আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আ'রাফ; (১০ম পর্ব)

1 বিভিন্ন মতামত 05.0 / 5

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৩৯-৪৩

সূরা আরাফের ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالَتْ أُولَاهُمْ لِأُخْرَاهُمْ فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْسِبُونَ (৩৯) إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ(৪০)

"তাদের পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদেরকে বলবেঃ এখন তো তাহলে আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব রইল না। সুতরাং তোমরা যা করেছ তার শাস্তি ভোগ কর।" (৩৯)

"নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে এবং অহমিকাবশত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের জন্যে আকাশের দরজাগুলো খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। আমি এমনিভাবে পাপীদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।" (৪০)

আগের পর্বের আলোচনায় আমরা দোযখীদের পরস্পরের বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছি। এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, বিচ্যুত লোকেরা দোযখে এসে তাদের পাপের দায়ভার নিজ নিজ নেতাদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু আগেই দোযখে স্থান করে নেয়া ওইসব নেতা নিজ নিজ অনুসারীদের বলবেন, আমাদের ওপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তাই তোমরা আমাদের চেয়ে কম শাস্তি আশা করতে পার না। কারণ, তোমরাও আমাদের মতই অপরাধ করেছ এবং অবশ্যই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর আল্লাহও বলছেন, এই দুই কাফের গ্রুপই এইসব অজুহাত বা বাহানার মাধ্যমে দোযখ থেকে কিছুতেই মুক্তি পাবে না। কারণ, তারা গোড়ামি, অহংকার, আত্ম-প্রীতি ও নিজেকে বড় ভাবার মত নানা দাম্ভিকতায় আচ্ছন্ন ছিল বলেই সত্যকে অস্বীকার করত, তাই সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে উটের প্রবেশ করা যেমন অসম্ভব তেমনি বেহেশতে প্রবেশ করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব। তারা অত্যন্ত কঠোর শাস্তি পাওয়ার মত কাজ করায় আল্লাহর রহমতকে আকৃষ্ট করার সব পথ তারা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. ইহ ও পরকালের সৌভাগ্য নির্ভর করে মানুষের নিজেরই কাজের ওপর। অন্যরা বড় অপরাধ করেছে বলে তাদের অনুসারীদের ছোট পাপ ক্ষমা করা হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

দুই. পাপ খোদায়ী রহমতের দরজাগুলো মানুষের জন্য বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা আল্লাহর বিশেষ দয়া থেকে বঞ্চিত হয়।

তিন. খোদায়ী ধর্মগুলোর যুক্তির দূর্বলতা নয় বরং কুফুরি ও খোদাদ্রোহীতার শেকড় হচ্ছে অহংকার ও নিজেকে বড় ভাবা।

সূরা আরাফের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَهُمْ مِنْ جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَمِنْ فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ ((৪১

"জাহান্নামের আগুন হবে তাদের বিছানা এবং তাদের উপরেও থাকবে ভাঁজের উপর ভাঁজ করা আগুনের চাদর বা আচ্ছাদন। যারা জুলুম করে বা অবিচারক এই হবে তাদের জন্য আমার প্রতিদান।" (৭:৪১)

এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, জাহান্নামের আগুন কাফেরদেরকে সব দিক থেকে ঘিরে রাখবে। ফলে তারা এক সেকেন্ডের জন্যও নিঃশ্বাস ফেলার ও স্বস্তি অনুভব করার সময় পাবে না। এই আয়াতে আল্লাহ কাফেরদেরকে কখনও অপরাধী এবং কখনও জালেম বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, কুফুরি পাপ ও জুলুমের পথ প্রশস্ত করে।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. যারা দুনিয়াতে কেবলই আরাম-আয়েশের পেছনে ছুটেছে দোযখই হবে তাদের চূড়ান্ত আবাস। আগুন ছাড়া তাদের অপবিত্র আত্মা প্রশান্ত হবে না।

দুই. কাফের ও জালেমদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখবে দোযখের আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে চারদিক থেকেই দগ্ধ করবে।

সূরা আরাফের ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ((৪২

"(অন্যদিকে) যারা (আমার ওপর) ঈমান এনেছে বা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং (সাধ্য অনুযায়ী যতটা) সৎকর্ম করেছে (তা আমরা গ্রহণ করব); আমরা তো (তাদের) কাউকে তার সামর্থ্যের চাইতে বেশী দায়িত্ব অর্পণ করি না। তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।" (৪২)

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে পাপী ও কাফিরদের জন্য নির্ধারিত শাস্তির বর্ণনা দেয়ার পাশাপাশি সৎকর্মশীলদের জন্য পুরস্কারের বর্ণনাও দিয়েছেন। আগের আয়াতে কুফরির কঠোর শাস্তি বর্ণনার পর এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ঈমানদার ও সৎকর্মশীলরা বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। কারণ, তারা সাধ্য অনুযায়ী সৎকাজ করেছে বা সৎ কাজ করার চেষ্টা করেছে। আর এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমরা কারো কাছেই তার সাধ্যাতীত কিছু প্রত্যাশা করি না।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. ঈমান ও সৎকর্মের পুরস্কার হল চিরস্থায়ী বেহেশত এবং সেখানে তারা পবিত্র ও উচ্চ পর্যায়ের পুণ্যবানদের সঙ্গী হবেন।

দুই. ইসলামে সাধ্যাতীত দায়িত্ব পালনের কোনো বিধান নেই। প্রত্যেকেই তার সাধ্য অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছে কিনা সেটাই দেখা হবে।

সূরা আরাফের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي هَدَانَا لِهَذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَا أَنْ هَدَانَا اللَّهُ لَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ وَنُودُوا أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ((৪৩

"(বেহেশতে প্রবেশের আগেই) আমি তাদের অন্তর থেকে বিদ্বেষ দূর করে দেব (ফলে বেহেশতীদের মধ্যে থাকবে আন্তরিকতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ) । তাদের (জান্নাতের গাছগুলোর) পাদদেশে প্রবাহিত থাকবে নদী; এবং তারা বলবে; প্রশংসা আল্লাহ্‌র যিনি আমাদের এই [শান্তির] পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্‌ আমাদের পথ প্রদর্শন না করালে আমরা কখনও পথ খুঁজে পেতাম না। আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ আমাদের কাছে সত্য কথা নিয়ে এসেছিলেন এবং তারা উচ্চ স্বরে বলতে শুনবে, দেখ ! তোমাদের সম্মুখে [বেহেশতের] বাগান ! তোমাদের [ভালো] কাজের প্রতিদান হিসেবে তোমাদের এই [জান্নাতের] উত্তরাধিকারী করা হয়েছে।" (৪৩)

বেহেশতবাসীর জন্য আল্লাহর অন্যতম বড় নেয়ামত হল, সেখানে প্রবেশের আগেই তাদের মধ্যে থাকবে আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতা। কোনো ধরনের দুঃখ ও বিদ্বেষ তাদের মধ্যে থাকবে না। ফলে বেহেশতের পরিবেশ হবে পবিত্রতায় ভরপুর। সেখানে কেউ কারো জন্য জ্বালাতন ও বিরক্তির কারণ হবে না এবং থাকবে না কারো মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। বেহেশতীদের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য থাকলেও এ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো ঈর্ষাবোধ বা গ্লানি থাকবে না।

বেহেশতবাসীরা সব সময়ই আল্লাহকে স্মরণ করবেন। বেহেশতের সুখ-শান্তির কারণে আল্লাহকে তারা ভুলে যাবেন না, বরং তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। তারা বলবেন, দুনিয়াতে আসমানি কিতাব ও নবী-রাসূল পাঠানোর মাধ্যমে হেদায়াতের ব্যবস্থা করা না হলে আমরা আজ এই বেহেশতে আসতে পারতাম না। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সৎকর্ম করার প্রতিদান যে বেহেশত-এ কথা আমরা আসমানি কিতাব ও নবী-রাসূলদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষণীয় দিক হল:

এক. যারা পার্থিব জীবনে হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত তাদের জীবন বেহেশতী সুখে পরিপূর্ণ।

দুই. বেহেশতবাসীরা তাদের সৎকর্মের জন্য গর্বিত বা অহংকারী নন। বরং তারা মনে করেন খোদায়ী পথ প্রদর্শন বা হিদায়াত ও নবী-রাসূলদের কষ্টের ফসল হিসেবেই তারা বেহেশতবাসী হয়েছেন।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)