায়তা করো। ইসলামের বর্তমান যুগের আলেমগণকে তাদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে এবং ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোকে ইসলামের শত্রুদের প্রভাবমুক্ত করো এবং উপনিবেশবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করো, নিরাপদে রাখো। তরুণ আলেমগণকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে এবং গোটা মুসলিম জাতিকে আত্মগঠন ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের তৌফিক ও সাফল্য দান করো। ইসলামের জনগণকে মুক্তি দাও অজ্ঞতার ঘুম থেকে, দুর্বলতা থেকে, ঔদাসীন্য ও চিন্তার অনমনীয়তা থেকে, যেনো কুরআনের দ্যুতিময় বৈপ্লবিক শিক্ষা গ্রহণ করে তারা ফিরে আসতে পারে, জেগে ওঠে, এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ছায়াতলে এসে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ থেকে উপনিবেশবাদী ও ইসলামের চিরশত্রুদের শেকড় কেটে দিতে পারে, যেনো মুসলিম জাতি ফিরে পায় হারানো স্বাধীনতা, মুক্তি, আভিজাত্য ও মহত্ত্ব।“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে দান করো ধৈর্য্য, এবং আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখো, আর আমাদের সাহায্য কর সে কাফের জাতির বিরুদ্ধে।” (সূরা বাক্বারা, ২:২৫০)

(মূলঃ-আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমিনি (রহঃ), অনুবাদঃ- নুরে আলম মাসুদ, সংকলনে-কামরুল হাসান)

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)