আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আন'আম;(৩৭তম পর্ব)

1 বিভিন্ন মতামত 03.0 / 5

সূরা আন'আম; আয়াত ১৫৮-১৬১

সূরা আন’আমের ১৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آَيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آَيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آَمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلِ انْتَظِرُوا إِنَّا مُنْتَظِرُونَ

“তারা শুধু এ বিষয়ের দিকে চেয়ে আছে যে, তাদের কাছে ফেরেশতা আসবে কিংবা আপনার প্রতিপালক (নিজেই) আগমন করবেন অথবা আপনার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে। যেদিন আপনার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে, সেদিন এমন কোন ব্যক্তির বিশ্বাস স্থাপন তার জন্য ফলপ্রসূ হবে না যে আগে থেকে ঈমান আনেনি কিংবা নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী কোনরকম সতকর্ম করেনি। আপনি বলে দিন : তোমরা পথের দিকে চেয়ে থাকো, আমরাও পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।” (৬:১৫৮)

গত পর্বে আমরা বলেছি, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রধান মুজেযা বা অলৌকিক ক্ষমতা ছিল মহাগ্রন্থ কুরআন। এ কিতাব একইসঙ্গে ইসলামের আইন এবং মুজিযা। কিন্তু মুশরিক ও কাফেররা উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ ছাড়াই কিংবা পবিত্র কুরআনের মতো আয়াত বা সূরা উপস্থাপন করতে না পেরেই অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির কারণে কুরআনের নির্দেশাবলী প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা মহানবীর কাছে ফেরেশতাদের অবতীর্ণ করার মতো আরো অলৌকিক ঘটনা প্রত্যাশা করছিল। তারা আরো বলছিল, আল্লাহ কেন আসমান থেকে নেমে আসেন না কিংবা বজ্রপাতের মতো কোন ভয়ঙ্কর ঘটনার মাধ্যমে কেন আল্লাহর বাণীর সত্যতা প্রমাণ করা হয় না।

এসব অজুহাতের জবাবে বিশ্বনবী (সা.) মুশরিক ও কাফেরদের বলেন : তোমরা ঈমান আননি, কাজেই এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটলে তা তোমাদের কোন কাজে আসবে না। কারণ, তোমাদের কুফরির কারণে ঐশি আজাব নাযিল হবে এবং তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। সেই ঈমানদার আল্লাহর কাছে প্রিয় যিনি সত্য উপলব্ধি করে জ্ঞান-বুদ্ধির ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ভয়, শঙ্কা কিংবা অলৌকিক ঘটনা দেখে আনা ঈমান টেকসই হয় না। তোমরা যে ধরনের আয়াত নাজিলের আহবান জানাচ্ছো- তা নাজিল হলে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে এবং তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আল্লাহর নবী হযরত সালেহ (আ.) –এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি তার সম্প্রদায়ের লোকজনের দাবি মেনে নিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি উট বের করে এনেছিলেন। কিন্তু মানুষ এটি দেখে ঈমান আনার পরিবর্তে উটটিকে হত্যা করেছিল। ফলে আল্লাহ ওই সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. গোঁড়া কাফেররা ঐশি মুজিযা দেখেও আল্লাহর নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে না। কাজেই অনর্থক তাদের জন্য এ ধরনের নিদর্শন উপস্থাপন করে লাভ নেই।

দুই. ইসলামে ঈমানহীন আমল কিংবা আমলহীন ঈমানের কোন মূল্য নেই।

সূরা আন’আমের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

“নিশ্চয়ই যারা নিজ ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয়টি আল্লাহ তা’য়ালার কাছে অর্পিত। এরপর তিনি বলে দেবেন যা কিছু তারা করে থাকে।” (৬:১৫৯)

শুধু কাফের ও মুশরিকরাই নয়, সেইসঙ্গে যেসব মুমিন ঈমানদার হওয়ার দাবি করা সত্ত্বেও কুসংস্কার ও নিজ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা করে সমাজে মতভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করে তাদের বিচার মহান আল্লাহ নিজ হাতে করবেন। কাল কেয়ামতের কঠিন দিনে এ ধরনের ভ্রান্ত কাজের জন্য তাদেরকে কঠিনভাবে জবাবদিহী করতে হবে।

পবিত্র কুরআন অন্যান্য আসমানি গ্রন্থের অনুসারীদের যেসব সমালোচনা করে তার একটি হচ্ছে, তারা তাদের গ্রন্থকে বিকৃত করে ফেলেছে। কুরআন ছাড়া অন্য কোন আসমানি কিতাব বর্তমান পৃথিবীতে আর অবিকৃত নেই। পবিত্র কুরআন সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। কিন্তু কুরআনের ব্যাখ্যা ও হাদিস বর্ণনায় ভিন্নতা বা মতপার্থক্য দেখা দেয়ার কারণে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। যারা এ মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছেন মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের জন্য তাদেরকে আল্লাহর দরবারে অবশ্যই জবাবদিহী করতে হবে।

এ ছাড়া, মুসলিম আলেম সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে, সমাজে ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার ও বেদআতগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করে সেগুলোর মূলোতপাটন করা। তা করতে পারলেই মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হবে।

এ আয়াত থেকে আমরা যেসব বিষয় শিখতে পারে সেগুলো হচ্ছে :

এক. ধর্মের প্রতিটি নির্দেশ ও হুকুম-আহকামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কিছু অংশের প্রতি বিশ্বাস এবং কিছু অংশকে অস্বীকার ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

দুই. কুরআনের তাফসির কিংবা হাদিসে বিকৃত আনার কারণে মুসলমানদের মধ্যে নানা মত ও পথ সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিকৃতি সংশোধন করতে হবে।

সূরা আ’আমের ১৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

“যে একটি সৎকর্ম করবে সে তার দশগুণ (পুরস্কার) পাবে এবং যে একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বাস্তবিক অর্থেই তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।” (৬:১৬০)

মানব রচিত মতবাদের সঙ্গে আল্লাহ প্রেরিত ধর্মীয় আইনের পার্থক্য হচ্ছে- মহান আল্লাহ প্রতিটি পূণ্য কাজের জন্য বড় ধরনের পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন। বেশিরভাগ মানব রচিত মতবাদ বা ব্যবস্থায় আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে কিন্তু আইন মেনে চললে পুরস্কারের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ঐশি ব্যবস্থায় আইন লঙ্ঘনকারীর জন্য যেমন শাস্তি রয়েছে তেমনি আইন মেনে চললে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সে পুরস্কার কখনো কৃতকার্যের ১০ গুণ কখনো বা তার চেয়ে অনেক বেশি। এখান থেকে পুণ্যবান ব্যক্তিদের প্রতি মহান আল্লাহর অশেষ করুণার বিষয়টি ফুটে ওঠে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থায় শাস্তির চেয়ে পুরস্কারের ব্যবস্থা বহুগুণে বেশি থাকা উচিত।

দুই. পরকালে মানুষের সঙ্গে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে শুধুমাত্র পাপ ও পুণ্য যাবে, অন্য কিছু নয়।

সূরা আন’আমের ১৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“আপনি বলে দিন : আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন- একাগ্রচিত্ত ইব্রাহিমের বিশুদ্ধ ধর্ম। সে অংশীবাদিদের অন্তর্ভূক্ত ছিল না।” (৬:১৬১)

মক্কার মুশরিকরা নিজেদেরকে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর অনুসারী বলে দাবি করতো। তারা বলতো : ইব্রাহিমের অনুসারী বলেই আমরা আজও পবিত্র হজ্বব্রত পালন করি। পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে কাফেরদের একথা বলার নির্দেশ দিচ্ছেন যে, হযরত ইব্রাহিমও তাদের এ আচরণের জন্য ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। আজ এসব মুশরিক যেসব শিরকি বা অংশীবাদী কাজ করছে তা কখনো হযরত ইব্রাহিমের প্রদর্শিত ধর্মে ছিল না। হযরত ইব্রাহিম যে ঐশি ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন তা ছিল যুক্তি ও বুদ্ধিনির্ভর এবং তাতে আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার সৃষ্টির কোন সুযোগ ছিল না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. মহান আল্লাহ প্রদর্শিত সরল পথের প্রকৃত আদর্শ হলেন বিশ্বনবী (সা.)। তাঁর আচরণ বা বক্তব্যকে ব্যঙ্গ করলে মানুষ সঠিক পথের দিশা পাবে না।

দুই. সব ঐশি ধর্মের মূলকথা একত্ববাদ। ইসলাম ধর্ম হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রদর্শিত ধর্মেরই পূর্ণাঙ্গ রূপ মাত্র।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)